ভারতীয় সঙ্গীত ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বেগম আখতার ওরফে ‘আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি’। সাধারণভাবে আপামর ভারতবাসীর কাছে সুমিষ্ট গজল পরিবেশনের জন্য ইনি ‘মালেকা-এ-গজল’ বা ‘গজলের রাণী’ বলে পরিচিত হলেও শুধু গজল নয়, দাদরা-ঠুমরীর মত সনাতনী ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নানা ধারাতেই তাঁর যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় মেলে।

সালটা ১৯১৪, তারিখ ৭ই অক্টোবর। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের অভিজাত সৈয়দ পরিবারে জন্ম হল দুই জমজ কন্যার – জোহরা ও বিবি। এই ছোট্ট বিবিই হলেন আখতারি বা বেগম আখতার। তাঁদের মা মুশতারি বেগম ছিলেন বাবার তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। পরবর্তীকালে এক দুর্ঘটনায় জোহরার মৃত্যু হয় এবং সম্পত্তিজনিত কারণে বিবাহবিচ্ছেদের ফলে অসহায় মুশতারি ছোট্ট বিবিকে নিয়ে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসে ওঠেন। জীবনযুদ্ধে হার না মেনে একা মুশতারি ছোট্ট বিবিকে যখন বড় করে তুলছেন, সেসময় ছোট্ট বিবি উস্তাদ ইমদাদ খান সাহেবের কাছে প্রশিক্ষণ শুরু করে বলে শোনা যায়, যিনি ছিলেন পাটনার বিখ্যাত সারেঙ্গী বাদক। মুশতারি বেগম মেয়েকে নিয়ে গয়ায় আশ্রয় নেওয়ার দরুণ বিখ্যাত উস্তাদ জামির খাঁ সাহেবের কাছে বিবির তালিম নেওয়া শুরু হল। এরপর পাটনায় বন্যা দুর্গতদের সাহায্যের জন্য এক অনুষ্ঠানে মায়ের অনুরোধে বিবির গান গাওয়ার ব্যবস্থা হয়। বিবি তখন বছর দশেকের। ছোট্ট মেয়েটির গানে মুগ্ধ হয়ে এক রেকর্ড কোম্পানি তাঁকে দিয়ে রেকর্ড করায়। যদিও রেকর্ডটি তেমন চলল না, কিন্তু এই আখতারিই হয়ে উঠলেন পরবর্তীর বেগম আখতার এবং বলাবাহুল্য, এটিই তাঁর প্রথম রেকর্ড।
মা মুশতারি খানিকটা হতাশ হলেও কিছুদিন পর বিবির গলায় রেকর্ড হল ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো‘। ব্যাস, এর পরেই রেকর্ড বেরোলো এবং বিবিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না। মাত্র ১৩ বছর বয়সে গাওয়া এই গানই তাঁকে এনে দিল জগৎজোড়া খ্যাতি। শোনা যায়, এই সময় তিনি পাতিয়ালা ঘরানার বিশিষ্ট এক শিক্ষকের কাছে তালিম নিচ্ছিলেন। এর পরেই বিবি এলেন কলকাতায়। আর সেখানেই গান শেখা শুরু হল পাতিয়ালার উস্তাদ আতা মুহম্মদ খান সাহেবের কাছে। ঘটনাচক্রে তৎকালীন এক সঙ্গীতপ্রেমী তথা গ্রামাফোন কোম্পানির কর্ণধার জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের চোখ পড়ল আখতারের ওপর। আর জহুরীর চোখ আসল সোনাকে চিনতে ভুল করল না। আখতারকে দিয়ে গান রেকর্ড করে ফেললেন, বিবির সঙ্গীত জীবনের সূচনা হল। এরপর ১৯৩৪ সালে নেপাল-বিহার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে সাহায্যার্থে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আখতারের গান মুগ্ধ হলেন বিশিষ্ট কবি সরোজিনী নাইডু। বলাবাহুল্য, এই ঘটনা তাঁর সঙ্গীত জীবনকে বেশ খানিকটা ত্বরান্বিত করেছিল।
আরও একজন নারী, যিনি তাঁর জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ – তিনি হলেন গহরজান। ছোটবেলায় মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ছোট্ট বিবির ওপর চোখ পড়ে সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী গহরজানের, যাঁর রেকর্ডের ওপর কিনা লেখা হত ‘ফার্স্ট ড্যান্সিং গার্ল’। জন্মসূত্রে ইহুদী অ্যাঞ্জেলিনা ইরোয়ার্ডই হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তীকালের ‘জীবন্ত মিথ’ গহরজান। তিনি বিবির কথা শুনেই বুঝেছিলেন, এই মেয়ে পরবর্তীতে বড় গাইয়ে হবেই।


এই দুই মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ভর করে বেগমের সঙ্গীত জীবন শুরু হল। শুধু গজলই নয়, দাদরা-ঠুমরির ওপর অনেকগুলো গ্রামাফোন রেকর্ড তৈরী হল। তিনি বস্তুত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ‘মেহেফিল’-এ আটকে না রেখে, সেখান থেকে বেরিয়ে concert করতে শুরু করেন। ফলত দাদরা, ঠুমরি, গজল গণ্ডী পেরিয়ে আম-ভারতবাসীর কাছে পৌঁছে গেল। জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ ছাড়াও সুনীল বসুর চোখ তাঁকে এড়াতে পারেনি। এরপর সেই বিখ্যাত ঘটনা; বাস্তবের নয়, পর্দার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যাশ্রয়ে সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ সিনেমায় জলসাঘরে দুর্গাবাঈ ধরলেন পিলু ঠুমরি – “ভরি ভরি আয়ি মোর আঁখিয়া” – কণ্ঠে বেগম আখতার। সেই গানের মাদকতায় বাঙালী আজও আচ্ছন্ন। সেই সঙ্গে বাঙালীর মনে চিরস্মরণীয় দুর্গাবাঈ-এর চরিত্রে বেগম স্বয়ং। বাংলা গানের জগতে এই ঘটনা আজ ইতিহাস হলেও “পিয়া ভোলো অভিমান” বা “কোয়েলিয়া গান থামা” আজও বেজে চলেছে। ঠিক তেমনই “ইয়ে না থি হামারি কিসমৎ” বা “আই মোহাব্বৎ” বাঙালী কখনও ভুলবে না। রাজবাড়ীর সঙ্গীত মেহেফিলে গান গাইবার পাশাপশি অভিনয় দক্ষতারও পরিচয় দেন তিনি। ১৪ বছর বয়সেই আখতারি থিয়েটারে যোগ দেন। এরপরই অভিনয়ের জন্য বোম্বে থেকে ডাক পড়ল। প্রথম ছবি ‘নলদময়ন্তী’-তে অভিনয়ের পর ‘রোটি’-তে অভিনয় করেন। এরপরেই একের পর এক ডাক আসতে শুরু করে। কিন্তু বোম্বের জীবনে একপ্রকার বিতৃষ্ণাবশতই আখতার ইতি টেনে লক্ষ্ণৌতে ফিরে এলেন।

এরই মাঝে উত্তরপ্রদেশের রামপুরের নবাব-দরবারে নিমন্ত্রণ পেলেন আখতার। কিন্তু কিছুদিন থাকার পর নবাবের নিকাহ্-এর প্রস্তাব নাকচ করে চরম অপমান ও লাঞ্ছনার স্মৃতি নিয়ে তিনি রামপুর ছেড়ে চলে গেলেন। এইরকমই নানা ঘটনার মাঝে জীবন কাটছিল আখতারের। হঠাৎ পরিচয় হল লক্ষ্ণৌয়ের একজন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ আব্বাসীর সঙ্গে এবং তিনি তাঁকে বিবাহ করলেন। স্বামীর আপত্তির জন্য তিনি সঙ্গীত জীবন তথা সিনেমা জীবনে বিরতি টানলেন। প্রাণপণে অভিজাত বউ হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও আব্বাসীর পরিবার তাঁকে মানলেন না। আলাদা সংসারে এসে সন্তানসম্ভবা হলেন বেগম; পরে গর্ভপাত হল। একইভাবে সাতবার সন্তানসম্ভবা হয়েও গর্ভপাতের ফলে এক গভীর মানসিক অবসাদ গ্রাস করল তাঁকে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আখতারী চিকিৎসকের পরামর্শ এবং অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছায় গানের জগতে ফিরে এলেন। ১৯৪৯ সালে লক্ষ্ণৌতে All India Radio Station-এ ৩টি গজল ও ১টি দাদরা পরিবেশন করলেন। কিন্তু স্বামীর শর্ত ছিল বাইরে গান গাওয়া যাবে না। তাই বেগমের অনুরোধে মালহোত্রা বেগম আখতারের নামে গানগুলি প্রচার করলেন। তাঁর নতুন জন্ম হল। বলা যায় এক পূর্ণ বিকাশে তাঁর শিল্পীসত্তার পুনরায় উন্মেষ ঘটল। তাঁর রেকর্ড করা গানের সংখ্যা শীঘ্রই ৪০০-এর কোঠায় পৌঁছোয়। উল্লেখ্য, রাগপ্রেমী এই মানুষটি তাঁর নিজস্ব গজলগুলিতে নিজেই সুর করতেন ও সেগুলি রাগ রাগিনীতে সমাবিষ্ট।

সারাজীবন গানকে জড়িয়ে বেঁচে থাকা এই মানুষটি যেমন শাস্ত্রীয় সংগীতকে অলঙ্কৃত করেছেন, তেমনি গানও তাঁকে বঞ্চিত করেনি। ১৯৬৮-তে তিনি পেয়েছেন বিখ্যাত ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’। ১৯৭২ সালে বেগমকে সম্মানিত করা হয় ‘সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’-এ। ১৯৭৫-এ তিনি পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ সম্মান’।
১৯৭৪ সালে তিরুবন্তপুরম্ এর কাছে বলরামপুরম্ নামে এক জায়গায় কনসার্ট চলাকালীন তিনি হঠাৎ অস্বস্তিবোধ করেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন; তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি অনুষ্ঠান কমই করতেন কারণ তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু ঐবছরই ৩০শে অক্টোবর গুজরাটের আহমেদাবাদে এক বন্ধুর অনুরোধে অনুষ্ঠান করার সময় মাত্র ৬০ বছর বয়সে অনুষ্ঠান চলাকালীনই নক্ষত্রপতন ঘটে। বলাবাহুল্য, এটাই তাঁর শেষ অনুষ্ঠান। আখতারের মৃত্যুর পর লক্ষ্ণৌয়ের ‘পসন্দাবাগ’-এ তাঁর সমাধি তৈরি করা হয়। কিন্তু এখন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর সেই কবরে রয়েছে শুধুই ঝরা পাতাদল, বিরাজ করছে অনন্ত নীরবতা। হয়তো সেখানে বিষন্নতা ও যন্ত্রণার সাথে দাদরা-ঠুমরির স্মৃতিসুধা মিলেমিশে এক হয়ে রয়েছে।
লেখা- Koyel Chaudhuri

প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel