১৮১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আমেরিকার বালতিমোরের কাছে চেজাপিক বে এর উপর দাঁড়ানো একটি জাহাজ ‘এইচএমএস মিন্ডেন’। জাহাজের গায়ে লেখা একটি বাক্য- ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’। এইচএমএস মিন্ডেন থেকে ক্রমাগত নিক্ষেপ করা হচ্ছে ‘কনগ্রিভ রকেট’। লক্ষ্য ফোর্ট ম্যাকহেনরি। নিক্ষেপিত কনগ্রিভ রকেট ও বোমা হামলার প্রকোপে আমেরিকার রাতের আকাশ দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠছিলো। সেই উজ্জ্বল আলোকছটার ফাঁকে ফোর্ট ম্যাকহেনরির উপর ১৫টি তারকা ও ১৫টি স্ট্রাইপবিশিষ্ট ৩০ ফুট×৪২ ফুটের আমেরিকান পতাকাটিকে এক নজর দেখবার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে আছেন এইচএমএস মিন্ডেনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একজন আমেরিকান আইনজীবী, ফ্রান্সিস স্কট কী। পূর্ব আকাশে ১৪ সেপ্টেম্বরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই তিনি দেখতে পেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। সারা রাত বিধ্বংসী হামলার পরও ফোর্ট ম্যাকহেনরির উপর মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকার পতাকাটি। ফ্রান্সিস স্কট কী এর চোখ অশ্রুসিক্ত। এক অদ্ভূত শিহরণ বয়ে গেলো তার অন্তরে, শিরায়, উপশিরায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় খেলে গেলো কয়েকটি লাইন- “অ্যান্ড দ্য রকেট’স রেড গ্লেয়ার, দ্য বম্বস বার্স্টিং ইন এয়ার, গেইভ প্রুফ থ্রু দ্য নাইট, দ্যাট আওয়ার ফ্ল্যাগ ইজ স্টিল দেয়ার”। তার পর দিন হোটেল ‘ইন্ডিয়ান কুইন’-এ বসে তিনি রচনা করলেন ‘ডিফেন্স অফ ফোর্ট ম্যাকহেনরি’ কবিতাটি এবং তা প্রকাশিত হলো ‘দ্য স্টার-স্প্যাঙ্গেল্ড ব্যানার’ নামে। দ্য স্টার-স্প্যাঙ্গেল্ড ব্যানারকে ১৯৩১ সালে আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এবং ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’ বাক্যটিকে ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অফিসিয়াল মোটো হিসেবে গ্রহণ করে আমেরিকান কংগ্রেস।
আমেরিকার এই জাতীয় সঙ্গীতটি যে রকেট হামলার মাধ্যমে অনুপ্রেরিত হয়েছিলো, তার পেছনের গল্পটা কি আমরা সবাই জানি? যে জাহাজের ওপর দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস স্কট কী রচনা করেছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতার গান, সেই এইচএমএস মিন্ডেনের ইতিহাসই বা আমরা ক’জন জানি?
১৭৩৬ সাল। মালাবার উপকূলের সবচেয়ে উন্নত মানের সেগুন কাঠের জন্য বোম্বেতে জাহাজের ঘাঁটি স্থাপন করলো ব্রিটিশরা। সেখানকার ওয়াডিয়া পরিবারের সদস্যরা ছিলেন জাহাজ নির্মাণে সুদক্ষ। সুতরাং যুদ্ধ-জাহাজ তৈরীর জন্য ভারতবর্ষের চেয়ে উপযুক্ত জায়গা আর হতেই পারে না।
১৮১০ সাল। ‘মাস্টার শিপ-বিল্ডার’ খেতাব পাওয়া ওয়াডিয়া পরিবারের সবচেয়ে দক্ষ জাহাজ-নির্মাতা জামশেতজী বোমানজী ওয়াডিয়া এই বোম্বে ডকেই তৈরী করলেন অনন্য এক যুদ্ধ-জাহাজ, এইচএমএস মিন্ডেন। জাহাজটি ১৮১১ সালে ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় এবং ১৮১২ সালের অ্যাংলো-মার্কিন যুদ্ধের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ-জাহাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ভারতবর্ষে তৈরী এই এইচএমএস মিন্ডেনই ছিলো আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত রচনার ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপকরণ।
১৭৬৭ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত চার দফায় যুদ্ধ হয়েছে ব্রিটিশ ও মাইসোরবাসীর মধ্যে। মাইসোরের সুলতান হায়দার আলী এবং তার ছেলে ও পরবর্তী সুলতান ফতেহ আলী সাহাব টিপু ওরফে টিপু সুলতান ছিলেন এই যুদ্ধে মাইসোরের প্রধান শক্তি। আর তাদের প্রধান অস্ত্র ছিলো রকেট। সামনে সূক্ষ্ম তলোয়ার ও বারুদবিশিষ্ট এই রকেটকে প্রচন্ড ভয় পেতো ব্রিটিশরা। যুদ্ধে প্রথম বারের মতো রকেটের ব্যবহার শুরু করেছিলেন হায়দার আলী ও টিপু সুলতান। টিপু সুলতান এই রকেটকে মডিফাই করেছিলেন আরও আধুনিকভাবে। তাই টিপু সুলতানকে বলা হতো ‘রকেটম্যান’। হায়দার আলী যুদ্ধের প্রথম দিকে রকেট নিক্ষেপের জন্য ১২০০ জনের একটি ইউনিট ব্যবহার করেছিলেন এবং পরবর্তীতে টিপু সুলতান সেই ইউনিটের লোকসংখ্যা বাড়িয়ে ৫০০০-এ উন্নীত করেছিলেন এবং চমকপ্রদ অসংখ্য রকেট দিয়ে নাজেহাল করেছিলেন ব্রিটিশদেরকে।
প্রথম দুটি যুদ্ধে মাইসোরের জয় হলেও পরের দুটি যুদ্ধে পরাজিত হয় ভারতবাসী এবং ১৭৯৯ সালের ৪ মে টিপু সুলতান শহীদ হয়ে যাবার পর ব্রিটিশরা তার আবিষ্কৃত রকেটের একটি বিশাল সংগ্রহ উদ্ধার করে। এই রকেটকে আরও অভিনব রূপ দেন ব্রিটিশ সৈনিক স্যার উইলিয়াম কনগ্রিভ। ৬ পাউন্ড থেকে শুরু করে ৩০০ পাউন্ড ওজন পর্যন্ত অত্যাধুনিক রকেট তৈরী করেন কনগ্রিভ। তবে সবচেয়ে কার্যকরী রকেটটি ছিলো ৩২ পাউন্ডের। একে ‘কনগ্রিভ রকেট’ বলা হয়। এই ৩২ পাউন্ডের কনগ্রিভ রকেটটিকেই ব্যবহার করা হয়েছিলো আমেরিকার ফোর্ট ম্যাকহেনরির বিরুদ্ধে।
১৮১৪ সালের আগস্ট মাস। ওয়াশিংটনে এসে তান্ডব শুরু করলো ব্রিটিশরা। সমস্ত স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলতে শুরু করলো তারা। কংগ্রেসের লাইব্রেরি, এমনকি হোয়াইট হাউজেও আগুন ধরিয়ে দিলো। এই বিশৃঙ্খলার মাঝে অসংখ্য আমেরিকান ব্রিটিশদের কয়েদীতে পরিণত হলো। আমেরিকান কয়েদীদেরকে রাখা হলো ভারতবর্ষ থেকে তৈরী করে আনা সে সব যুদ্ধজাহাজে। কয়েদীদের মাঝে একজন ছিলেন ড. উইলিয়াম বিন্স। বিন্স ছিলেন বেশ সম্মানিত ব্যক্তি। অসংখ্য আহত ব্রিটিশ সৈন্যের চিকিৎসাও তিনি করেছিলেন। এই বিন্সকেই ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য ‘এইচএমএস টনেন্ট’ নামের জাহাজে এসে উপস্থিত হন ফ্রান্সিস স্কট কী। এক পর্যায়ে তিনি ব্রিটিশদের রাজিও করিয়ে ফেলেন। কিন্তু ভুলবশত তাদের সেই আলোচনায় ফোর্ট ম্যাকহেনরির উপর আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েও কথা চালিয়ে যায় ব্রিটিশরা এবং নিজেদের ভুল উপলব্ধি করার পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, চূড়ান্ত আক্রমণের আগ পর্যন্ত ফ্রান্সিসকেও তারা বন্দী করে রাখবে। ফ্রান্সিসকে স্থানান্তরিত করা হয় এইচএমএস মিন্ডেনে। আর এর পরই রচিত হয় ইতিহাস, আমেরিকার অনুপ্রেরণার গানে ভারতবর্ষের রকেটের প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস।
আজও হোয়াইট হাউজে মালাবারের সেই সেগুন কাঠের তৈরী একটি বাক্স অক্ষত অবস্থায় রয়েছে, যেটির ওপর দাঁড়িয়েই ফ্রান্সিস স্কট কী আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন বলে আব্রাহাম লিংকনকে পাঠানো উইলিয়াম সি নয়েজের একটি চিঠি থেকে জানা গিয়েছে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক কালের যুদ্ধগুলোতে ব্যবহৃত মিসাইলের ধারণার প্রচলন কিন্তু ভারতবর্ষের টিপু সুলতানই করে গিয়েছিলেন।
রেফারেন্স: