Trojan War

হলিউড স্টার ব্রাড পিটের বিখ্যাত মুভি ট্রয় যারা দেখেছেন কিংবা ট্রয় নগরীর সেই মহাকাব্যিক ঘটনা যাদের জানা আছে তাদের কাছে ট্রয় নগরী সম্পর্কে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় ট্রয় নগরী আর রাণী হেলেন ছিলেন প্রবাদপ্রতিম চরিত্র। মানুষের মুখে মুখে লোককথা হিসেবে প্রচলিত ছিল ট্রয় নগরী আর রাণী হেলেনের গল্প। ট্রয় সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাটি এমন যে, রাণী হেলেনের ভালবাসার আগুনে ধ্বংস হয়েছিল এই শহর। ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিসের সাথে প্রেম হয়েছিল স্পার্টার রাণী হেলেনের। প্যারিস তাকে পালিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আর সেই ঘটনা থেকেই শুরু হয় যুদ্ধ। আর এই ট্র‍্যাজেডিতে ধ্বংস হয়ে যায় প্রাচীন শহর ট্রয়। ট্রয় আর ট্রোজান হর্সের সেই যুদ্ধ প্রথম পাওয়া গিয়েছিল গ্রিক মহাকবি হোমারের ইলিয়ড ও ওডিসি মহাকাব্যে। একসময় ট্রয়ের এই কাহিনীকে নিছক গল্প বলে মনে করা হলেও তুরস্কের হির্সালিক অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন ট্রয় নগরী খুঁজে পান তখনই এর সত্যতা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়। কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল প্রাচীন ট্রয় নগরী? চলুন শুনা যাক।

Tiepolo, Giovanni Domenico: The Procession of the Trojan Horse into Troy

ট্রোজান হর্স ট্রয় যুদ্ধের বিখ্যাত সেই ঘোড়া। Photo Credit: Britannica

প্রাচীন এশিয়া মাইনরে (যা বর্তমানে তুরস্কের অংশ) বিখ্যাত ট্রয় নগরীটি অবস্থিত ছিল। এই নগরীর রাজা ছিলেন প্রিয়াম ও রাণী ছিল হেকবা।  তাদের দুইজন ছেলে ছিল। বড় ছেলের নাম ছিল হেক্টর ও ছোট ছেলের নাম ছিল প্যারিস। এই ট্রয় নগরীর প্রতিবেশী নগর ছিল গ্রিক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত স্পার্টা ও এথেন্স। স্পার্টা ও ট্রয়ের সীমারেখা বিভক্ত ছিল ইজিয়ান সাগর দ্বারা। রাজা প্রিয়ামের পূর্ব থেকেই ইজিয়ান সাগরের উভয় পার্শ্বের এই দুই নগরীর মধ্যে নানা সময়ে শক্তিমত্তার প্রমাণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নানা বিরোধ বলবৎ ছিল। কিন্তু যখন প্রিয়াম ট্রয় নগরের ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি ট্রয় নগরীকে পূর্বের যেকোন সময়ের চাইতে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যান। ফলে স্পার্টার সাথে স্থিতি অবস্থা গড়ে উঠে। এতে উভয় অঞ্চলের মধ্যে ভালো একটি বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই সময়টি খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০-১২০০ অব্দে। প্রিমিয়ামের দুই পুত্র হেক্টর ও প্যারিস বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে স্পার্টায় গমন করেন। তখন স্পার্টার রাজা ছিল মেনেলাস এবং তার ভাই আগামেমন ছিলেন পার্শ্ববর্তী মাইসেন অঞ্চলের রাজা। প্যারিস ও হেক্টর যখন স্পার্টায় গমন করেন তখন রাজা মেনেলাস তাদের কে অত্যন্ত সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাদের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ আথিতেয়তার ব্যবস্থা করেন। এই অনুষ্ঠানেই মেনেলাস তার স্ত্রী হেলেন কে নিয়ে হাজির হন এবং সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। এখানেই ট্রয় রাজকুমার প্যারিসের সাথে হেলেনের পরিচয় হয়।

প্যারিস হেলেন কে দেখার পরই তার প্রেমে পড়ে যায়। প্রথমদিকে কুশলাদি বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে তাদের মধ্যে অনেক কথা বার্তা হয়। একপর্যায়ে প্যারিস ও হেলেন উভয়ে একে অন্যের প্রেমে পড়ে যায়। এদিকে মেনেলাস ও অন্যান্যরা এসবের কিছুই জানতে পারেনি। হেলেন প্যারিসের প্রেমে পড়ার অনেকগুলো কারন ইতিহাসে প্রচলিত আছে। প্রথম কারণটি হলো গ্রিক মিথোলজি। গ্রিক মিথলজি মতে বলা হয়ে থাকে যে তৎকালীন সময়ে এসব অঞ্চলের জনসংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পায়। তাতে গ্রিক দেবতা জিউস চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি জনসংখ্যা কমানোর জন্য হেলেন ও প্যারিসের মাধ্যমে একটি যুদ্ধের সূত্রপাত করেন যাতে করে যুদ্ধে সৈন্যগন নিহত হওয়ার মাধ্যমে জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে। গ্রিক পুরাণে আরেকটি মত প্রচলিত আছে যে- দেবী আফ্রোদিতি রাজপুত্র প্যারিসকে এক বিশেষ বর দিলেন, এই বর ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর ভালোবাসা। আর সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মানবী ছিলেন হেলেন, যার রূপের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ ছিল। কিন্তু হেলেন তখন ছিলেন স্পার্টার রাজা মেনেলাসের স্ত্রী। অন্যের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আফ্রোদিতির দেওয়া বরে হেলেন তার মনপ্রাণ সঁপে দিলেন ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসকে।

হেলেন ও প্যারিস, Photo Credit: retrospectjournal

হেলেন এবং মেনেলাসের বয়সের দুরত্ব অনেক। ফলে হেলেন কখনো মেনেলাস কে মন থেকে ভালোবাসতে পারতো না। যদিও মেনেলাস হেলেন কে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, তার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য মেনেলাস সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন। ফলে হেলেন যখন তার মনের মত কাউকে খুঁজে পেলেন তখন তিনি আর নিজেকে ঠিক রাখতে সব কিছু ভুলে গিয়ে প্যারিসের প্রেমে পড়ে যান।প্যারিস এবং হেক্টর যখন কাজ শেষে সৈন্য সামন্ত নিয়ে নিজ দেশে ফেরার জন্য ইজিয়ান সাগরে জাহাজের পাল তুলে দিলেন এর কিছুক্ষন পর বেশকিছু পথ অতিক্রম করার পর প্যারিস তার বড় ভাই হেক্টরের কাছে হেলেন কে নিয়ে উপস্থিত হলেন। অর্থাৎ প্যারিস স্পার্টা থেকে ফিরে আসার সময় রাতের আঁধারে সাথে করে হেলেনকেও নিয়ে চলে আসছেন। হেক্টর হেলেন প্যারিসের সাথে জাহাজে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কারন হেক্টর ছিলেন পিতার মত একজন যোগ্য দূরদর্শী রাজকুমার। তিনি সাথে সাথেই অনুধাবন করতে পারলেন তাদের জন্য কি পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাই তিনি হেলেন কে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হেলেন যেতে রাজি হচ্ছিল না। একই সাথে প্যারিসও হেলেন কে ট্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হেক্টরের কাছে অনুনয় করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত হেক্টর, প্যারিস ও হেলেন সকলেই ট্রয়ে পৌছায়। আর ট্রয় অপেক্ষা করতে থাকে এক অনাগত যুদ্ধের।

এদিকে মেনেলাস টের পেলেন ট্রয়ের রাজপুত্ররদের সাথে স্ত্রী হেলেনও চলে গেছেন। তিনি সাথে সাথেই বুঝতে পারলেন তার স্ত্রীকে ট্রয়ের রাজপুত্ররা নিয়ে গেছে। তখন তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেন এবং ট্রয় নগরী কে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন। তবে ট্রয়কে গুড়িয়ে দেয়া এতো সহজ ব্যাপার ছিল না। কেননা বিশাল ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করা এবং ট্রয়ের সুরক্ষিত নগর প্রাচীর তার উপরে ট্রয়ের শক্তিশালী সেনাবাহিনী তো রয়েছেই। তাই মেনেলাস তার ভাই আগামেমনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তার ভাই তার ডাকে সাড়া দিয়ে সাহায্যে নিয়ে এগিয়ে আসে। ফলে দুই বাহিনীর সম্মিলিত শক্তি এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য হাজার হাজার জাহাজ নামিয়ে দেয় এবং সাথে নিয়ে আসেন গ্রিসের তৎকালীন বিখ্যাত যোদ্ধা একিলিস কে। ফলে গ্রিক বাহিনী ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে প্রথমেই ট্রয়ের নৌবন্দর দখল করে ফেলে এবং নির্বিচারে ট্রয়দের হত্যা করতে থাকেন। ফলে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কোন পক্ষই সুবিধা করতে পারেনি প্রথমে। ট্রয় নগরী শক্তিশালী প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত ছিল যা ভেদ করা গ্রিকদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি। অপরদিকে গ্রিকদের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর বিপক্ষে ট্রয়রাও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারছিল না। ফলে যুদ্ধ চলতে থাকে। একইসাথে উভয়ে শিবিরে হতাহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হাজার হাজার সৈন্য নিহত হতে থাকে। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল ছিল দশ বছর। যখন এই যুদ্ধের কোন মীমাংসা হচ্ছিল না  তখন গ্রিকরা এক কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে।  তারা একটি বিশাল আকৃতির কাঠের ঘোড়া তৈরি করে এবং রাতের আঁধারে সেটি ট্রয় নগরীর অদূরে ফেলে রেখে যায় এবং তাদের তাবু গুটিয়ে অন্যত্র নিয়ে যায়। এটিই ছিল সেই ঐতিহাসিক ট্রোজান হর্স। পরদিন সকালে ট্রয়বাসীরা যখন এই বিশাল আকৃতির কাঠের ঘোড়া দেখলো এবং দেখলো যে গ্রিকদের তাঁবু আর দেখা যাচ্ছে না। তখন ট্রয় সৈন্যরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। তারা বলতে শুরু করে যে গ্রিকরা পরাজয় স্বীকার করে চলে গেছে এবং উপঢৌকন হিসেবে এই চমৎকার ঘোড়াটি রেখে গেছে। ফলে এটিকে নগরীর অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়।  কিন্তু রাজা প্রথমে তা নিতে স্বীকৃতি না জানালেও পরবর্তীতে সৈন্য ও অমাত্যদের চাপে এটি নগরীর ভিতরে নিতে সম্মতি জানান। ফলে ট্রয় সৈন্যরা বিজয় উল্লাস করতে করতে এটিকে টেনে টেনে নগরীর অভ্যন্তরে নিয়ে যান।

Helen and King Menelaus

হেলেন ও রাজা মেনিলাস Source: Pinterest

ফলে যখন রাত্রি ঘনিয়ে আসে এবং সমগ্র ট্রয়বাসী গভীর ঘুমে নিমগ্ন তখন গ্রিকদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে এই ঘোড়ার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সৈন্যরা একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং নগরীর মূল ফটক খুলে দেয়। ফলে অদূরে ওঁৎ পেতে থাকা গ্রিক সৈন্য সমুদ্রের গর্জনের মত ট্রয় নগরীর উপর হামলে পড়ে। নগরীর ভিতরে ঢুকেই অগ্নিসংযোগ করতে শুরু করে তারা।  ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী নগরীর বুকে। ট্রয় নগরীর সৈনিকরা কোন প্রকার অবস্থান নেয়ার পূর্বেই তাদের কে খতম করে দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় ট্রয়ের মত একটি সমৃদ্ধ নগরী। এই যুদ্ধে হেক্টর, প্যারিস, একিলিস সহ ট্রয়ের প্রায় সকলেই মারা যায়। শুধু বেঁচে যায় অল্পকিছু সংখ্যক নারী ও শিশু যাদের কে পরবর্তীতে গ্রিকদের দাস দাসী তে পরিনত করা হয়। যে হেলেনের জন্য এই বিখ্যাত ট্রয় নগরীর পতন হয় এবং এই বিশাল যুদ্ধ হয় তার শেষ পরিণতি সম্পর্কে পরিষ্কার করে তেমন কিছু জানা যায় না। মনে করা হয় মেনেলাস তাকে ফিরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হেলেনের ভালবাসার কাছে তিনি হার মানেন।

 
তথ্যসূত্র