নূর এনায়েত খান ভারতের মহীশুরের শাসক ইতিহাসের বিখ্যাত বীর টিপু সুলতানের বংশধর। তার বাবা হজরত এনায়েত খান ছিলেন টিপু সুলতানের প্রপৌত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছরেই তার জন্ম (১৯১৪ সালে) হয় রাশিয়ার মস্কো শহরে। তাঁর বাবা বাবা ইনায়াত রেহ্মাত খান ছিলেন ভারতীয়, উত্তর ভারতের প্রখ্যাত ক্লাসিক্যাল মিউজিশিয়ান, তিনি হায়দারাবাদের নিজামের কাছ থেকে ‘তানসেন’ উপাধি পেয়েছিলেন। মা ওরা রে বেকার ছিলেন আমেরিকান। নূর এনায়েত খান বেড়ে উঠেন যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে। তার বারো বছর বয়সেই তার বাবা ইনায়াত রেহ্মাত খান একাই ভারতে ফিরে যান এবং সেখানে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান ।সে সময় পরিবার ও ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা করতে হচ্ছিল নূরকে। এই জীবন সংগ্রামই তার চরিত্রকে দৃঢ় করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।পরে ছোট ভাই বিলায়াত যোগ দিয়েছিল ব্রিটিশ নেভিতে, আর ছোট বোন ক্লেয়ার যোগ দেয় এটিএস (আর্মি টেরিটোরিয়াল সার্ভিস)।
প্যারিসে শিশুদের জন্য ম্যাগাজিন ও রেডিও তে কাজ করতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার সময় ১৯৩৯ সালে তিনি ফ্রান্সের রেড ক্রসে সেবিকা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৪০ সালে ফ্রান্স সরকার জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণের আগে আগে তিনি নদীপথে মা ও বোনকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে আসেন। সেখানে আসার পরপরই তিনি উইমেনস অগজিলিয়ারি এয়ারফোর্সে (ডব্লিউএএএফ) রেডিও অপারেটর হিসেবে যোগদান করেন। পরে এসওই-তে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেন তিনি। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তার কি দৃষ্টিভঙ্গি? তিলি বলেন এখন হয়তো তাকে ব্রিটিশদের হয়েই লড়তে হচ্ছে, তবে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্যই লড়বেন। নিজের পরিশ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে নূর কম সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশদের আস্থা অর্জন করেন।
ওই সময় নোরা বেকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নূর এনায়েত খান ১৯৪২ সালে যুক্তরাজ্যের অভিজাত গোয়েন্দা বাহিনীতে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীরা যখন ফ্রান্স কব্জা করে নেয় তখন যুক্তরাজ্যের স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভের (এসওই) হয়ে কাজ করেন দুঃসাহসী নূর। এসওইয়ের হয়ে ফ্রান্সে যান এর পরপরই। তখন তিনি আর নূর ইনায়াত খান না, তিনি তখন শিশুদের নার্স, তার নাম হয়’ জিন-মেরি রেইনার’, কোডনেম ছিল ‘’মাদেলিন’’।
তার ফ্রান্স যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল এসওই-র হয়ে রেডিও অপারেটর হিসেবে কাজ করা। তার উপর দায়িত্ব ছিলো ফ্রান্সের বিভিন্ন দখল করা জায়গার খবরগুলি হেডোকোয়ার্টারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা, কাজটা ছিলো ঝুঁকিপূর্ন ।প্রায়ই এসওই-র কোনো না কোনো রেডিও অপারেটর ধরা পড়তো। সবকিছু জানার পরও সংগঠনটির প্রথম নারী রেডিও অপারেটর হিসেবে এই কাজটি করার সাহস দেখিয়েছিলেন নূর। একজন বৃটিশ অফিসারের সাথে তার এনগেজমেন্টও হয় কিন্তু জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার ইচ্ছা সেই ভালবাসার টানকে ও ফিকে করে দিয়েছিলো। ১৯৪৩ সালের ১৬ জুন পশ্চিম সাসেক্সে অবস্থিত রয়্যাল এয়ার ফোর্সের ট্যাংমেয়ার এয়ার ফিল্ডে লাইস্যান্ডার বিমানে চড়ে এগিয়ে যান অক্ষশক্তির কাল থাবার বিরুদ্ধে লড়াই করতে। শেষ পর্যন্ত নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং কারাবন্দী হন। ১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির ডাকাউ বন্দিশিবিরে ঘাড়ের পেছন দিকে গুলি করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ব্রিটিশ রয়েল ডাক বিভাগ ইনায়েতের ছবি দিয়ে ডাকটিকেট বের করে তার জন্মশতবার্ষিতে। তিনি যে পিস্তলটা সবসময় নিজের কাছে রাখতেন সেই পিস্তলটি ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টারের ইমপেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়াম নর্থ জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। ওয়েবলি এম ১৯০৭ মডেলের পিস্তলটি দর্শনার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
১৯৪৯ সালে তিনি মরণোত্তর জর্জ ক্রস সম্মাননা অর্জন করেন। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই সম্মাননা কেবল তাদেরই দেয়া হয় যারা চরম বিপদের মুহূর্তে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। তিনি রূপালী তারকা সম্বলিত ক্রইক্স দ্য গ্যেরে সম্মাননাও অর্জন করেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ‘গোয়েন্দা রানি’ নূর এনায়েত খানের ভাস্কর্য লন্ডনের গর্ডন স্কয়ার গার্ডেনে আছে। কোনো মুসলিম ও এশীয় নারীর প্রতি সম্মান জানিয়ে যুক্তরাজ্যে ভাস্কর্য তৈরির ঘটনা এটাই প্রথম।
নূর এনায়েত খানের জীবনিকার শ্রাবণী বসু এবং নূর এনায়েত খান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের দীর্ঘ প্রচারণা ও প্রচেষ্টার পর যুক্তরাজ্য সরকার ভাস্কর্য তৈরিতে রাজি হয়। শ্রাবণী বসু বলেন, ‘আমি তাঁর জীবনী নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখি, তিনি ছিলেন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী। তিনি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও মহাত্মা গান্ধীর ভক্ত ছিলেন।