খোকা ঘুমালো
পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
সন্তানদের ঘুম পাড়ানোর জন্য বাংলার মায়েরা এই ছড়া গানটি গাইতেন এবং আজ ও গায়। কিন্তু আমরা কতটুকু জানি এই বর্গীদের সম্পর্কে? বাংলা অঞ্চলে বর্গী বলতে মূলত মারাঠাদের বোঝানো হতো। বর্গী শব্দটি মারাঠি বর্গি শব্দ হতে আগত। এর শব্দমূল ফারসি শব্দ থেকে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ হালকা অস্ত্র বহনকারী।অর্থাৎ মারাঠারা আক্রমণের সময় হালকা অস্ত্র ব্যবহার করত। দিল্লীর মুঘল শাসন আমলের ইতিহাসে আমরা প্রায় মারাঠা শক্তির আক্রমণের কাহিনী শুনতে পায়।প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।শত শত বছর ধরে যখন উত্তর ভারত তথা দিল্লির মসনদ অধিকার করে সুলতান পরবর্তীতে মুঘলরা শাসন করেছিল,তার বিপরীতে দক্ষিণ ভারতে মারাঠা শক্তি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল দিল্লির মসনদে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বরূপ। মহারাষ্ট্রের মহারাজা ছত্রপতি শিবাজির আক্রমণে আরঙগজেব কে পিছিয়ে যেতে হয়। এমনকি পেশোয়া প্রথম বাজিরাও লাল পতাকা উড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে ভারতের বড় অংশে আক্রমণ চালায়।
*কিছু কথা মারাঠাদের সম্পর্কে না বললেই নয়, দক্ষিণ ভারতের একটি প্রদেশে মহারাষ্ট্র। এই প্রদেশের ষোড়শ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সবচাইতে শক্তিশালী গোত্র মারাঠারা। তাদের মাতৃভাষা মারাঠি। এই গোত্র মূলত সমাজের নিম্নবর্গ যেমন তাতি,জেলে, ছুতার, চামার, মুচি প্রভৃতি শ্রমজীবীদের নিয়ে গঠিত ছিল।কিন্তু সামরিক দিক থেকে মহারাষ্ট্রের অন্যান্য গোত্রের থেকে সবচাইতে বেশি এগিয়ে ছিল মহারাষ্ট্রের মহারাজকে বলা হতো ‘ ছত্রপতি’। এই ছত্রপতি মহারাষ্ট্রের অন্যান্য প্রদেশের নাই মারাঠা প্রদেশের প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ করতেন যাকে বলা হতো ‘ পেশোয়া’। ১৬৮১ সালে মহারাষ্ট্রের মহারাজ শিবাজী ভোঁসলের মৃত্যু হলে তার জ্যেষ্ঠপুত্র ‘সম্ভাজি ভোঁসলে’ সিংহাসনে বসেন। তিনি পর্তুগিজ শক্তি এবং মহীশুরের ওয়াদির রাজাকে পরাজিত করেন।সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিদ্রোহী শাহজাদা আকবরের সাথে মিত্রতা সৃষ্টি করে মুঘলদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। যদিও পূর্বপুরুষের সাফল্য তিনি ধরে রাখতে পারেননি এবং ১৬৮৯ সালে পহেলা ফেব্রুয়ারি মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন এবং সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লে পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তার পুত্র সাহুজি ভোঁসলে কে বন্দি করা হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাহাজি ভোঁসলে ক্ষমতায় আসলে বালাজি বিশ্বনাথ কে পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। উল্লেখ্য বালাজি বিশ্বনাথ পেশোয়া প্রথম বাজিরাও এর পিতা। উনার সময় মারাঠা সাম্রাজ্য দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে মুঘল আমলে সুবা বাংলা অঞ্চলের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। পেশোয়া প্রথম বাজিরাও এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বালাজি বাজিরাও কে পেশোয়া নিযুক্ত করা হয়। তার অধীনে সেনাপতি রঘুজী ভোঁসলে ছিল অত্যন্ত দূর্ধর্ষ এবং নিষ্ঠুর সেনাপতি। বালাজি বাজিরাও এর অধীনে রাঘুজি ভোঁসলে ক্রমান্বয়ে রাজপুত, দক্ষিণের কর্ণাটক ও ত্রিচিনপল্লি তে অভিযান করেন এবং আক্রমণ চালায় । *এরপর রঘুজি ভোঁসলে বাংলা দিকে নজর দেন।কারিগরি, কৃষি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বাংলায় ছিল মহাদেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সুবা। ১৭৪২ সালে মারাঠারা প্রথম বাংলা আক্রমণ করেন।রাঘুজি ভোঁসলে অনেকটা শায়ত্ব শাসিত রাজার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। তার অধীনে তখন ভাস্কর রাম কোহ্লাটক নামক সেনাপতি বাংলা আক্রমণ করতে থাকেন।দুর্ধর্ষ নিষ্ঠুর এই সেনাপতি ইতিহাসে ভাস্কর পন্ডিত নামে পরিচিত। ভাস্কর পন্ডিত এর অধীনে মারাঠা সৈন্যরা বাংলার কৃষকদের জমিতে আগুন ধরে দিয়ে কৃষকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতেন। ঘরবাড়ি উজাড় করে দিতেন, নারী এবং শিশুদের উপর নির্বিচারে নির্যাতন চালাতেন।
বাংলার আকাশ-বাতাস তখন ক্রন্দনের ধ্বনি এবং অত্যাচারীর বিভীষিকায় এক হয়ে গেছিল। তখন সুবে বাংলার নবাব ছিলেন আলীবর্দী খান। সতেরোশো বিয়াল্লিশে উড়িষ্যা দখল করে তিনি কটক থেকে ফিরছিলেন। হুগলির আরামবাগ এলাকায় মোবারক মঞ্জিলে পৌঁছাতেই তার কাছে এই অকস্মাত্ আক্রমণ এবং হত্যাকাণ্ডের খবর আসে। তিনি প্রতিহত করার জন্য সংসদে রওনা দিলেন। ১৭৪২সালে ১৫এপ্রিল বুরদোয়ান অঞ্চলে পৌঁছালেন।ভাস্কর পন্ডিত এর অধীনে মারাঠা বাহিনী চারিদিক দিয়ে তাকে ঘিরে ফেলল। তখন আলীবর্দী খানের কাছে মাত্র ৩০০০ ঘোড়া শাওয়ার ছিল। যা মুর্শিদাবাদ রক্ষায় যথেষ্ট ছিল না।
ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠা একদল আলিপুর তিন বাহিনীর রসদ সরবরাহ বাধা দিতে লাগলো। আরেকদল চারিদিকে লুটতরাজ করতে লাগলো। বিনিময় আলীবর্দী খান তার গোলন্দাজ ও বন্দুকধারী বাহিনী দের নিয়ে মারাঠাদের বিধ্বস্ত করতে শুরু করলেন। আলীবর্দী শত্রুর আরো কাছে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলেন কিন্তু ছোটুর মারাঠারা আরো চারি দিকে প্রসারিত হয়ে লুটতরাজ করতে লাগলো। সুজাউদ্দৌলা, যাকে পরাজিত করে আলীবর্দী খান নবী সিংহাসনে বসেন তার জামাতা মির হাবিব প্রতিশোধ স্বরূপ মারাঠা বাহিনীর সাথে হাত মেলালেন। তার পরামর্শে ভাস্কর পন্ডিত ৭০০ ঘোড়া শাওয়ান নিয়ে মুর্শিদাবাদ হামলা চালালো। মুর্শিদাবাদের ধনকুব জগৎসেঠ এর কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে কাটোয়ার দিকে রওনা হলো। আলীবর্দী খান ইতিমধ্যে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে কাটোয়া ছেড়েছেন। সভাপতি মীর হাবিব মারাঠাদের পরামর্শদাতা রূপে কাজ করছিলেন এবং তিনি মারাঠাদের সুবিধার্থে হুগলি এবং এর বন্দর মারাঠাদের জন্য ছেড়ে দেন।
ব্যয় করে বড় আকারে দূর্গা পূজার আয়োজন করেন।মহা নবমীর রাতে আলীবর্দী খান তার জন্য সমেত অসচেতন মারাঠা বাহিনীর ওপর হামলে পড়লেন। অতর্কিত আক্রমণে পেরে উঠতে না পেরে মারাঠা বাহিনী পালিয়ে গেল। প্রতিশোধ স্বরূপ ভাস্কর পন্ডিত তার বাহিনী নিয়ে মেদিনীপুর জেলার রাধানগরের বিখ্যাত রেশম শিল্পের কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করল এবং ব্যাপক আকারে ধ্বংসলীলা ও চারিদিকে লুটতরাজ চালানো শুরু করলো। ভাস্কর পন্ডিতের সৈন্যদের একটি দল কটকের ঘাটে গাড়লো। আলীবর্দী খান এবারও কটক দখল করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিল।১৭৪৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে নবাব রাজধানীতে বিজয়ের বেশে ফিরলেন। কিন্তু মারাঠারা সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না।
১৭৪৩ শালীর দিকে ছাত্রপতি শাহুজি ভোঁসলেকে স্বয়ং মুঘল সম্রাট বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা থেকে কর আদায়ের অনুমতি পত্র দিয়েছিলেন। সাহুজি ভোঁসলে তাই নাগপুরের রাজা রঘুজি ভোঁসলে কে অনুমতি দেন ভাস্কর পণ্ডিতকে নিয়ে কাটোয়ায় উপস্থিত হতে।তবে মুঘল সম্রাট পরবর্তীতে বাংলায় লুটতরাজ বন্ধের জন্য আহ্বান জানালে সাহাজি ভোঁসলে এতে রাজি হন। তিনি নবাব আলীবর্দী খানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং আলীবর্দী খান বাৎসরিক গড় ছাড়াও বেশ সাহুজি ভোঁসলে কে ২২ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হন। তখনকার মুদ্রামান অনুযায়ি এ মুল্য আজকের দিনে হাজার হাজার কোটি টাকা কেও ছাড়ায়। বিনিময় সাহুজি ভোঁসলে রাগজে ভোঁসলে ও ভাস্কর পন্ডিতের লাগাম টেনে ধরার আশ্বাস দেন।কিন্তু মসনদে অধিকার কালীন অবস্থায় আলীবর্দী খানের কপালে শান্তি লেখা ছিল না।
পেশোয়া সহজে আলীবর্দী খানের সমঝোতার সংবাদ ভাস্কর পণ্ডিতকে অনুবাদ করে তুলে।কয়েক মাস পর ভাস্কর পন্ডিত উড়িষ্যা ও মেদিনীপুর পথে এসে বাংলায় পুনরায় আক্রমণ করলেন। এবার আলীবর্দী খান ও ভাস্কর পন্ডিতের অকস্মাত্ আক্রমণে প্রমাদ বলতে শুরু করলেন।ক্রমাগত যুদ্ধ এবং অন্যান্য খরচে তারা আজ প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে গেছিল এবং জনগণের জীবন ও বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। মারাঠা শক্তির সাথে যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতীত এর কোনো সুরাহা ছিল না কিন্তু আলীবর্দী খানের কাছে যুদ্ধ করার মতো আর্থিক মানসিক ও জনগণের শক্তি তখন বিদ্যমান ছিল না।এমন সময় সেনাবাহিনীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তির গোলাম মোস্তফা খান এগিয়ে আসলেন।তিনি নবাবকে পরামর্শ দিলেন সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে ভাস্কর পণ্ডিতকে সমঝোতায় বসার জন্য আহবান করা হোক। ভাস্কর পন্ডিত সমঝোতার ডাক শুনে ১৭৪৪ সালের ৩১ শে মার্চ বহরমপুরের কাছে একটা তাবুতে ২১ জন সহযোদ্ধা নিয়ে উপস্থিত হলেন।আড়ালে আলীবর্দী খানের গুপ্তঘাতক এরা অতি সাবধানে ২০ জন কে গোপনে হত্যা করল। শুধু রাঘুজি গাওয়োকার নামক একজন ব্যক্তির পালিয়ে বাঁচলো।গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে মারাঠা বাহিনীর ক্রমাগত বাংলায় আক্রমণ বন্ধ হল। মারাঠা বাহিনী যেমন দুর্ধর্ষ ছিল এমন নির্মম ছিল। পথে গ্রামকে গ্রাম শহরকে শহর ধ্বংস করা নির্বিচারে হত্যা এবং লুটতরাজ তাদের মূল নীতি ছিল।
আলীবর্দী খান মারাঠাদের ধ্বংসযজ্ঞের হাতের থেকে বাংলা কে বাঁচানোর জন্য শত চেষ্টা করে গেছেন। পরবর্তীতে সোজা পথে ব্যর্থ হলে গুপ্ত নীতির মাধ্যমে বাংলা কে মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে চিরতরে মুক্ত করেন। ১৭৫৬ সালে আলিবর্দী খান মৃত্যুর আগে বাংলার আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু বিপর্যস্ত বাংলা কে সম্পূর্ণ সুস্থ করতে পারেন নি। পরবর্তীতে তার উত্তরসূরী সিরাজঊদ্দৌলা নবাবী গ্ৰহন করলে ১ বছরের মাথায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশ হাতে পরাজিত হয়।পূরো বাংলা আবারো ব্রিটিশ আত্মসাৎ করার জন্য পূনরায় উন্মুক্ত হয়। যা চলতে থাকে প্রায় ২০০ বছর।
পরিশেষে এতটুকু বলতে পারি, বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তি কর্তৃক আক্রান্ত ও যেমন হয়েছে এ বাংলা ,তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাঠা দের দারাও। মারাঠা দের দারায় বাংলাতে আক্রমণ ও লুটের ধারাবাহিকতা শুরু হয় পরে তা ব্রিটিশ দের নবনিযুক্ত শোষণ এর মাধ্যমে শেষ হয়।