অবশেষে হর্ষবর্ধনের রাজসভা থেকে বিদায় নিলেন চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং। এবার বাড়ি ফেরার পালা। চীনা সম্রাটের অনুমতি ছাড়াই পায়ে হেঁটে ভারতবর্ষে এসেছিলেন তিনি। সে তো প্রায় ১৬-১৭ বছর আগের কথা। বৌদ্ধ ধর্মের পরিপূর্ণ দীক্ষা লাভ ও জ্ঞান অর্জনই ছিলো তার মুখ্য উদ্দেশ্য। বইভর্তি একটি ঝুড়ি পিঠে ঝুলিয়ে এবার তিনি রওয়ানা হয়েছেন চীনে ফিরে যাবার জন্য। সাথে রয়েছেন দুইজন আখ চাষে বিশেষজ্ঞ কৃষক। চীনে চিনির উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়তার জন্য তিনি তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন চীনের সম্রাটের কাছে।

বহু চরাই-উৎরাই পেরিয়ে হিউয়েন সাং যখন চীনে পৌঁছুলেন, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। এই চীনকে তো তিনি রেখে যান নি। এতো সমৃদ্ধি! এতো প্রাচুর্য! একটি বাজারের ওপর দিয়ে হাঁটছেন তিনি। এখানে রয়েছে দুই ধরনের বাজার ব্যবস্থা –একটি সম্রাট ও তার আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এবং অপরটি সাধারণ মানুষদের জন্য। কি নেই সেখানে! তিনরঙা পুতুল থেকে শুরু করে হরেক রকম ভারতীয় মশলা –সবই আছে থরে থরে সাজানো। অলঙ্কারের কিঙ্কন তুলে ঠিক সে সময়েই পাশ দিয়ে চলে গেলো বিশাল এক আরবীয় সাংস্কৃতিক দল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সিল্ক রোড ধরে এরা এসেছেন চীনা সম্রাটকে বৈচিত্র্যপূর্ণ নাচ ও গান উপহার দেবার জন্য। হতবাক হিউয়েন সাং একজনের মাধ্যমে জানতে পারলেন চীনে একটি সোনালি যুগের সূচনা হয়েছে। আর এই অভূতপূর্ব সোনালি যুগের সূচনাকারীরা হলেন চীনের তাং রাজবংশ।

হিউয়েন সাঙের একটি পোর্ট্রেট

হান যুগের পতনের পর চীনের উন্নয়নের পথেও মরিচা ধরে গিয়েছিলো। চীনের জনগণ প্রথম বার স্বর্ণ যুগের দেখা হানদের সময়েই পেয়েছিলো। এর পর আরও চার-পাঁচটি সাম্রাজ্যের যুগ পেরিয়েছে। কিন্তু সমৃদ্ধির সেই সুবর্ণ অধ্যায় আর কেউ ফিরিয়ে আনতে পারে নি। অবশেষে তা ফিরিয়ে এনেছে তাং রাজবংশ। স্বল্পস্থায়ী সুই রাজবংশের পর চীনের সিংহাসনে আসীন হয়েছেন তাং-রা। তবে সুইদের গড়ে তোলা প্রশাসনিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় আইন সমস্ত কিছুর ভিত্তিতেই তাং-রা তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছিলেন এবং সুইদের তৈরী গ্র্যান্ড ক্যানেল তাদের বাণিজ্যিক প্রসারের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে সহায়ক হয়েছিলো। এই গ্র্যান্ড ক্যানেলটি তাং যুগে চীনের সমৃদ্ধির প্রধান চাবিকাঠি ছিলো।

তাং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সম্রাট হলেন লি ইউয়ান, যিনি সম্রাট গাওজু নামে পরিচিত হন। তাং সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর ছিলো ক্যান্টন এবং চাংআন। চাংআন ছিলো তাং-দের রাজধানী ও সে সময়ের সবচেয়ে জনবহুল শহর। বর্তমানে শহরটির নাম জিয়ান।

হিউয়েন সাং যেমনটি প্রত্যক্ষ করলেন, ঠিক এভাবেই নিজেদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবার জন্য তাং রাজবংশীয়রা বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে সংগীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। তারা নিজেরাও বা কম কিসে! জানা যায়, নিখুঁত দেহবল্লরীর অধিকারী তাং-রা নৃত্যে এতোই দক্ষ ছিলেন যে, নাচের সময় তাদের পা দেখাই যেতো না, মনে হতো যেনো শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন।

তাং রাজবংশের সম্রাট তাইজং

কাব্য রচনার ক্ষেত্রেও তাং-দের সময়কে একটি স্বর্ণযুগ বললে ভুল হবে না। কবিতা চর্চা, নাচ, গান ইত্যাদি সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো তাং সম্রাটদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, এগুলোর জন্য সেই আমলে একাডেমীও চালু ছিলো। সংগীতচর্চার জন্য ভারতবর্ষের বাদ্যযন্ত্র মন্দিরা, পারস্যের বাদ্যযন্ত্র লিউটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য ইনস্ট্রুমেন্টস আনানো হয়েছিলো চীনে।

আবারও ফিরে যাই হিউয়েন সাং এর প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যে। বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া মুগ্ধ হিউয়েন সাং আরেকটু এগিয়েই দেখতে পেলেন ঝুড়ির মধ্যে রাখা টলটলে পিচ ফল। সমরকন্দ থেকে এসেছে সেগুলো। আরও আছে ভারতবর্ষ থেকে আসা মশলা ও কার্ডিনাল আলু, কোরিয়া থেকে আসা জিনসেং, সাউথ-ইস্ট থেকে আসা আম এবং না জানি আরো কতো কিছু। অবাক হন তিনি আঙ্গুর থেকে তৈরী ওয়াইনের বোতল দেখে। চীনের অধিবাসীরা তো এক সময় ভাত থেকে তৈরী ওয়াইন দিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো। আর আজ এতো মূল্যবান ওয়াইন খাচ্ছে তারা! ভেবে অভিভূত হলেন হিউয়েন সাং।

স্বদেশ এক নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে প্রায় দেড় যুগ পর ফিরে আসা হিউয়েন সাং এর কাছে। যে দেশ তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তার কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। এই কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে তাং সম্রাটদেরকেই দিতে হয়। তারাই তো চীনকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন।

তাং-রা খুব দ্রুত অপর সংস্কৃতিকে আত্তীকরণ করে নিতেন। তুর্কি এবং ইরানী ফ্যাশনে তারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। জানা যায়, দ্বিতীয় ও শ্রেষ্ঠ তাং সম্রাট তাইজং এর ছিলো বিশেষ তুর্কিপ্রীতি। তুর্কি সংস্কৃতি তার ভীষণ পছন্দনীয় ছিলো।

তাং সাম্রাজ্যের নারীদের ফ্যাশন

অনেক চীনা নারীই মধ্যপ্রাচ্যের টুপিগুলোকে নিজেদের করে গ্রহণ করে নিয়েছেন। যেমন, ওয়েইমাও বা মিলি হ্যাট। কাঁধ পর্যন্ত ঝুলন্ত ট্রান্সপারেন্ট ঘোমটাযুক্ত এই টুপিগুলো তাং-দের সময়ের নারীদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলো। মিলি টুপি পরিহিত মেয়েরা সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। হিউয়েন সাং এর সামনে দিয়েও মিলি টুপি পরে কয়েকজন তরুণী হেঁটে গেলেন, আর তিনি তা অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন।

তাং সাম্রাজ্যের নারীদের ফ্যাশনে সবচেয়ে বেশি ছিলো পারস্যের প্রভাব। ক্লিপ দিয়ে আটকানো টাইট-ফিটিং জামা, স্কার্ফ ও প্রসাধন ব্যবহারের সর্বত্রই ছিলো পারস্যের ছাপ স্পষ্ট। সম্রাটের প্রাসাদেও এর ব্যতিক্রম ছিলো না।

শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম, ফ্যাশন -সব ক্ষেত্রেই তাং সাম্রাজ্য ছিলো উদার মানসিকতাসম্পন্ন। বৈচিত্র্যকে সব সময় স্বাগত জানাতেন তারা। ইসলাম, জরাথ্রুস্টবাদ, খ্রিস্টান প্রভৃতি সকল ধর্মের মানুষ ও সকল জাতিগোষ্ঠীর এক অসাধারণ সহাবস্থান ঘটেছিলো তাং যুগে। বিশেষ করে চীনের সাথে আরবীয় বণিকদের ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে চীনে ইসলাম ধর্মের অনুপ্রবেশের ঘটনা চীনের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পারস্যে মুসলমানদের আগমনের সময়টাতেও পারস্যের রাজপুত্রদেরকে ও জরাথ্রুস্টবাদীদেরকে তাং-রাই আশ্রয় দিয়েছিলেন।

বুদ্ধ, সম্ভবত অমিতাভ – তাং সাম্রাজ্য

প্রথম দিকে তুরস্ক ও চীনের সম্পর্ক বেশ বৈরী ছিলো। কিন্তু তাং-রা তাদেরকে পরাজিত করেন এবং এর মাধ্যমে সিল্ক রোডের বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়। তাং যুগে এই সিল্ক রোড এক অভাবনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করে।

৭৪২ সালের মধ্যে শুধুমাত্র ক্যান্টনেই প্রায় দুই লক্ষ বিদেশীর বসবাস ছিলো। তাং সম্রাটরা মনে করতেন, সংস্কৃতির এই সহাবস্থান বা মিলন শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রেই নয়, রাষ্ট্রের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রেও অত্যাবশ্যকীয়। তাং-দের সফলতার মূলমন্ত্রই ছিলো এটি। ভিন্ন জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম –এসব কখনোই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের নির্ণায়ক ছিলো না। যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন যে কোন ব্যক্তিরই ছিলো বাণিজ্য, সেনাবাহিনী, এমনকি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লাভের অধিকার।

তাং সম্রাটরা গোঁড়া তো ছিলেনই না, ধর্মচর্চায় কাউকে কখনো বাধাও দিতেন না। চার্চ বা মন্দির নির্মাণেও কোনো বাধা ছিলো না। তাং-দের এমন অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সত্যিই বিরল ছিলো। তবে এ কথাও সত্যি, ভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে উদারমনা হলেও নিজেরা কিন্তু কখনোই অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন নি।

তাং রাজবংশ

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতো অসাম্প্রদায়িক মনোভাব থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাং সম্রাটদের খুবই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিলো। সিংহাসনের ওপর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব অপসারণে সচেষ্ট ছিলেন তারা। অন্যান্য যে কোনো ধর্মকে বৌদ্ধ ধর্মের আগে প্রাধান্য দেয়া হতো। বিশেষ করে সম্রাট তাইজং এই ব্যাপারে খুবই কঠিন ছিলেন। তবে হিউয়েন সাং ভারতবর্ষ থেকে আসার পর অবশ্য সম্রাট তাইজং তাকে সাদর অভিনন্দন জানিয়ে গ্রহণ করেছেন, কেননা তিনি বহু বছর পর জ্ঞান অর্জন করে দেশে ফেরা একজন খ্যাতিমান বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন।

তাং সম্রাটেরা কনফুসীয় নীতি ও যুক্তিবাদের মাধ্যমে একটি তাং কোডের গোড়াপত্তন করেন, যে কোডের বদৌলতে অপরাধে শাস্তির কঠোরতা কমিয়ে ফেলা হয়। কেবলমাত্র খুবই মারাত্মক অল্প সংখ্যক কিছু অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের শাস্তি বহাল রাখা হয়। সবার জন্য আইন সহজকরণের এই বিষয়টি তাং যুগে সাধারণ মানুষের জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক ছিলো।

লুশান বিদ্রোহ সংঘটিত হবার পর থেকে তাং সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে এবং অন্তঃর্দ্বন্দ্ব, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে অবশেষে পতন ঘটে চীনের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অধ্যায়ের।

তাং সম্রাটদের গড়ে তোলা রাষ্ট্রতন্ত্র ও প্রশাসনিক সংস্কার চীনে প্রায় ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিলো। প্রায় ৩০০ বছরের তাং শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আধুনিকায়ন, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রসার, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, আবিষ্কার, শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি প্রায় সব ক্ষেত্রে চীন ছিলো শীর্ষস্থানে এবং এই সমৃদ্ধি চীনের ভবিষ্যতকেও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

 

রেফারেন্স: