১। সিরাজ বাঙালি কী না বিতর্কে মশগুল দুই মেরুর তাত্ত্বিক। জাতিরাষ্ট্র ধারণাটাই ইংরেজদের বলা ভাল ইওরোপের দেওয়া। এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্মের সমন্বয়ে যে জাতীয়তাবাদী ভূখণ্ড তৈরি হয়, সেই তত্ত্ব ব্রিটিশ আমলের আগের নয়। ব্রিটিশেরা শিখিয়েছে, এক জাতি, এক ভাষা হওয়াটাই চরম প্রগতিশীলতার লক্ষ্মণ। এই তত্ত্ব অবলম্বন করে সমসত্ত্ব অখণ্ড দেশ নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়ার ধারণাটাই হাস্যকর নয় চরম অনৈতিহাসিক।
২। যদিও সুলতানি আমলে বাঙ্গালা শব্দের উদ্ভব, একদেহী যে ব্রিটিশ বাংলা আমরা ৭০ বছর আগে চিনতাম, সেটা কয়েকশ বছরের। মুঘল আমলে বাংলা সুবা তৈরি হলেও ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র বহুকাল ধরে বজায় ছিল। ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্রবাদ, তাদের এককেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা, তার দখলদারি প্রশাসন, সমাজের, ব্যক্তির, গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্রে দখলদারি করে সেই টুকরো টুকরো হয়ে থাকা এলাকাগুলোকে এক করে সমসত্ত্ব বাংলা নামক দেশ, বাংলা নামক ভাষার ধারণা তৈরি করে, কোলাবরেটর তৈরি করে একটা পরিবেশ নিশ্চিত করে যায়, তারা চলে যাওয়ার পরও লুঠের রাজত্ব শেষ হবে না – সম্পদ পাচার চলতেই থাকবে, তারা চলে গেলে এককেন্দ্রিক বাংলার ধারণার রাজত্ব শেষ হবে না, কেউ না কেউ কখোনো না কখোনো সেই ধারণাটাকে তুলে নিয়ে এসে প্রকারান্তরে এককেন্দ্রিকতাই মোক্ষ এই ধারণাটা ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
৩। সেই এককেন্দ্রিক ভৌগোলিক এলাকায় যে ভাষা, তার প্রমিতিকরণও ব্রি্টিশ আমলের দান। ব্রিটিশ আমলের আগে মৌখিক কৃষ্টির তুলনায় দরবারি লেখ্য সংস্কৃতিরর অংশিদারি ছিল ন্যুন বললেও কম বলা হয়। দরবারি রামপ্রসাদ বা ভারতচন্দ্র যে ভাষায় গান বা কাব্য রচনা করছেন, আজকের ভাষায় লিখছেন বললাম না, কারন তারা যতটা না লিখতেন তার থেকে বেশি রচনা করতেন, কারণ লেখাটাই পবিত্র, এই ধারণাটাই ভদ্রবিত্তিয় – ঔপনিবেশিক, কৃষ্টি কিন্তু ভদ্রবিত্তিয়কেন্দ্রিক ছিল না। যাই হোক, রামপ্রসাদ যে ভাষায় ভাষ্য রচনা করছেন, যাকে আজকে আপনারা সগৌরবে বাংলা বলছেন, সেই ভাষায় আলাওল রচনা করছেন না, অথচ দুজনেই দরবারি সংস্কৃতির মানুষ। অথচ দুজনের রচনাকেই আজ বাংলা বলা হচ্ছে।
৪। মৌখিক কৃষ্টিই আদতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে উজ্জীবিত রাখত, এবং আজও রাখে, দরবারি লেখাও মূলত মৌখিক কৃষ্টির অংশ হয়ে যেত, আজও বাংলা নামে যে ভৌগোলিক অঞ্চলটাকে দেখি সেখানে দুদশটা গ্রামে ভাষা পালাটে যায় – কেন্দ্রিভূত বাংলা ভাষা বলে আজও কিছু নেই, দরবারি সুনীল, শীর্ষেন্দু, জসিমুদ্দিন, আহমদ ছফার বাংলা সত্ত্বেও। ব্রিটিশের আগে বাংলা জুড়ে যে গীত, আপনারা তাদের লোক নাটক গীতিকা ইত্যাদি ভাষায় দেগে দিয়েছেন, লেখার সময় ভাষা বলার আঙ্গিক ব্যাপকভাবে পাল্টে লেখ্য সংস্কৃতির অংশের সঙ্গে মানিয়ে সমসত্ত্বতার ধারণা তৈরি করেছেন, শোনা যায় ঠাকুমার ঝুলির প্রথম সংস্করণের ভাষা কলকাতা ঢাকার বাবুরা বুঝতে না পারায় তাকে নতুন করে লেখা হয়, তার ভাষা প্রত্যেক অঞ্চলে আলাদা, আপনি তাকে আপনার রাজনীতিতে বাংলা বলছেন, বলুন, কিন্তু সেটি শ্রাব্যত আলাদা। ফলে আজকের বাংলাদেশে যেগুলোকে ব্রিটিশ ব্যালাডের অনুকরণে গীতিকা বলা হচ্ছে, সেগুলির ভাষা এলাকা এলাকায় যথেষ্ট আলাদা, শিখা মাহিতি যে ভাষায় রচনা করেছেন, লীলা-কঙ্ক, বা মলুয়া বা মাধব-মালঞ্চি সেই ভাষায় গীত হয় না, কারণ সব এলাকার ভাষা আলাদা। কলকাতা বা ঢাকার ভাষাই প্রমিত এটাই কৃষ্টির চূড়ান্ত, এটাই বাংলা, এই নিদান ইওরোরোপিয়, এককেন্দ্রিক।
৫। অকেন্দ্রিভূত ভিন্নতার যে ভৌগোলিক এলাকা ছিল বহুকাল ধরে, যার একক গ্রাম, প্রতি গ্রামঅঞ্চলের কৃ্ষ্টি আলাদা ছিল এবং এগুলিকে সমসত্ত্ব বাংলা ভাষা অঞ্চল বলে ডাকার ধারণাটাই তৈরি হয় নি, কারণ মোগল বা নবাব কৃষ্টি চাপাতে পারে নি, কারণ রাষ্ট্র ভাষা বা কৃষ্টি চাপাবার ইচ্ছে বা দক্ষতা বা কৃষ্টি চাপাবার ধারণাটাই ছিল না।
৬। ব্রিটিশকে এটা তৈরি করতে হল কারণ রাষ্ট্র শুধু শাসনই করে না, পলাশি পরবর্তী সময়ে যে যেহেতু ব্যবসা নামক লুঠ করছে, তাকে লুঠটা বাড়াবার জন্যে সমসত্ত্বতার ধারণা তৈরি করতে হচ্ছে যে রোগের উপসর্গ হল বাংলা জোড়া নবজাগরণ নামক একটা ছোটলোকফোবিক, ইসলামোফোবিক বৈচিত্রফোবিক জাতিরাষ্ট্রবাদ। সে তার সংস্কৃতি চাপাবার কাজ করে কারণ তার মধ্যে দিয়ে সে লুঠটাকে জায়েজ এবং প্রগতিশীল দেখাতে পারে, কোলাবরেটরেদের একই লুঠেরা সংস্কৃতিতে শিক্ষা দিতে পারে।
৭। আপনি বাম, ডান, মধ্য যাই হোন না কেন, আপনি সেই নবজাগরণী উপসর্গ আজও নিজের দেহে, মনে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন। আপনি ইওরোপিয় সমসত্ত্বতার ধারণায় নিষিক্ত, আপনি শাসক হয়েছেন, আপনার মনে অবিভক্ত বাংলা নামক দেশ, অবিভাজ্য বাংলা ভাষা নামক একটা বোলি নিষিক্ত হয়ে আছে, কারণ আপনি চট্টগ্রামে যে ভাষা চান, সেই ভাষা পুরুলিয়াতেও দেখতে চান, তাতে লুঠ চালানোর, আপনার কেন্দ্রিভূত ধারণা, আপনার ঔপনিবেশিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ আসে, আপনার কৃষ্টির বাইরে যা কিছু গ্রামীন তাকে লোকসংস্কৃতি দেগে দিয়ে আপনার ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিয়ে বিকেন্দ্রিত কৃষ্টিকে মেরে ফেলার সুযোগ করে নেন।
৮। শশাঙ্ক, গোপাল, সুলতানি, মুঘল, নবাবি আমলের শাসকেরা ছিল গোষ্ঠীপতি। যৌথ পরিবারের প্রধান হিসেবে তাদের কাজ ছিল সেই সমবয়িক বৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চলকে সুরক্ষা দেওয়া, ব্যবসা বিকাশে সহায়তা করা, যেটা তারা করে এসেছেন ১৭৫৭ অবদি। তার কৃষ্টি, ভাষা, আইন ইত্যাদি কোনওটাই বৃহত্তর সমাজের ওপর চাপিয়ে দিতে চান নি।
৯। সার সত্যটা বুঝতেন এই ভৌগোলিক এলাকার জনগণও খুব ভাল ভাবে। যে জন্যে তারা পলাশীর ৫ বছর পর লুঠের রাজত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাস্তায় নেমে আসেন, যে জন্যে যত কারিগরি উদ্ভাবন শাঁখের করাত থেকে মসলিন ব্যবস্থা, তার বিকাশ হয় পলাশীর আগে। কারিগরি উতপাদন ব্যবস্থার চূড়ান্ত দেখি পলাশীর আগে, এতই চূড়ান্ত ব্যবস্থায় পৌঁছে যায় যে কয়েকো হাজার বছর ধরে এই ভৌগোলিক এলাকায় দামি ধাতু দিয়েই ব্যবসা করতে হয়েছে। বাংলাকে সোনার বাংলা বানিয়েছে এই বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থা।
১০। শশাঙ্ক থেকে সিরাজ এই বিকেন্দ্রিভূত ব্যবস্থাকে ধারণ করে এছেন। তাঁরা আজ নমস্য এই কারণেই। অন্য সব বিতর্ক ঔপনিবেশিক উচ্ছিষ্ট।