গোধূলির ক্রান্তিলগ্নে রক্তিম আভায় সারা পৃথিবী যেন রক্তাক্ত হয়ে আছে। মগধ রাজ্যের রাজধানী রাজগৃহের সুবিশাল প্রাসাদের রাজ-বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেল মগধ ও অঙ্গ রাজ্যের প্রতাপশালী রাজা অজাতশত্রুর। নিজ ইচ্ছায় যেদিন স্বীয় পিতাকে বন্দিশালায় বন্দি করে নিজেকে হর্যঙ্ক বংশের একচ্ছত্র অধিপতি ঘোষণা করলেন। ঠিক তখনই খবর এলো প্রয়াত পিতা রাজা বিম্বিসারের প্রিয় গুরু ও বন্ধু মহামুনি গৌতম বুদ্ধ আগামীকালই রাজগৃহে আসছেন। কীভাবে তিনি বুদ্ধকে বলবেন যে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিজ পুত্রের হাতেই মারা গেছেন? মহাজ্ঞানী হিতৈষী বুদ্ধ কি তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের পথ দেখাবেন নাকি সিংহাসনের প্রতি অন্ধ লালসাকেই দায়ী করবেন?
পিতৃহত্যার অনুশোচনায় দগ্ধ মগধের তরুণ রাজার ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই প্রশ্নগুলো। কিন্তু কে এই রাজা বিম্বিসার, কেনইবা নিজ পুত্র প্রাণ নিলো মহামুনি গৌতমের এই প্রিয় শিষ্যের- চলুন তবে ঘুরে আসি প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের উপমহাদেশের ইতিহাসে একেবারে প্রথম দিকের সবচেয়ে শক্তিশালী আর সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য মগধ থেকে।
“অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে।” কবি জীবনানন্দ দাশের কালজয়ী এই কবিতার রাজা অশোককে কমবেশি আমরা সবাই জানি। কিন্তু রাজা অশোকেরও প্রায় তিনশত বছর আগে শক্তিশালী সাম্রাজ্য মগধের সূচনা হয়েছিল মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণকারী রাজা বিম্বিসারের হাত ধরে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৮ অব্দে সামন্ত রাজা ভট্টিয় বা মহাপদ্ম এবং রানি বিম্বের ঘরে জন্ম হয় তাঁর। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৩ থেকে ৪৯২ অব্দ পর্যন্ত প্রায় ৫১ বছর শাসন করেছিলেন তিনি। যদিও সেসময় ভারতবর্ষে ১৬টি মহাজনপদ ছিল, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান রাজ্য ছিল মগধ। বর্তমানকালের ভারতের বিহার রাজ্যই ছিল মগধ রাজ্য।
এই রাজ্যের মাটি উর্বর ছিল এবং প্রচুর ফসল হতো। এ রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে হিরণ্যবতী বা সোন নদী।
সোন নদী বর্তমান
বিম্বিসার ছিলেন মগধ রাজ্যের হর্য্যঙ্ক বংশের খ্যাতিমান নৃপতি। তাঁর নামের সাথে ‘সেনিয়’ বা ‘শ্রেণিক’ বিশেষণ যুক্ত হয়ে তিনি ‘মগধরাজ শ্রেণিক বিম্বিসার’ নামে খ্যাত ছিলেন। বিম্বিসারের রাজত্বকাল থেকেই মগধের অগ্রগতির ইতিহাস। অঙ্গ রাজ্যের রাজা ব্রহ্মদত্ত একদা বিম্বিসারের পিতা রাজা মহাপদ্মকে পরাজিত করেছিলেন। রাজা হয়ে বিম্বিসার রাজা ব্রহ্মদত্তকে পরাজিত করে অঙ্গ রাজ্য দখল করে নেন। তার পর থেকে মগধ রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। যুদ্ধবিদ্যায় তাঁর সৈন্যবাহিনী খুব পারদর্শী ছিল। যুদ্ধে তিনি হাতি ব্যবহার করতেন। ফলে তিনি সহজেই যুদ্ধে জয়লাভ করতেন। তাঁর রাজ্যসীমা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জানা যায়, তাঁর রাজ্যে আশি হাজার শহর ছিল। শহরগুলোর মধ্যে তিনি সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত কৌশলী ও বিচক্ষণ রাজা। রাজ্য বিস্তারে তিনি বিভিন্ন রাজ্যের রাজকুমারী ও অভিজাত নারীদের সাথে বিবাহের মাধ্যমে রাজ্যগুলির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়েছিলেন। তিনি কোশল রাজ মহাকোশলের কন্যা কোশল দেবীকে বিবাহ করলে দুই রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান ঘটে। বিবাহের যৌতুক হিসেবে বিম্বিসার কাশীর অধিকার লাভ করেন। বিম্বিসার বৈশালীর লিচ্ছবি মহাজনপদের প্রধান চেতকের কন্যা চেল্লনাকে বিবাহ করেন। যাঁর গর্ভে জন্ম হয় পরবর্তী রাজা অজাতশত্রুর। বিম্বিসারের তৃতীয়া পত্নী ক্ষেমা ছিলেন মদ্র দেশের রাজকন্যা।
ইতাহেসর পাতা থেকে উঠে আসা নালন্দা
রাজা বিম্বিসার প্রাচীন রাজগৃহ নগরী নির্মাণ করেছিলেন। রাজগৃহ পাঁচটি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ছিল। তাঁর রাজপ্রাসাদের চারদিক পাথরের প্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল। রাজগৃহে বুদ্ধ অনেকদিন বসবাস করেছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক ধর্মোপদেশ দান করেছিলেন। এখানে প্রথম ত্রিপিটক সংকলিত হয়েছিল। এ নগরীর ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। রাজগৃহের নিকটেই অবস্থিত ছিল নালন্দা।
চিত্রাঙ্কন অজতাশত্রু
রাজা বিম্বিসার সুশাসক ও ন্যায়বিচারক ছিলেন। সর্বদা প্রজাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। বিম্বিসারের জীবতকালেই তাঁর পুত্র অজাতশত্রু রাজা হন। পরে বুদ্ধের দূরসম্পর্কীয় ভাই দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু পিতৃবিরোধী হয়ে ওঠেন। একসময় পিতাকে কারারুদ্ধ করেন। তারপর তাকে হত্যা করা হয় নাকি কারাগারেই স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন, তা নিয়ে অবশ্য সংশয় রয়েছে।
রাজা বিম্বিসার একজন শান্তিপ্রিয় রাজা ও উত্তম সংগঠক ছিলেন। পার্শ্ববর্তী অন্য রাজারাও তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় তৎপর ছিলেন। অবন্তীরাজ প্রদৌতের চিকিৎসার জন্য তিনি তদানীন্তন ভারতবর্ষের খ্যাতিমান চিকিৎসক জীবককে প্রেরণ করেছিলেন।
তাঁর রাজ্যে জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম উভয়েই সমসাময়িককালে বিকাশ লাভ করে। রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও জৈনধর্মসহ সে সময়ে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তিনি নিয়মিত গ্রাম পরিদর্শন,রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।
বুদ্ধত্ব লাভের আগেই রাজা বিম্বিসারের সাথে গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ হয়। বুদ্ধ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বোধিজ্ঞান লাভের জন্য উপযুক্ত গুরুর সন্ধান করছিলেন। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে প্রথমে তিনি অনুপ্রিয় নামক আমবাগানে পৌঁছান। সেখানে তিনি মস্তক মুণ্ডন করেন। তারপর কাষায় বস্ত্র পরিধান করে সন্ন্যাস ব্রত ধারণ করেন। এ সময় তিনি ভিক্ষান্নে জীবন ধারণের সিদ্ধান্ত নেন। পায়ে হেঁটে তিনি এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য যেতেন। এভাবে তিনি বৈশালী থেকে রাজগৃহে পোঁছান। উপযুক্ত গুরুর সন্ধান ও ভিক্ষান্ন সংগ্রহই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
সৌম্য-শান্ত অপূর্ব সুন্দর এক যুবক ভিক্ষা করছেন। রাজগৃহের নগররক্ষীরা তাঁকে দেখে অবাক হন। এ খবর তারা পৌঁছে দেন রাজা বিম্বিসারের কাছে। রাজপ্রাসাদ থেকেই রাজা বিম্বিসার তাঁকে দেখতে পান। রাজা নিজে এসে তাঁর সাথে দেখা করে ভিক্ষা করার কারণ জানতে চাইলেন। রাজা তাঁকে এই কঠিন ব্রত ছেড়ে রাজসুখ ভোগ করার আহ্বান জানান। সেনাপতির পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। তখন বুদ্ধ রাজা বিম্বিসারকে বলেন, ‘মহারাজ! আমি সুখপ্রার্থী নই। আমি কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদনের পুত্র। বুদ্ধত্ব লাভের আশায় আমি সবকিছু ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছি।’ রাজা বলেন, ‘বৎস! আপনার পিতা আমার পরম মিত্র। আপনার উদ্দেশ্য জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি। যদি আপনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন আমাকে একবার দর্শন দেবেন। আমি আপনার সেবা করব, আপনাকে বন্দনা করব।’ রাজা বিম্বিসারের কথায় সিদ্ধার্থ(বুদ্ধ) সম্মতি প্রদান করে সেখান থেকে বের হয়ে যান।
রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে বুদ্ধের আবার দেখা হয় বুদ্ধত্ব লাভের পর। তখন বুদ্ধ রাজগৃহের লট্ ঠি বন উদ্যানে বসবাস করছিলেন। তার দুই বছর আগেই তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
লোকমুখে তাঁর যশ-খ্যাতির কথা শুনে রাজা বিম্বিসার তাঁর সাথে দেখা করেন। বিম্বিসার ভগবান বুদ্ধের কাছে নতুন ধর্মের বাণী শোনার প্রার্থনা করেন। বুদ্ধ তাঁকে দান, শীল ও স্বার্গ সম্বন্ধে সরলভাবে ধর্মোপদেশ দান করেন। তারপর, চতুরার্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে উপদেশ দেন।
রাজা বিম্বিসার বুদ্ধের বাণী ও উপদেশ শুনে মুদ্ধ হন। তিনি বুদ্ধের গৃহী শিষ্য বা উপাসক হন। এ সময় রাজা বিম্বিসারের বয়স হয়েছিল ঊনত্রিশ বছর। সে সময় রাজা বিম্বিসার ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বুদ্ধকে রাজপ্রাসাদে নিমন্ত্রণ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। বুদ্ধ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রাসাদে গিয়ে রাজাকে নানা ধর্মকথা শোনান। রাজা ধর্মকথা শুনে আনন্দচিত্তে বুদ্ধকে বললেন, ‘প্রভু! ছোটকালে আমার পাঁচটি কামনা ছিল। তা আজ পূর্ণ হলো।’ কামনাগুলো হলো:
১. আমি ভবিষ্যতে রাজপদে অভিষিক্ত হব।
২. আমার রাজ্যে অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ অবতীর্ণ হবেন।
৩. আমি সেই বুদ্ধকে সেবা ও পরিচর্যা করব।
৪. সেই ভগবান বুদ্ধ আমাকে ধর্মোপদেশ দান করবেন।
৫. আমি বুদ্ধের ধর্ম উপলব্ধি করব।
তারাপর রাজা বিম্বিসার অত্যন্ত শ্রদ্ধাচিত্তে তাঁর রাজ্যে অতি মনোরম বেনুবন উদ্যান বুদ্ধ এবং তাঁর ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করেন।
বুদ্ধের উপাসক হওয়ার পর থেকে রাজা বিম্বিসার নানাভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে সহযোগিতা করতে থাকেন। তিনি ছত্রিশ বছর বুদ্ধ ও তাঁর ধর্মের সেবা করেন। তিনি মগধের অধিবাসীদের ধর্ম দেশনা করার জন্য বুদ্ধকে অনুরোধ করেন। বুদ্ধ তাঁর অনুরোধে মগধবাসীর উদ্দেশে ধর্ম দেশনা করেন। সেই সময় থেকে ভিক্ষুসঙ্ঘ কর্তৃক গৃহীদের পঞ্চশীল ও অষ্টশীল দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়।
রাজগৃহে বিম্বিসার গৌতম বুদ্ধকে স্বাগত জানাচ্ছেন
এ সময় বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের পরিব্রাজকগণ পূর্ণিমা, অষ্টমী ও অমাবস্যা তিথিতে সমবেতভাবে ধর্ম আলোচনা করতেন। সাধারণ লোকেরা তাঁদের নিকট ধর্মে দীক্ষা নিতেন। রাজা বিম্বিসার এসব লক্ষ্য করে ভিক্ষুদের উপোসথ পালন ও ধর্ম আলোচনার নির্দেশ দেন। রাজা বিম্বিসারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক বিখ্যাত জীবক বুদ্ধ ও ভিক্ষুসঙ্ঘের চিকিৎসা করতেন। তাঁদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়ে তিনি সর্বদা সচেতন থাকতেন।
ভিক্ষুরা আগে পুরাতন ও পরিত্যক্ত কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে সেলাই করে পরিধান করতেন। এতে ভিক্ষুদের অনেক রকম রোগ হতো। চিকিৎসক জীবক ভিক্ষুদের নীরোগ জীবন চিন্তা করেন এবং নতুন কাপড় পরিধানের বিধান দিয়েছিলেন। এরপর থেকে রাজা বিম্বিসারও ভিক্ষুদের নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন কাপড় দান করতেন। এভাবে রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে অবদান রাখেন।
রাজা বিম্বিসারা, বার্মিজ শিল্পে চিত্রিত, বুদ্ধকে তাঁর রাজত্ব দিয়েছিলেন।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে রাত গাঢ় হয়ে এলো। ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় বুদ্ধের পছন্দের পাহাড়ের চূড়া চকচক করতে লাগল। আর বিষণ্ণ বদনে রাজা অজাতশত্রু নিজের ঘৃণ্য কৃতকর্মের জন্য বুদ্ধের কাছে প্রায়শ্চিত্তের পথ পেলেও যে হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ তাকে ক্ষমা করবে না, তা ভেবে আকাশে তাকাতেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মাঝে যেন পিতা রাজা বিম্বিসারের মুখ দেখতে পেলেন!