ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ‘মহুয়া’ গাছের সম্পর্ক বেশ প্রাচীন। ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এও মহুয়ার ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। আমাদের আদিবাসী সম্প্রদায় এবং তাদের জীবনের সাথেও গাছটির এক অপূর্ব প্রেমময় সম্পর্ক ছিলো। সাঁওতাল ও মুন্ডা আদিবাসীদের কাছে তো এই গাছ পরম-পূজনীয়। তারা গাছটিকে ‘জীবনবৃক্ষ’ আখ্যা দিতেন। শত শত বছর ধরে তারা এই গাছের ফুল, ফল, ছাল, পাতা ও বীজকে তাদের নিত্য দিনের কাজকর্মের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন।
মহুয়া গাছ আদিবাসীদের জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তিরও সহায়ক ছিলো। আদিবাসী সম্প্রদায় নিজেরা যেমন এই গাছের ফল-ফুলকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন, তেমনি নিজেদের গবাদি পশুর খাবারের প্রয়োজনীয়তাও তারা পূরণ করতেন এর মাধ্যমে। জ্বালানি ও ওষুধ তৈরীতে মহুয়ার ফুল, ফল, পাতা, শাখা দীর্ঘদিন ধরেই ছিলো তাদের সঙ্গী। এমনকি মহুয়ার ফুলকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এক জরুরী উপাদান হিসেবে তাই বহু দিন বেঁচে ছিলো মহুয়া গাছ।
মহুয়া গাছের বিবিধ ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও আদিবাসীদের কাছে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারটি ছিলো, এর ফল থেকে তৈরী মিষ্টি সুরা জাতীয় একটি পানীয়। এই পানীয়টিও তাদের কাছে ‘মহুয়া’ নামেই পরিচিত ছিলো। প্রায় আট দিন প্রক্রিয়াজাত করে তৈরী করা হতো আদিবাসী-উৎসবের অপরিহার্য উপাদান মহুয়া পানীয়। পানীয়টির মাতাল করা তীব্র ও সুমিষ্ট গন্ধেই অর্ধেক মাতাল হয়ে যেতেন আদিবাসীরা। তাদের লোক-উৎসব, গান-গাঁথায় বার বার উচ্চারিত হয়েছে মহুয়া পানীয়ের মাদকতার কথা। তবে আজ এই পানীয়ের গল্প নয়, বরং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্রিটিশ উপনিবেশকালে সৃষ্ট বৈরিতা সম্পর্কেই গল্প করবো।
ব্রিটিশদের মতে, মহুয়া খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং এই পানীয় পানের ফলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছেন। আদিবাসীদের নৈতিকতা পুনরুদ্ধারের তথাকথিত মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮৭৮ সালে ‘বোম্বে আকবরী আইন’ এবং ১৮৯২ সালে ‘মৌরা আইন’ তৈরী করে মহুয়া তৈরীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ব্রিটিশরা। এতেই ক্ষান্ত হন নি তারা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মহুয়া ফুল তোলা বা সংরক্ষণের উপরও নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করা হয় সে সময়। আর এর ফলে ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এর ব্যবহার।
অন্য দিকে, ব্রিটিশরা ইংল্যান্ড ও জার্মানি থেকে এই উপমহাদেশে সুরা বা অ্যালকোহল আমদানি করে বাজারে তৈরী করেছিলো নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য। স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজেদের পণ্য বিক্রির এই কৌশল ব্রিটিশদের এক বিশ্রী বিশেষত্ব। বিষয়টি আসলে তাদের মজ্জাগত। কাপড়ের ব্যবসা থেকে শুরু করে এভাবে মদের ব্যবসায়ও তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে শুরু করে।
এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, মহুয়া থেকে তৈরী পানীয় নিষিদ্ধ করার পেছনে আসল কারণ হচ্ছে, সুরার বাজারে ব্রিটিশদের মদের যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও মহুয়া এক বিশাল চাহিদার আধার হিসেবে বিরাজমান ছিলো। সুরা হিসেবে ব্যবহার হওয়া ছাড়াও এর পুষ্টিগুণ ও সংস্কৃতিগত চাহিদা ব্রিটিশদের বাণিজ্যের জন্য হুমকি হতে পারে বলেই ঔপনিবেশিক কর্তাব্যক্তিরা মহুয়ার বেঁচে থাকার অধিকারকে খর্ব করে ফেলেছিলো।
তথ্য ঋণঃ ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’।