১৫৫৫তে, হুমায়ুনের মৃত্যুর ঠিক আগে উসমানিয় সাম্রাজ্যের নৌসেনাপতি সিদ্দি আলি রইস, পারস্য উপসাগরে জাহাজ দুর্ঘটনা সূত্রে দিল্লি দরবারে আসেন। তাঁকে দিল্লিতে বিপুল সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী খানইখানান বৈরাম খান ১০০০ সেনানী ৪০০ হাতির বাহিনী নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান। তাকে জায়গির দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু রইস প্রত্যাখ্যান করেন। দরবারে তিনি জানান তার সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধাবশত অবিশ্বাসী চিনা সরকার তুর্কি ব্যবসায়ীদের সুলতানের নামে খুৎবা পড়ার অনুমতি দিয়েছেন। রইস বলেন একমাত্র উসমানিয় সাম্রাজ্য প্রধান পাদশা উপাধি বহনের অধিকারী। হুমায়ুন উসমানীয় সুলতানকে খলিফা এবং উচ্চগুণান্বিত সুলতান নামে অভিহিত করে, সিদ্দির হাত দিয়ে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে আরও যোগাযোগ বাড়াবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সিদ্দি চিঠি নিয়ে দেশে ফিরে যান।
রইসের দেশে ফেরার আগেই হুমায়ুনের মৃত্যু হয়। ক্ষমতায় আসেন জালালুদ্দিন আকবর। বাবার তৈরি করা উসমানীয় সাম্রাজ্য দৌত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তার খুব একটা ছিল না। তার প্রথম চিন্তা ছিল সাম্রাজ্য বিস্তার, বাবার সময়ের আমীর এবং অন্যান্য ক্ষমতাশালীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরোনো। তিনি কান্দাহার সীমান্তে মুঘল নিয়ন্ত্রিত কেল্লাটি পারসিক সাম্রাজ্যের হাতে অর্পণ করলে সুলতান সুলেইমান আকবরের এই পদক্ষেপে মর্মাহত হন। তিনি হুমায়ুনের চিঠির উত্তরও দেন না বা সে সময়ের রীতি মেনে একটা রাজকীয় দৌত্য ফিরে আসার পর পাল্টা রাজকীয় দৌত্যও মুঘল সাম্রাজ্যে পাঠলেন না। মুঘল-উসমানিয় আঁআতের উদ্যম ঠাণ্ডাঘরে চলে গেল।
ইতিমধ্যে ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যউপসাগরে সমুদ্রে পর্তুগিজদের উপস্থিতি উসমানীয় হজ্বে যাওয়া তীর্থযাত্রীদের ওপর জুলুম অর্থ আদায় ইত্যাদি অসমানিয় সাম্রাজ্যের মাথাব্যথার কারন হয়ে ওঠে। সুমাত্রার মুসলমানেরা উসমানীয় সুলতানকে সুবিচার প্রার্থনা করে চিঠি লেখে। ১৫৬০-এ ফরমান জারি করে সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকে তৈরি রাখা হল। সুলেইমানের উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় সেলিম মিশরের প্রশাসককে চিঠি লিখে ভারতবর্ষ থেকে আসা হজ্ব যাত্রীদের নিরাপত্তাবিধানের নির্দেশ দিলেন। ভারতবর্ষ থেকে পর্তুগিজদের উচ্ছেদ করতে তিনি বদ্ধ পরিকর হন। লোহিত সাগর নিয়ন্ত্রণে সুয়েজ এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি খাল খননের নির্দেশ দিলেন। কাজটা সম্পন্ন হলে বিশ্বঅর্থনীতির মোড় অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারত। পরিকল্পনাটি নিয়ে উসমানীয় নথিপত্রে আর কোনও উচ্চবাচ্য দেখা যায় না। ১৫৬৯-এ উসমানিয়দের উদ্যোগে রুশিদের হাত থেকে তীর্থযাত্রীদের বাঁচাতে ডন-ভোলগা খালের মত সুয়েজ খালের প্রকল্পও বিশবাঁও জলে পড়ল।
১৫৬৮তে উসমানীয় নথিতে এক হিন্দুস্তানের দূতের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। দূতের নাম বা উদ্দেশ্য কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি যে আদৌ মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। মুঘল দরবারে এধরণের দূত পাঠাবার কোনও নথি পাওয়া যাচ্ছে না।
১৫৮০ থেকে আকবরের সঙ্গে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরোধ শুরু হয় হজ্ব তীর্থযাত্রীদের ইস্যুতে। মুঘল জেনানার গুলবদন বেগম, সেলিমা সুলতানা বেগম এবং আরও বহু নারী হজ্ব যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ১৫৭৫-এ অক্টোবরে শাহী মহিলারা ফতেহপুর সিক্রি ছাড়লেন। সুলতান খাজা নক্সবন্দীকে মীর হজ্ব বা হজ তীর্থ যাত্রার নেতা নিয়োগ করা হল। বাহিনী গুজরাটে পর্তুগিজ কার্তেজের জন্যে এক বছর অপেক্ষা করে ১৫৭৬-এ তুর্কি জাহাজে বাহিত হয়ে হজ্বে পৌঁছন এবং সেখানে চার বছর কাটিয়ে ১৫৮২তে মুঘল হিন্দুস্তানে ফেরেন।
কিন্তু মুঘল মহিলা এবং মুঘল বাহিনীর দীর্ঘকাল উসমানীয় রাজত্বে থাকা নিয়ে মুঘল-উসমানিয় সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে। ১৫৭৮-এ সুলতানকে মক্কা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় মুঘল মহিলা এবং তাদের সঙ্গে আসা বিশাল বাহিনী মক্কাতে অবস্থান করছে। তাদের কাজকর্ম স্থানীয়দের মাথাব্যথার কারন হয়ে উঠেছে। সুলতান মক্কার প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন হজ্ব শেষ হলে মহিলাসহ মুঘল বাহিনীটি যেন অবিলম্বে ভারতবর্ষে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়। একই নির্দেশ দেওয়া হল মদিনার প্রশাসককেও। দুবছর পরে মিশরের পাশা জানালেন ভারতের রাজা জালালুদ্দিন আকবরের পাঠানো সাদাকত দান [ভিক্ষা] হারেম শরিফে বিতরন করা হয়েছে। মুঘল মহিলারা ফেরত যান নি। তীর্থস্থানগুলোয় দানের মত অশরিয়তি (নামেশ্রু) কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। সুলতান দুই শহরের প্রশাসককে ফরমান পাঠিয়ে সেখানে হিন্দুস্তানের মহিলাদের আকবরের নামে দান দেওয়ার অশরিয়তি কাজকর্ম বন্ধ করার কড়া নির্দেশ জারি করেন এবং যততাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের ভারতবর্ষে প্রত্যার্পণেরও নির্দেশ জারি করেন। একই নির্দেশ দেওয়া হল মক্কা, মদিনা আর জেড্ডার প্রশাসকদের।
সম্রাট আকবরের দান পাঠানোকে অইসলামি দাগিয়ে দেওয়ার ভাবনাটা সে সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির টানাপোড়েন থেকে উদ্ভব ঘটেছে। আকবরের রাজত্বে ঘটে চলা নানান ঘটনায় উসমানীয় সম্রাট তীব্র ক্ষুব্ধ ছিলেন। বাদাউনি বলছেন আকবরের কিছু পদক্ষেপ বিশ্বাস এবং বিশ্বাসীকেই আঘাত করছিল। মুঘল মহিলারা যখন মক্কায় হজ্ব করছেন, সে সময় আকবর তার সাম্রাজ্যে বেশ কিছু বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেন। ভারতের সম্রাট সে সময়ের তুর্কি, উসমানীয় সাম্রাজ্যকে বিশ্ব ইসলামের ধর্মীয় নেতা হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকার করল।
১৫৭৯এ শেখ মুবারককে দিয়ে আকবর একটি নথি খসড়া করান এবং তাতে স্বাক্ষর করেন উলেমা। এই নথিতে বলা হল আকবর পাদিশাইইসলাম এবং তার সময়ের মুজতাহিদ(যিনি ইসলামের ধার্মিক আইন ব্যাখ্যা করেন)। তাঁকে শারিয়ার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়া হল। সেই বছরেই তিনি নিজের নামে খুতবা পড়লেন। একই সঙ্গে আকবর উসমানীয় সুলতানকে ইসলামি জগতের এবং উপমহাদেশের মুসলমানদের একমাত্র নেতা মানতে অস্বীকার করলেন। তিনি শাহী প্রাসাদের আশেপাশে আজান নিষদ্ধ করলেন। ‘আল্লাহু আকবর’ শব্দবন্ধটি উলেমা দ্বর্থকভাবে ব্যবহার করল। যদিও এর মানে ‘ঈশ্বর মহান/সর্বশক্তিমান’, কিন্তু এখানে ব্যাখ্যা হল, সম্রাট ‘আকবরই সর্বশক্তিমান’। ১৫৮১তে তিনি দিনইইলাহি ধর্মমতের প্রবর্তন করলেন।
ঠিক এই সময় রাষ্ট্র বিরোধী কাজের অভিযোগে মুঘল দরবার থেকে মক্কায় নির্বাসন দেওয়া সুলতান আবদুল নবি এবং মুল্লা আবদুল্লা সুলতানপুরীও আকবরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার চালাচ্ছিলেন। শেষ অবদি নানা টানাপোড়েন সহ্য করে শাহী মহিলারা ১৫৮২তে মুঘল সাম্রাজ্যের ফিরে আসেন। জেনানার মহিলাদের মক্কা-মদিনায় তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্রাটকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এর পর থেকে মক্কায় শাহী দান পাঠানো বন্ধ করা হল এবং মক্কা শরিফের সঙ্গেও সমস্ত সম্বন্ধ চ্ছিন্ন করা হয়। উসমানিয়-মুঘল সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকল।
১৫৮২তেই আকবর উসমানীয় সাম্রাজ্য্যের বিরুদ্ধে মুঘল-পর্তুগিজ অভিযানের ভাবনা ভাবতে থাকেন। সৈয়দ মুজফফর, আবদুল্লা খান এবং জেসুঈট সন্ত ফাদার মনসায়ের্ত লিসবন গেলেন দ্বিতীয় ফিলিপের সঙ্গে সম্ভাব্য আক্রমণের পরিকল্পনা করতে ১৫৮২র গ্রীষ্মে। গোয়ার রাস্তায় অভিযানে অনিচ্ছুক সৈয়দ মুজফফর পালিয়ে গেলেন দক্ষিণে। আবদুল্লা খান আর ফাদার মনসায়ের্ত গোয়ায় পৌঁছলেন। কিন্তু কোনও এক অজানা কারনে তারা আবার দরবারে ফিরে আসেন।