[আহকামইআলমগিরির রামপুর নবাবের ফার্সী হস্তলিপি হইতে অনুদিত] যদুনাথ সরকার
🔹১
মুর্শিদকুলি খান বাংলা সুবার দেওয়ান হয়ে জাহাঙ্গিরনগর, আজকের ঢাকায় পৌঁছন ১৭ নভেম্বর ১৭০০য়। মুর্শিদকুলির পদপ্রাপ্তির প্রথম সময়ের ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার কয়েকটির উল্লেখ পাওয়া যাবে সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুর্শিদকুলি খানের কাছে পাঠানো চিঠিতে। সম্রাটের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, যতটা পারা যায় রাজস্ব পাঠানোর শর্তেই আওরঙ্গজেব, মুর্শিদকুলিকে বাংলার সুবাদার করে পাঠাচ্ছেন এবং তাঁর কর্মউদ্যমের প্রতি আস্থা পেশ করে চিঠিতেই মুর্শিদকুলির প্রশাসনিক কাজকর্মের একতিয়ার তৈরি করে দিচ্ছেন।
চাকরি পাওয়ার দুতিন বছরের মধ্যে পাওয়া [এবং কালের হস্তাবলেপন থেকে রক্ষা পাওয়া ১০টি চিঠি] দক্ষিণ থেকে আওরঙ্গজেবের প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধান মুন্সি, সম্রাটের একান্ত সচিব ইনায়েতুল্লা সম্রাটের জবানি নিজের বয়ানে লিখে বাংলার দেওয়ানের কাছারিতে পাঠাচ্ছেন। দেওয়ানি দপ্তর, কাছারির প্রধান মুর্শিদকুলি, সুবাদার শাহজাদা আজিমুশ্বানের তৈরি করা বিরোধতায় নানান সমস্যার মুখোমুখি হয়ে, সম্রাটকে সব সব বাধা একটি একটি করে জানাচ্ছেন, চিঠিগুলোয় সম্রাট সে সব বিষয় সমাধানের ঈঙ্গিত দিচ্ছেন। চিঠিগুলো থেকে স্পষ্ট সম্রাট, মুর্শিদকুলিকে দেওয়ানি সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলা প্রশাসন প্রধানের নির্দেশে প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে উৎসাহিত করছেন। দেওয়ানির পক্ষ থেকে, পূর্বের মুঘল প্রশাসনের উচ্চপদী অনুগত আমলার মত সম্রাটের খাজাঞ্চিতে বাংলার বিপুল রাজস্ব পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করছেন না, সম্রাটের অভয়হস্ত মাথায় নিয়ে বাংলার দেওয়ান ক্রমশ বাংলা প্রশাসনে কাজের নিজস্ব আঙ্গিক, ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে সম্রাটের আস্থা অর্জন করতে শুরু করবেন, সেই ইঙ্গিতও চিঠিগুলির সওয়াল জবাবে এবং বিশেষ করে দেওয়ানের পাঠানো উত্তরে সম্রাট আওরঙ্গজেবের বয়ানে স্পষ্ট হয়ে যায়। চিঠিগুলির ‘আদি ফার্সী’ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন যদুনাথ সরকার প্রবাসী ভাগ ১৪, খণ্ড ২, সংখ্যা ১, কার্ত্তিক, ১৩২১এ।
‘…তখন মুর্শীদ কুলী খাঁ বাংলায় বাঙ্গালায় প্রায় সর্বেসর্বা হইলেন।। মুঘল বাদশাহদিগের ক্ষমতা হ্রাস হইবার ফলে তিনি কালক্রমে বাঙ্গালায় প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে লাগিলেন, কিন্তু কখনও দিল্লীশ্বরের ক্ষমতা অস্বীকার করেন নাই, এবং তাঁহার নিকট হইতে সাত হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের নেতৃত্ব এবং মুতমন-উল্—মূলক-আলা-উদ্-দৌলা জাফর খাঁ নাহাদুর আসাদজঙ্গ এই উপাধি ক্রয় করেন[তিনি টিকায় লিখছেন মুর্শীদ কুলী খাঁকে ‘আসদ জঙ্গ’ উপাধি আরোপ করা মুদ্রিত ফার্সী ‘মাসির’ গ্রন্থের ভুল। তাঁহার উপাধি ‘নসীরজঙ্গ’ ছিল](মাসির-উল-উমারা)।
‘…মুর্শীদ কুলী বাঙ্গালার দেওয়ানীর প্রথম অংশে আওরঙ্গজীব তাঁহাকে যে চিঠি[হাসবুলহুকুম, লেটার্স বাই অর্ডার] লেখেন তাহার কতগুলি আমার হস্তগত হইয়াছে। সম্রাটের শেষ বয়সের প্রিয় মুন্শি ইনাএতউল্লাকে দিয়া বাদশাহ যে সব চিঠি লেখান তাহার দুই সংগ্রহ আছে – একের নাম কলিমাৎ-ই-তাইবাৎ, দ্বিতীয়ের নাম আহকাম-ই-আলমগীরী। যতদূর জানা গিয়াছে শেষোক্ত গ্রন্থের দুইখানি মাত্র হস্তলিপি জগতে বিদ্যমান আছে, – একখানি রোহিলাখন্দে রামপুরের নবাবের নিকট, অপরত খানি খুদা বখশ পুস্তকালয়ে। এই দুখানি মিলাইয়া পাঠ উদ্ধার করিয়াছি। সব চিঠিগুলিইই বাদশাহের হুকুমে মুনশির জবানিতে লিখিত।
[ফার্সী পত্রের অনুবাদ]
প্রথম চিঠি
এই সময় বাদশাহ বাহির হইতে শুনিয়াছেন যে – ক) এই মন্ত্রীবর খাসমহাল ও অন্যান্য পরগণাগুলি ইজারা দ্বারা বন্দোবস্ত(মুশখখস) করিতেছেন, – ঐ প্রদেশে ইজারা শব্দ রাজস্বের জন্যে দায়ী হওয়া (অর্থাৎ ঠিকা লওয়া) অর্থে ব্যবহার হয়, – এবং ইজারাদারগণ দুর্ব্বলের ও প্রজাগণের উপর নানা প্রকার অত্যাচার করিতেছে। পরগণাগুলির আবাদ প্রায় লোপ পাইয়াছে এবং যদি আর এক বৎসর এই প্রকার চলে তবে নিশ্চই প্রজাগণ ধ্বংস হইবে।
খ) নাওয়ারার ব্যাপার অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়াছে। যদিও নৌকাগুলি সজ্জিত করিবার জন্যে বশরত খাঁকে নিযুক্ত কপরা হইয়াছে, তথাপি কাজটি সম্পন্ন হয় নাই।
গ) তোপখানার যে-সকল কর্ম্মচারী নানা থানায় নিযুক্ত আছে তাহারা পূর্ব্বের (বাকী) বেতনের জন্যে বড়ই ক্রন্দন করিতেছে। যদিও উহাদের বেতন দিবার জন্যে আপনার প্রতি বাদশাহ আজ্ঞা দিয়াছেন, তথাপি এ পর্যন্ত তদনুযায়ী কাজটি সম্পন্ন হয় নাই।
অতএব বাদশাহ আপনাকে নিম্নলিখিত কথাগুলি লিখিতে বলিলেন – ‘ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের মনোবাঞ্ছা যে তাঁহার রাজ্য আবাদ হউক, দুর্বল প্রবলের হাত হইতে রক্ষা প্রাপ্ত হউক, একজনের প্রতি অত্যাচার বা অনুরাগ(?পক্ষপাত) দেখান না হউক। আপনি ঈশ্বরকে সর্বদা উপস্থিত জানিয়া মহালগুলির আবাসবৃদ্ধি এবং প্রজাদের আরাম সর্বদা নিজের দৃষ্টির লক্ষ্যস্বরূপ করিয়া, যেরূপ কার্য্য প্রদাদের অনিষ্টের কারন হয় তাহা হইতে নিবৃত্ত থাকিবেন, -কারন রাজস্ব বৃদ্ধ প্রজাদের হাতেই। নৌ-বলের কাজকর্ম্মের বিশৃঙ্খলা সংশোধন এবং তোপখানার কর্ম্মচারীদের প্রাপ্য বেতন প্রদান সম্বন্ধে অত্যন্ত চেষ্টা করিবেন। জানিবেন যে এইসব বিষয়ে বাদশাহ অত্যন্ত তাকিদ করিতেছেন।
(টীকা – ‘বাহির হইতে’ – প্রত্যেক প্রদেশে নিযুক্ত সরকারী সংবাদদাতা(ওয়াকেয়া-নবিশ অথবা সাওয়ানেহ নিগার) ভিন্ন অপর কোনও লোকের পত্রে। ‘অত্যাচার’ – মুর্শীদ কুলী খাঁ যে রাজস্ব আদায় করিতে বড় কড়াকড়ি করিতেন, তাহা ষ্টুয়ার্টের ইতিহাসে (Section VI) বিশদরূপে বর্ণিত আছে; ষ্টুয়ার্ট সিয়ার-উল-মুতাখ্-খরীন ও রিয়াজ-উস-সালাতিন অনুসরণ করিয়াছেন। নাওয়ারা – বাঙ্গলায় যে-সকল সরকারো নৌকা যুদ্ধ ও অন্যান্য কার্য্যের জন্যে রাখা হইত, তারা সমষ্টি ও নৌকার সংখ্যা তিনশত ছিল। আমার হিস্টোরিক্যাল এসেজ, পাতা ১২০ দেখুন)
🔹২
বাদশাহের আজ্ঞা অনুসারে লিখিত হইতেছে যে – এখন বিহার প্রদেশের পদও আপনাকে অর্পণ করা হইয়াছে, আপনি স্বয়ং ওডিসা যান ইহা ভাল নহে। তথায় এক প্রতিনিধি(নায়েব) রাখিয়া জাহাঙ্গির-নগর[ঢাকা] (ফিরিয়া) আসিবেন, কারন যুবরাজ (আজীম-উশ-শান) কুমার (ফারোখ্শেয়ারকে ঢাকায়) রাখিয়া নিজে পাটনা চলিয়া গিয়াছেন। আপনার অনেক কার্য্য, সুতইরাং যথা হইতে সব স্থানের তত্ত্বাবধান করিতে পারেন এরূপ কেন্দ্রস্থানে আপনার বাস করা উত্তম। সর্বত্র কার্য্যাভিজ্ঞ এবং বিশ্বাসী প্রতিনিধি রাখিয়া বাদশাহের আজ্ঞানুসারে জাহাঙ্গীরনগর যাইবেন। আরও বাহশাহ হুকুম করিতেছেন যে –
ওডিসা পৃথক প্রদেশ(সুবা), এক কোণে স্থিত। সর্বদাই ইহার প্রত্রিথক শাসনকর্ত্তা থাকিত, এবং আপনার কার্য্যস্থলের(বাঙ্গালার) সঙ্গে ইহার কোনো সম্বন্ধ ছিল না। এই প্রদেশের অবস্থা লিখিয়া জানাইবেন।
🔹৩
ইতিপূর্বে আপনার উকিলের উক্তি হইতে বাদশাহ(বাঙ্গালা প্রদেশের সরকারি) সংবাদলেখকগণের অবস্থা জানিতে পারিয়াছেন; এখন আপনার পত্রেও সেই বিষয় অবগত হইলেন। সলীম-উল্লা ও মুহম্মদ খলিলকে নিজ নিজ পদ হইতে সরাইবার জন্যে হুকুম দেওয়া গেল, এবং এই হুকুম ইয়ারআলী বেগ(দারোগাওইডাকচৌকি)কে জানান হইল।
আপনার(অধীনস্থ) আমীনী ও ফৌজদারী সংশ্রবে সংবাদলেখক নিযুক্ত করিবার যে প্রার্থনা করিয়াছেন, বাদশাহ তাহা মঞ্জুর করিলেন।
আপনি লিখিয়াছেন – ‘আমার কার্য্যের অংশীগণ এবং অন্যান্য স্বার্থপর লোকেরা স্পষ্টতই বলিতেছে, ‘যাহা লিখিত হয় তাহা লিখিব।’ এবং এই সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় জমিদারগণ রাজস্ব প্রদান করিতে দেরি করিতেছে। নাদসাহ ইহার প্রতিকার স্থির করিয়া লিখিবেন। নচেৎ মহামান্যব্যক্তিগণ আবার লক্ষ লক্ষ টাকা (রাজস্বের) হানি করিবেন।’
এসম্বন্ধে বাদশাহ হুকুম করিতেছেন যে – ‘এই বিষয়টা আমি পরিস্কার বুঝিতে পারিতেছি না। তুমি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন দেওয়ান ও ফৌজদার এবং (তোমার বিরুদ্ধে) কাহারও কথা আমি শুনি না।’
আপনি আবারও লিখিয়াছেন, ‘আমার কার্যের অংশীগণ শত্রুতা করিয়া (আমার বিরুদ্ধে) নানা কথা লেখে, এবং তদ্বারা শাসনকার্য্য বিশৃঙ্খল করিয়া রাজকার্য্য নষ্ট করে। (অথচ) আমি এই দেশ আবাদ করাইয়া, ক্রোর ক্রোর টাকা সংগ্রহ করিয়াছি। স্বার্থপর লোকেরা যখন আমার কাজ ছিন্নভিন্ন করয়াছে, আমি আশাকরি (এই দাসের স্থলে) অপর কোনও কর্ম্মচারী নিযুক্ত হউক।’
বাদশাহ উত্তর দিতেছেন, – ‘কেন শয়তানের সন্দেহ করিতেছ? ঈশ্বর তাহার পাপ হইতে আমাদের রক্ষা করুন। তোমার ‘অংশী’ কে? তাহাদের অভিপ্রায় কি? তুমি বাদশাহের অনুগ্রহ ও স্নেহের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া এবং তাঁহার উপদেশ মানিয়া বাদশাহী রাজস্ব বাদশাহী রাজস্ব সংগ্রহে পূর্ব্বাপেক্ষাও অধিক চেষ্টা করিবে, এবং ক্রমাগত খাজনা (সদরে) পাঠাইতে থাকিবে। কোন ভয় করিও না।’
(টীকা – ইয়ারআলী বেগ বাদশাহের ডাকবিভাগের প্রধান অধ্যক্ষ। সমস্ত প্রাদেশিক সংবাদলেখকগণ তাঁহার অধীনে ছিল। যদি কোন প্রদেশের শাসনকর্ত্তা সংবাদলেখককে ভয় দেখাইতেন বা অপমান করিতেন, ইয়ারআলীবেগ অমনি গিয়া বাদশাহের নিকট নালিশ করিতেন, ‘সংবাদলেখকগণ বাদশাহের গোপণীয় চক্ষুস্বরূপ। যদি তাহাদিগের প্রতি অত্যাচার বা অপমান হইতে দেওয়া যায়, তবে তাহারা সত্য কথা লিখিতে সাহস পাইবে না, এবং শাসনকর্ত্তারা বাদশাহকে ফাঁকি দিবে।’ তখন শাসনকর্ত্তার শাস্তির হুকুম হইত। এইরূপে ইয়ারআলী তৎকালীন সি আই ডির প্রতিপত্তি অত্যন্ত বৃদ্ধি করিয়াছিলেন বলিয়া ফার্সী ইতিহাসে লিখিত আছে। আমার এনেকডোটস অব আওরঙ্গজীব পৃষ্ঠা ১৩০ দেখুন।
‘অংশীগণ’ – যুবরাজ আজীম্-উশ্-শান্ বাঙ্গলার নাজিম অর্থাৎ সৈন্য, বিচার ও শান্তির জন্যে দায়ী শাসনকর্ত্তা’ অপরপক্ষে মুর্শীদ কুলী খাঁ শুধু রাজস্ববিভাগে প্রধান ছিলেন। ‘মহামান্য ব্যক্তিগণ’ও সেই অর্থে ব্যবহৃত। গৌরবার্থে বহুবচন। মুর্শীদ কুলী খাঁর খাতিরে যুবরাজ আজীম্-উশ্-শান্কে বাদশাহ আওরঙ্গজীব কেমন ধমকাইতেন তাহা ষ্টুয়ার্টে বর্ণিত আছে।)
🔹৪
ইতিপূর্বে বাদশাহের হুকুমে এই মন্ত্রীবরকে লেখা হইয়াছে যে প্রায় নব্বই লক্ষ টাকার সরকারী খাজনা যাহা বঙ্গদেশ ও উড়িষ্যায় সংগ্রহ করা হইয়াছে এবং যাহার পরিমান আপনি বাদশাহকে লিখিয়া জানাইয়াছেন, ও তৎসঙ্গে অন্যান্য অধিক টাকা যাহা সংগ্রহ হইয়া থাকিবে, একত্রে যত দ্রুত সম্ভব এখানে পাঠাইবেন। এখন যুবরাজ (আজীম্-উশ্-শান্)কে আজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে যে ঐ সকল টাকা প্রেরণ করিবার জন্যে কড়া সজাওল নিযুক্ত করিয়া উহা এলাহাবাদ পর্যন্ত(রক্ষী সহ) পৌঁছাইয়া দেন। যদি আপনি পূর্ব্বে প্রেরিত আজ্ঞানুসারে পূর্বোক্ত টাকা সদরে রওনা করিয়া থাকেন, ভালই, নচেৎ এই পত্র পাইবামাত্র ঐ টাকা এবং অপর যাহা-কিছু আদায় হইয়াছে তাহা সমস্ত সর্বাপেক্ষা অধিক দ্রুততার সঙ্গে হুজুরে প্রেরণ করিবেন। জানিবেন বিলম্ব অবৈধ, কারন এ বিষয়ে বাদশাহ অত্যন্ত অধিক তাকিদ করিতেছেন। নিশ্চই এই আজ্ঞা কার্য্যে পরিণত করিবেন।
(টীকা – এই পত্রে আওরঙ্গজীব শেষ কয়েক বৎসরের টাকার অভাব বাঙ্গলা হইতে প্রেরিত রাজস্বের অত্যাবশ্যকতা স্পষ্টরূপে বুঝা যায়। এনেকডোটস অব আওরঙ্গজেন ১৯ এবং ১২৫ দেখুন)।
🔹৫
বাদশাহী নিয়মানুসারে খাস মহাল এবং অন্যান্য পরগণাগুলি বন্দোবস্ত করা, এবং নাওয়ারা ও তোপখানা সম্বন্ধে বাদশাহের হুকুমে আপনাকে যে পত্র লিখি তাহার উত্তর পাইলাম ও তাঁহাকে দেখাইলাম। আপনি যে জাহাঙ্গীরনগর পৌঁছিয়াছেন, রাজস্বের জন্যে দায়ী(জমিদারদিগের) নিকট মুচিল্কা গ্রহণ করিতেছেন, প্রজাদিগের প্রার্থনা ও মৃত কিফায়েৎ খাঁর কার্য্যপ্রণালী অনুসরণ করিয়া আপনি ঐসকল(জমিদারগণের) উপর রাজস্বের কিস্তি ধার্য্য করিয়া দিতেছেন, তাহা এবং অন্যান্য বিষয় বাদশাহ অবগত হইলেন।
আপনি লিখিয়াছেন – ‘তোপখানা হস্তি ও অন্যান্য প্রাদেশিক খরচের জন্য ফলুরিয়া ও অন্যান্য পরগণা স্থায়ী খাস মহাল নির্দ্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছি, এবং বাদশাহের আজ্ঞানুসারে তাহা মুহম্মদ হাদী নায়েবের হাতে অর্পণ করিয়াছি। যদি বাদশাহ হুকুম করেন তবে ঐ মহালগুলি বখ্শী বা বোইউতাতের হাতে দিতে পারি।’ প্রদেশের বোইউতাতের হাতে ওই মহালগুলি সমর্পণ করা বাদশাহ অনুমোদন করিলেন। নিশ্চই আজ্ঞানুসারে কার্য্য হইবে।
(টীকা – কিফায়েত খাঁ মীর আহমদ বাঙ্গলার দেওয়ানের পদ হইতে চ্যুত হইবার পর ১৬৯৭ খৃষ্টাব্দে সদরে খাস মহাল বিভাগের পেশকার নিযুক্ত হয় এবং ১৯৬৮ খৃ মে মাসে মারা যায়।
বখশীগণ সৈন্যদিগকে বেতনাদি বাঁটিয়া দিত ও তাহার হিসাব রাখিত। বোইউতাত – বাদশাহের গার্হস্থ্য সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক কর্ম্মচারী; ইহারা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির ফর্দ্দ করিত এবং তাহা হইতে বাদশাহের অংশ লইত)।
🔹৬
শূজাউদ্দিন মহম্মদকে উড়িষ্যার নায়েব রাখিয়া উড়িষ্যা ও বালেশ্বরের খাজনা সহ আপনার বাঙ্গলা প্রদেশে রওনা হওয়া এবং অন্যান্য ঘটনা-পূর্ণ আপনার দুইখানি চিঠির সংক্ষেপ বাদশাহকে জানান হইল। আপনি লিখিয়াছেন, ‘ওড়িষ্যার খাজনা আদায় হৈমন্ত শস্যের উপর নির্ভর করে; তাহা অনেক দিন ধরিয়া জমা করিয়া রাখা হয়, এবং কোনও উপায়ে বিক্রয় করিতে পারা যায় না।’
বাদশাহ তদুত্তরে বলিলেন যে ‘আমি শুনিয়াছি বণিকেরা এই শস্য গ্রহণ করে এবং তাহার পরিবর্ত্তে যে জিনিস চাওয়া যায় তাহা বন্দর হইতে আনাইয়া দেয়।’
আপনি প্রস্তাব করিয়াছেন, ‘সমস্ত উড়িষ্যা প্রদেশটা যুবরাজের বেতনের জন্যে নির্দ্দিষ্ট হউক, এবং (এখন) বাঙ্গলা ও বিহারে যে সব খাস মহাল আছে তাহার পরিবর্ত্তে(অপর জমি) খাস করা, এবং হুজুর হইতে খাস মহালগুলি নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হউক।’ তদুত্তরে বাদশাহ বলিলেন, ‘মুর্শীদ কুলী তিন প্রদেশের এবং যুবরাজের সম্পত্তির ও পূর্ণক্ষমতাপ্রাপ্ত দেওয়ান। অতএব যে (শাসন)প্রণালী উপযুক্ত সুবিধাজনক মনে করে তাহা প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তার(আজীম্-উশ্-শান্) মনঃস্তুষ্টি ও সম্মতি অনুসারে যেন করে।’
আপনি লিখিয়াছেন – ‘আমার বিহার প্রদেশে যাওয়া একান্ত আবশ্যক। তথা হইতে ফিরিয়া মেদিনীপুর বা বর্দ্ধমান – যাহা আমার অধীনস্থ ফৌজদারী এলাকাগুলির কেন্দ্র – যে হুকুম হইবে, তথায় যাইব। যদি ঊড়িষ্যা প্রদেশ যুবরাজের তন্খা নির্দ্দেশ করা মঞ্জুর হয়, তবে হৈমন্ত শস্য তাঁহার তন্খাস্বরূপ দেওয়া হইবে, এবং বাঙ্গলার খাস মহালের চাকলাগুলির ফৌজদারী বন্দোবস্ত বহাল রহিবে।’ তদুত্তরে বাদশাহ বলিলেন – ‘তুমি এইসব বিষয়ে নিজের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে পার।’
আপনি লিখিয়াছেন, – ‘যদি উড়িষ্যা অন্য কাহাকে প্রদান করা হয় তবে আমি বর্দ্ধমান ও অন্যান্য কর্ম্ম হইতে অবসর লইব।’ বাদশাহ বলিলেন অন্য কর্ম্মচারীকে দেওয়া হইবে না, তোমাকেই বহাল রাখিলাম।’ এই উপলক্ষে বাদশাহকে জানান হইল যে আপনি আপনার পূর্ব্ববর্তী কর্ম্মচারীদিগের অপেক্ষা অনেক ভালরূপে উড়িষ্যার বন্দোবস্ত করিয়াছেন, এবং জমিদারদিগের নিকট উপঢৌকন(পেশকাশ) লইয়া সরকারি কোষাগারে দাখিল করিছেন শুনিয়া বাদশাহ বলিলেন, বাহবা! বাহবা!
(টীকা মুর্শীদ কুলী খাঁ শাসনভার প্রাপ্ত হইয়াই প্রথমে বাদশাহের নিকট প্রস্তাব করিলেন যে বাঙ্গলার জাগীরগুলি রদ করিয়া তৎপরিবর্ত্তে সকল কর্ম্মচাতীকে উড়িষ্যায় জাগীর দেওয়া হউক। …প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর হইল।’ (ষ্টুয়ার্ট সেকশন ৬)। শূজাউদ্দিন অ মুর্শীদ কুলী খাঁর জামাতা এবং বাংলার নবাব পদে তাঁহার উত্তরাধিকারী)
🔹৭
আপনি (বাদশাহের সভাস্থ) আপনার উকীলকে যে চিঠি লিখিয়াছিলেন তাহার সংক্ষেপ বাদশাহকে দেখান গেল এবং তিনি সব বিষয়ে মর্ম্ম অবগত হইলেন। এই পত্রে আপনি লিখিয়াছেন –
‘(ক) আমি ঊড়িষ্যা যাইবার সময় সৈন্যবিভাগের তন্খা ও সুবার অন্যান্য খরচ নির্ব্বাহ করিবার জন্য যেসব মহাল কর্ম্মচারীদের হাতে সমর্পণ করিয়া যাই, তাহা তাহার নিজের দখল করিয়া লইয়াছে, এবং শাসনকার্য ছিন্নভিন্ন করয়া দিয়াছে।
(খ) আমি (বাদশাহকে অথবা যুবরাজকে?) জানাইতেছি যে বাঙ্গলাদেশে (বাদশাহী) সৈন্য উপস্থিত নাই, কর্ম্মচারীগণ ইচ্ছা করিতেছে যে সকলের বেতন শোধের নন্যে তন্খা করা টাকা নিজে গ্রাস করিয়া একটা বিপ্লব ঘটায়।
(গ) যদি আমি ঊড়িষ্যা প্রদেশ ও আমার ফৌজদারীর অন্যান্য মহালের সাসন বহাল রাখি, বাকী (রাজস্বের) টাকা ওসুল করিতে পারি, তাহাই যথেষ্ট। আমি সমস্ত (বঙ্গ-বিহার) প্রদেশের কার্য্য কিরূপে সম্পাদন করিতে পারিব? বাদশাহ এবিষয়ে উপায় নির্দ্দেশ করিবেন।
(ঘ) আমাকে সর্ব্বদা দেখিতে হয় যে যেখানে যাহা কিছু ঘটে অমনি নিন্দুকেরা যেন না লিখিতে পারে যে মুর্শীদ কুলী খাঁ(সৈনিকদিগের বাকী) বেতনের তন্খা দিতে আপত্তি করিয়াছে বলিয়া গোলমাল হইয়াছে।
(ঙ) শ্রীহট্টের জমিদারের গোমস্তা জানাইয়াছে যে – কর্তলব্ খাঁ নিজের পদচ্যুতির সংবাদ না পাইতেই শাসনকার্য্য ছাড়িয়া দিয়াছে। ঐ খাঁ শ্রীহট্টের এলাকার যে থানা স্থাপন করিয়াছিল, তাহা জয়ন্তিয়ার জমিদার ভাঙ্গিয়া দিয়াছে, শ্রীহট্টের গ্রাম লুঠ করিয়াছে, বাদশাহী নাওয়া হস্তগত করিয়াছে এবং খাঁইয়ের নিকট হইউতে দুইটা ঘোড়া, পাল্কী ও ছয়হাজার টাকা লইয়া তাহার সহিত সন্ধি করিয়াছে, এবং তৎপরে নিজদেশে ফিরিয়া গিয়াছে। শ্রীহট্টের নিকট একদল সৈন্য রাখা হইয়াছে। নবনিযুক্ত্য ফৌজদার ইউসুফবেগ খাঁ নিজের পুত্রকে নায়েব স্বরূপ(শ্রীহট্টে) প্রেরণ করিয়া নিজে জাহাঙ্গীরনগর আছে।’
মাসিক(বেতন) ও অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে আপনার উত্তর পৌঁছিল।
মন্ত্রীবর যখন (ঈশ্বর ধন্য হউন!) বাদশাহের অনুগ্রহের পাত্র, তখন স্থির মনে রাজকার্য্য করিতে থাকিবেন, প্রজাদিগের যত্নের সহিত বর্দ্ধিত করাইবেন, বেতনভোগী কর্ম্মচারীদিগের প্রাপ্য বাকী বেতনের তন্খা দিতে আপত্তি করিবেন না, এবং অনবরত খাজনা পাঠিতে থাকিবেন (ইহাই বাদশাহের আজ্ঞা!)
(টীকা – শ্রীযুক্ত অচ্যুতচরণ চৌধুরী, শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তের পূর্বাংশের ২ ভাগ, ২ খণ্ড, ৮৬ পৃষ্ঠায় এই ফৌজদারের নাম কারগুজার খাঁ বলা হইয়াছে। জয়ন্তীয়ার জমিদার – রাজা রামসিংহ(রাজত্ব ১৬৯৪-১৭০৮) হইবেন(উক্ত গ্রন্থ ২ ভাগ ৪ খণ্ড, ১৪ পৃ)
🔹৮
আপনি বাদশাহী রাজস্ব সংগ্রহে কিরূপে পরিশ্রম করিতেছেন এবং ১৬৬৪৮ আশরফী(স্বর্ণ মুদ্রা বা মোহর, দুই ক্রোর ৩৩ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫ শত ৫৩ টাকা এবং ৩ শত হুন(৪ টাকা মূল্যের দাক্ষিণাত্যের স্বর্ণ মুদ্রা) হুজুরকে যে পাঠাইয়াছেন, এবং প্রার্থনা করিয়াছেন যে বাদশাহের স্বহস্তে লিখিত কয়েক ছত্র সহ এক ফর্ম্মান আপনার নামে প্রেরিত হউক, তাহা সব বাদশাহ অবগত আছেন। সম্রাট অনুগ্রহপূর্ব্বক আপনাকে এক উজ্জ্বল সম্মানসূচক পরিচ্ছদ (খেলাৎ) এবং স্বহস্তাক্ষরে ভূষিত ফর্ম্মান প্রদান করিলেন।
নিশ্চই এই সব অনুগ্রহের জন্যে ধন্যবাদ প্রকাশ করিতে ও রাজস্ব সংগ্রহ ও হুজুরে প্রেরণ সম্বন্ধে অত্যন্ত পরিশ্রম করিবেন। ঈশ্বর করেন তবে অতি শীঘ্র খেলাৎ ও ফর্ম্মান আপনার নিকট প্রেরিত হইবে।
🔹৯
আপনি আপনার উকিলের নিকট যে চিঠিগুলি প্রেরণ করিয়াছেন তাহার আসল এখনও পৌঁছে নাই, কিন্তু তাহার নকল হইতে বাদশাহ লিখিত বিষয় অবগত হইলেন। আপনি ও আপনার নায়েব যে সুচারুরূপে রাজকার্য্য করিতেছেন তাহা বারম্বার বাদশাহ জানিতে পারিয়াছেন; তজ্জন্য সুফল(অর্থাৎ পুরষ্কার) হইয়াছে এবং (ঈশ্বর করুন) আরও ফল হইবে।
আপনি লিখিয়াছেন – ‘পাঁচশত সৈন্যের নেতা (সেই পদের ৫০০ অশ্বারোহী সৈন্য অতিরিক্ত যুক্ত আছে) এইরূপ মনসবদারদিগের জাগীর তন্খা দেওয়া হয় নাই। যেসকল বাকী মহালের ডোলের উপর বাদশাহ ‘স’ অক্ষর লিখিয়াছেন, তাহা হইতে অর্ধেকও(বাকী খাজনা) আদায় করা সম্ভব। যতদিন পর্য্যন্ত লাভজনক জাগীর প্রদান না করা হয়, ততদিন সৈন্যদের তন্খা দান এবং রাজকার্য্য কিরূপে করিব?’
বাদশাহ উত্তর করিলেন যে এটা আপনার হস্তেই রহিয়াছে এবং মাসিক বেতন নির্দিষ্ট। আমি(অর্থাৎ ইনাএৎউল্লা) যাহা উচিৎ হয় তাহা বাদশাহকে জানাইলেই তিনি তাহা দিবেন। এ বিষয়ে আপনি যাহা লিখিবেন আমি তাহাই বাদশাহকে জানাইব।
বাদশাহ আপনার নিম্নলিখিত প্রার্থনাগুলি মঞ্জুর করিলেন –
(ক) শূজাউদ্দিউন মুহম্মদএর মনসবের শর্ত্তানুযায়ী অশ্বারোহীগুলির সংখ্যা পরীক্ষা (দাঘ) করা হইতে মাফ করা গেল
(খ) হেদায়েৎউল্লা ও ইজ্জিৎউল্লাকে কর্ম্মস্থলে(উড়িষ্যায়?) প্রেরণ করা হইল।
(গ) বাঙ্গলার দেওয়ানের পেশকার ভূপৎরাম যদি তাঁহার(শূজাউদ্দিন) সঙ্গে যায় তবে তার মুনসব বহাল থাকিবে।
আমি বাদশাহকে জানাইলাম সেই উচ্চকর্মচারী(অর্থাৎ শূজাউদ্দিন) তাঁহার (উড়িষ্যার) সুবাদারির নজরস্বরূপ ১৪ হাজার টাকা কিস্তিতে কিস্তিতে রাজকোষে দিবেন, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন।
মৃত আসকার খাঁর পোষ্যপুত্র মুহম্মদস কুলীকে মনসব প্রদান, এবং প্রথমোক্ত খাঁর দুই পুত্র ঘুলাম হুসেন ও মুহম্মদ ইব্রাহিমকে দৈনিক সাহায্যদান সম্বন্ধে বাদশাহ বলিলেন –
‘মৃত খাঁর জামাতা হুজুরে মনসব প্রাপ্ত হইয়া প্রতিশ্রুত হইয়াছে যে খাঁর দাসীগর্ভজাত শিশুপুত্রগণের প্রতিপালন করিবে। (তাহারা) হুজুরে আসুক।’
(টীকা – ডোল – কোন মহান থেকে কত একুনে টাকা রাজস্ব আদায় হয়, তাহার তালিকা।
‘স’ অর্থাৎ সহি বা শুদ্ধ শব্দের প্রথমাক্ষর।
শর্তানুযায়ী – অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট কর্ম্ম যতদিন করিবে শুধু ততদিনই ঐ কর্ম্মচারী সেই মনসবের বেতন ভোগ করিবে, নচেৎ নহে। শর্তাধীন মনসব আরও উচ্চশ্রেণীর বলিয়া গণ্য হইত।
দাঘ – মনসবে নির্দ্দিষ্ট অশ্বারোহী সোইন্য ঠিক রাখা হইতেছে কী না দেখিবার জন্য তাহাদের একত্র করিয়া পরিদর্শন করা এবং তাহাদের অশ্বের পৃষ্ঠে জ্বলন্ত লোহা দিয়া বাদশাহী চিহ্ন অঙ্কিত করিয়া দেওয়া।
ভূপৎরাম – ষ্টুয়ার্ট ‘ভূপৎরায়’ লিখেছেন)
🔹১০
আপনার পত্র হইতে বাদশাহ জানিলেন যে উড়িষ্যার ফৌজদার শর্তানুযায়ী সৈন্যসংখ্যা কম এবং (আপনি) চল্লিশ লক্ষ টাকার খাজনা হুজুরে রওনা করিয়াছেন। বাদশাহ উক্ত ফৌজদারের মনসবে পাঁচশত অশ্বারোহী বৃদ্ধি করয়া দিবেন, কিন্তু এই কার্য্য করবার শর্ত্তে। আপনি যে বাদশাহের লাভ ও উন্নতি করিতেছেন তাহা বারম্বার তাঁহার শ্রুতিগোচর হওয়ায় – (ঈশ্বর ধন্য হউন!) – আপনার প্রতি বাদশাহের অনুগ্রহ দিনদিন বাড়িয়া যাইতেছে। আপনি হুজুরের নিকট ক্রমাগত খাজনা পাঠিতে অত্যন্ত পরিশ্রম ও চেষ্টা করিবেন।
🔹১১
মন্ত্রীবরের পত্র হইতে বাদশাহ জানিলেন যে চন্দ্রকোণা জয় করিতে আপনি যে বীরত্ব দেখাইয়াছেন তাহার পুরষ্কারস্বরূপ যুবরাজ আপনাকে এক খেলাৎ ও দুইটি অশ্ব উপহার দিয়াছেন/ বাদশাহ আপনাকে তাহা গ্রহণ করিতে অনুমতি দিলেন।
🔹১২
জগতের মাননীয় বাদশাহ অনুসারে আপনাকে লিখিতেছি যে – যুবরাজ মুহম্মদ আজিম ফর্ম্মান পৌঁছবার সময় পর্যন্ত যে সব খাজানা ও হাতী সংগ্রহ হইয়া থাকিবে তাহা সঙ্গে লইয়া দ্রুতবেগে বাদশাহের নিকট আসিতে আজ্ঞান পাইয়াছেন। তিনি তাহার বড় ছেলেদিগকে আজীমাবাদে ও জাহাঙ্গিরনগরে রাখিবেন। আপনি উড়িষ্যা ও আপনার এলাকার অন্যান্য মহালের নায়েব বসাইয়া, শীঘ্র জাহাঙ্গীরনগরে আসিয়া, যুবরাজের প্রত্যাবর্ত্তন পর্যন্ত ভালরূপে সাবধান হইয়া থাকিবেন। কারন(প্রদেশটি) আপনার হাতেই রহিল। এ বিষয়ে হুজুরের বিশেষ তাকিদ জানিবেন।
🔹১৩
যুবরাজ মহম্মদ আজীমের পত্রপাঠে বাদশাহ জানিলেন যে মুকরমৎ খাঁ নিজের গ্রাসকরা টাকা না দিয়া এবং দেওয়ানীর হিসাব হইতে মুক্তিলাভ না করিয়াই বাঙ্গলা হইতে ঘাজীপুর যাইতে চাহিতেছে। যখন আপনার এই মর্ম্মে পত্র পাওয়া গেল যে উক্ত খাঁ অনেক টাকার জন্য দায়ী ও তাহা আদায় করা উচিৎ এবং যদি হিসাব (পরিষ্কার) না করিয়া সে নিজ কার্য্যের মহালে যায় তবে সম্রাটের রাজস্ব ক্ষতি হইবে। – তখন যুবরাজ হুকুম দিলেন যে উক্ত খাঁ নিজের নায়েবকে ঘাজীপুরে পাঠাইয়া স্বয়ং আপনার নিকট যাইবে, ও হিসাব হইতে মুক্ত হইয়া তবে প্রত্যাবর্ত্তন করিবে। যদি বাদশাহের হুকুম হয় তবে যুবরাজ উক্ত খাঁকে সরকারি প্রাপ্য টাকা (শোধ) দিবার পূর্বেই আপনার নিকট হইতে ডাকিয়া ঘাজীপুরে পাঠাইতে পারেন।
বাদশাহ উত্তর দিলেন – ‘উহাকে ঘাজীপুরে পাঠাও। উহার নিকট প্রাপ্য টাকা আদায় করা এই মন্ত্রীবরের কর্ত্তব্য।’
🔹১৪
বাদশাহের আজ্ঞানুসারে লিখিত হইতেছে যে – বিহার প্রদেশের দেওয়ান পদে আপনাকে নিযুক্ত করার পর হইতে এ পর্যন্ত আপনি বিহারে আসিতে পারেন নাই। হকীম মুহম্মদ সা’ঈদের অবস্থা তো জানা আছে। যে নতুন নায়েবকে যুবরাজ মুহম্মদ আজীম নিযুক্ত করিয়াছেন, তাহার চরিত্র অজ্ঞাত। এজন্য তাহাকে নায়েব-দেওয়ান পদের সনদ(নিয়োগপত্র) দেওয়া হয় নাই। যুবরাজকে এখন হুজুরে ডাকা হইয়াছে। যদি আপনার মন ঐ নায়েব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়, তবে তাহার নামে সনদ পাঠান যাইবে। নচেৎ অপর নায়েব নিযুক্ত করিয়া তাহার বিষয় লিখিবেন, যে বাদশাহকে জানাইতে পারি।