খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ সাল। ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রেনিকাসের যুদ্ধ চলছে। মেসিডোনিয়ান বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ভীষণ প্রতাপ নিয়ে লড়ছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তার সাথে মেসিডোনিয়ার আরও একজন বীর সৈনিক লড়ে চলেছেন, তার নাম ক্লেইটাস। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্লেইটাস আলেকজান্ডারের প্রতাপকেও যেনো হার মানিয়েছেন। সুযোগ মতো নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আলেকজান্ডারকে রক্ষাও করলেন তিনি। গ্রেনিকাসের এই যুদ্ধ জয় ছিলো পারস্যের বিরুদ্ধে আলেকজান্ডারের প্রথম বিশাল আকারের বিজয়। এই ঘটনার পর থেকে ক্লেইটাসের প্রতি হৃদ্যতা বেড়ে যায় আলেকজান্ডারের মনে। ক্লেইটাসকে বন্ধু মনে করতেন তিনি। একই সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বহু যুদ্ধ জয় করেছেন তারা দুজন। গ্রেনিকাস এর যুদ্ধের পাঁচ বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ৩২৯ সালে একত্রে অভিযান চালিয়ে প্রাচীন ইতিহাসের বিখ্যাত নগরী সমরখন্দ, যা ইতিপূর্বে সাইরাস দ্য গ্রেটের আমল থেকেই পারস্যের আকেমেনিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো, তা দখল করেন আলেকজান্ডার। সমরখন্দকে তিনি গড়ে তোলেন ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে। এই সফলতার আনন্দে একদিন এক মদের আসরে বসে বন্ধু ক্লেইটাসের সঙ্গে মদ্যপান করছিলেন আলেকজান্ডার। উল্লাস দিয়ে এই আসর শুরু হলেও এক পর্যায়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাল হারিয়ে ফেলেন আলেকজান্ডার ও ক্লেইটাস উভয়েই। নেশায় বুঁদ হয়ে তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়বার এক পর্যায়ে একে অপরকে হত্যা করতে উদ্যত হন তারা। শেষ পর্যন্ত এই সমরখন্দ নগরেই আলেকজান্ডারের হাতে তার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘটনাটি ঘটে যায়। মাতাল আলেকজান্ডার প্রিয় বন্ধু ক্লেইটাসকে নিজ হাতে হত্যা করেন, যা আলেকজান্ডারের জীবন ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবেই পরিগণিত হয়।
তবে সমরখন্দ নগরীকে কিন্তু আলেকজান্ডারের জীবনের এই নিকৃষ্টতম ঘটনা দিয়ে স্মরণ করা হয় না। ঐতিহ্য ও ইতিহাসে পরিপূর্ণ হাজার বছরের প্রাচীন শহর এটি। যুগ যুগ ধরে বিজিতদের হাতেই ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে এই সমরখন্দ।
আগেই বলা হয়েছে, প্রথমে শহরটি ছিলো পারস্যের আকেমেনিড সাম্রাজ্যের অধীনে। মহামতি সাইরাস দ্য গ্রেট সর্বপ্রথম শহরটিকে দখল করেছিলেন। এরপর ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের আমলে শহরটি আরও বেশি সমৃদ্ধি লাভ করে এবং সগডিয়ানার রাজধানীতে পরিণত হয়। ‘সমরখন্দ’ নামটিও কিন্তু সগডিয়ান ভাষা থেকেই এসেছে। সগডিয়ান ভাষায় ‘সমর’ শব্দের অর্থ ‘যুদ্ধ’ এবং ‘খন্দ’ শব্দের অর্থ ‘দুর্গ’। সুতরাং ‘সমরখন্দ’ কথাটির অর্থ দাঁড়ায়, ‘পাথরের দুর্গ’। আসলে একটি পাথরের দুর্গের মতোই সুরক্ষিত ও সমৃদ্ধ নগরী ছিলো বলে প্রতিটি যুগেই এই শহর বিখ্যাত সাম্রাজ্যগুলোর নজর কেড়েছিলো।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সমরখন্দ সেলিউসিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এক সময় সেলিউসিড শাসক ডিওডোটাস স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন এবং সমরখন্দকে স্বতন্ত্র গ্রীকো-ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর কুষাণ সাম্রাজ্যের শাসনামলে এই সমরখন্দ চলে যায় কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের নিয়ন্ত্রণে।
কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রায় পাঁচ শতাব্দী যাবৎ সমরখন্দ নগরীর গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। সাসানীয় যুগে পারস্যের নতুন ধর্ম মণিবাদের একটি অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয় এই সমরখন্দ। এরপর ক্রমে ক্রমে জায়োনাইট, হেপথালাইট, গোকতুর্ক প্রভৃতি যাযাবর জাতির দখলে চলে যায় সমরখন্দ।
একেবারে শুরু থেকেই সমরখন্দ ছিলো বিখ্যাত বাণিজ্য পথ সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। এটিও এই নগরীর অর্থনৈতিকভাবে এতো সমৃদ্ধশালী হবার একটি অন্যতম কারণ। সপ্তম শতকের দিকে চীনের তাং সাম্রাজ্যের শাসনামলে সিল্ক রোড আবারো চালু হয় এবং তাং সাম্রাজ্যের অধীনে আবারও আগের জৌলুস ফিরে পায় শহরটি। তাং সাম্রাজ্যের পরে সমরখন্দ চলে যায় আরবদের দখলে এবং ৭১০ সালে তা উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকে পুরোদমে ইসলামী ও আরব সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল হয়ে যায় সমরখন্দ। উমাইয়াদের সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে আব্বাসীয়রা। আব্বাসীয় খিলাফতের নিয়ন্ত্রণাধীন সমরখন্দের চারপাশে সুরক্ষা প্রাচীর গড়ে তোলেন আব্বাসীয় সেনাপতি আবু মুসলিম।
প্রাচীনকাল থেকে চীন বহু গোপন দক্ষতায় পারদর্শী ছিলো এবং নিজেদের দক্ষতা লুকিয়ে রেখে তারা বাণিজ্যে একচেটিয়াভাবে প্রভাব বিস্তার করে গিয়েছে এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। তবে চীনাদের এই গোপন কৌশলগুলো একটা সময় আর গোপন থাকে নি। তাদের সিল্ক বা রেশম তৈরীর রহস্য যেভাবে গুপ্তচরদের মাধ্যমে ফাঁস হয়েছিলো, তেমনি প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিলো তাদের কাগজ তৈরীর কৌশলও। আব্বাসীয় খিলাফতের সময় দুই জন চীনা বন্দির কাছ থেকে কাগজ তৈরীর কৌশল জেনে নিতে তারা সক্ষম হয়েছিলো। আর তাই এ সময়েই আব্বাসীয় ইসলামী শাসনামলে চীনের বাইরে সর্বপ্রথম কাগজ কল প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর যথাক্রমে পারস্যের সামানি সাম্রাজ্য, তুরস্কের কারাখানি, সিলজুক এবং খোরেজমশাহ বংশের মাধ্যমে শাসিত হয় সমরখন্দ।
সমরখন্দের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয় ১২২০ সালে। চেঙ্গিস খান এসে সমৃদ্ধ এই নগরীর সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দেন। তবে ১৩৭০ সালে মঙ্গোল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং তৈমুরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত সমরখন্দকে আবারও যত্ন করে গুছিয়ে আনেন। সমরখন্দের প্রতি তৈমুর লং এর এই বিশাল অবদানের কারণে সমরখন্দকে তৈমুর লং এর রাজধানী বলেও ডাকা হয়। তৈমুর লং যুদ্ধক্ষেত্রে যথেষ্ট নিষ্ঠুর সেনাধ্যক্ষ ছিলেন, তবুও সমরখন্দ নগরীকে তিনি নিজের সন্তানের মতোই ভালোবেসেছিলেন। তার সময়ে সমরখন্দসহ সমগ্র মধ্য এশিয়া শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেছিলো। মোট কথা, এ সময় মধ্য এশিয়ায় স্বর্ণযুগের আগমন হয়েছিলো।
তবে এক সময় সমরখন্দের এই স্বর্ণযুগও শেষ হয়ে যায়। ১৫১০ সালে উজবেকরা তৈমুর বংশকে অপসারণ করে সমরখন্দকে দখল করে নেয়। এর পর ১৮৬৮ সালে সমরখন্দ চলে যায় রাশিয়ার দখলে। এর পর ১৯৯১ সালে স্বাধীন হয় উজবেকিস্তান। তখন থেকে উজবেকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের একটি বিশেষ নগরী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে সমরখন্দ।
নিশ্চিতভাবেই অতি প্রাচীনকাল থেকে বিজিত সাম্রাজ্য গুলোর অধীনে সমরখন্দে চোখ ধাঁধানো ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। আর এদের মধ্যে অধিকাংশই ইসলামী যুগে নির্মিত স্থাপত্য। গোর-ই-আমীর, বিবি খানুম মসজিদ, শাহ-ই-জিন্দা, রেগিস্তান স্কয়ার ইত্যাদি সমরখন্দের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা।
হাজার বছর ধরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খাতায় ক্রমাগত নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়া সমরখন্দ নগরী মধ্য এশিয়ার গর্ব এবং এই গৌরবান্বিত আখ্যানগুলো তুলে ধরবার দায়িত্বও আমাদের উপরই বর্তায়।
রেফারেন্স:
- https://www.worldhistory.org/Battle_of_the_Granicus/
- https://en.wikipedia.org/wiki/Cleitus_the_Black
- https://bonikbarta.net/magazine_details/4636
- https://bonikbarta.net/magazine_details/4640
- https://bonikbarta.net/magazine_details/4638
- https://www.rkraihan.com/2023/01/samanio-rajbongso-somporke.html
- https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A4%E0%A7%88%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B0_%E0%A6%B2%E0%A6%82
- https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%96%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%A4