চাঁদনী রাত। পাহাড়ি এলাকায় গুল্মজাতীয় কিছু উদ্ভিদ সংগ্রহে ব্যস্ত কয়েকজন তরুণী। পাহাড়ি ছাগলের মাধ্যমে টানা এক বিশেষ যানে সেগুলো ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। হয়তো কোনো দেবতার সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে, কিংবা কোনো অজেয় শক্তিকে জয় করবার উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হবে সেই বিশেষ গুল্মগুলো। অত্যন্ত বিরল এই উদ্ভিদ, সবাই জানে না এর ঠিকানা। গুল্মগুলো সংগ্রহ করেই কেমন এক সম্মোহনী শক্তি ভর করেছে যেনো তরুণীদের ওপর। এগুলোর পাতা নয়, বরং কান্ডের লম্বা অংশটি পিষে প্রাপ্ত তরলকে ভেড়ার পশমে ছেঁকে টানা নয় দিন ঢেকে রেখে গাঢ় বাদামী রঙের তিতকুটে স্বাদবিশিষ্ট একটি রস তৈরী করতে হবে। এ এক বিশেষ রস; যা দুধ, দই, কিংবা বার্লির সাথে মিশিয়ে পান করবেন ঋষি-মুনিরা। এটি পানের মাধ্যমে অদ্ভূত এক উত্তেজনা আর উদ্যম তৈরী হবে ঋষি-মুনিদের শরীরে। মহাযজ্ঞের আগে তো প্রস্তুত করতেই হবে এই বিশেষ পানীয়। জানেন তো, কোন পানীয়ের কথা বলছি? হ্যাঁ, ঠিকই ভাবছেন, বলছি বহুল আলোচিত রহস্যময় সোম রসের কথা।
বৈদিক শাস্ত্রে এই সোম রস সম্পর্কে বহু রোমাঞ্চকর কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। হিন্দু ধর্মমতে, ‘সোম’ কিন্তু চন্দ্রদেবতারই আরেকটি নাম। এ কারণেই হয়তো রহস্যময় সেই তরুণীরা সোমের সন্ধানে গিয়েছিলো পূর্ণিমার রাতেই। কিন্তু কি এই সোম রস? সত্যিই কি আছে এর অস্তিত্ব, নাকি সমস্তটাই কল্পনা?
অনেকেরই ধারণা, নিশ্চয়ই সোম নেশা উদ্রেককারী কোনো পানীয়। তবে দেবতারাজ ইন্দ্র নাকি যুদ্ধে যাবার আগে অসংখ্য পাত্রভর্তি সোম রস পান করতেন! কিন্তু কেনো? যুদ্ধে যাবার আগে তো কেউ নেশাগ্রস্ত হতে চান না, চান প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করতে। অর্থাৎ সোম নিশ্চয়ই এমন কোনো পানীয়, যা দেহে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণকে বাড়িয়ে দেয়, রক্ত সঞ্চালনকে দ্রুততর করে এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে এ-ও জানা গেছে যে, সোম রস পানে হ্যালুসিনেশনের প্রবণতা বেড়ে যেতো, যার ফলে ঋষিরা দৈব ও অশরীরী অস্তিত্বের দেখা পেতেন।
প্রাচীন সিথিয়ান বা শক জাতি, মেসোআমেরিকান জনগোষ্ঠী এবং গ্রীকরাও যুদ্ধে যাবার আগে এক ধরনের উদ্দীপক পানীয় পান করতেন। এ যেনো ঠিক ইন্দ্রের অবলম্বিত উপায়টিই! নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাদের গৃহীত সেই পানীয় তাদেরকে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করতো। ‘ফাইট’ অথবা ‘ফ্লাইট’, অর্থাৎ যুদ্ধের উদ্যম কিংবা বিপদের তীব্রতা বুঝতে পেরে সঠিক সময়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণে যোদ্ধাদেরকে সহায়তা করতো এই পানীয়টি।
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এই সোম রসের উৎস পাহাড়ি এলাকা, খুব সম্ভবত তিব্বত থেকে আফগানিস্তানের মধ্যেই কোনো অঞ্চল। হয়তো হিমালয়ের কোথাও আজও এর অস্তিত্ব আছে, কিন্তু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দেশভাগ, বর্ডার অতিক্রমে নিষেধাজ্ঞা, পশ্চিমায়নের প্রবণতা ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে উপযুক্ত গবেষণা করাও সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি বলেই হয়তো আজও এই বলবর্ধক পানীয়ের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই নি।
তবে এক্ষেত্রে আশার কথা হচ্ছে, বৈদিক শাস্ত্রের সাথে আবেস্তা (জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মগ্রন্থ) এর বেশ কিছু সাদৃশ্য আছে। প্রাচীনকালে ঋষি-মুনিরা যেমন যজ্ঞের আগে সোম-উৎসব পালন করতেন, ঠিক তেমনি পার্সিয়ান জরাথ্রুস্টবাদীরাও পালন করতেন হোম-উৎসব এবং যদিও হিন্দুশাস্ত্র ও জরাথ্রুস্টবাদ পরস্পর বিরোধী ধর্ম, তবুও এই উৎসব দুটোকে একই রকম বলে ধারণা করা হয়। এটিও মনে করা হয় যে, ঋষি-মুনিদের সোম এবং জোরোস্ট্রিয়ানদের হোম একই পানীয়, কেননা সংস্কৃত উচ্চারণের ‘স’ পার্সিয়ান উচ্চারণের ‘হ’-তে পরিণত হয়। পার্সিয়ানরা এখনও এই উৎসব পালন করে থাকেন এবং এই হোম পানীয় তৈরীর জন্য উপযুক্ত হার্ব তারা আফগানিস্তানের কোনো এলাকা থেকেই সংগ্রহ করেন বলে ধারণা করা হয়।
এখন পর্যন্ত নানা মত অনুসারে অনেক উদ্ভিদকেই সোমের উৎস বিবেচনা করা হয়, যদিও এদের কোনোটারই সোমের উৎস হিসেবে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই। সারকোস্টেমা অ্যাসিডাম বা সোমলতা নামের একটি পাতাবিহীন গাছ, অ্যাসক্লেপিয়াস অ্যাসিডা বা আমেরিকান মিল্কউইড নামের এক ধরনের আগাছা, এফিড্রা সিনিকা নামের একটি গাছ, অ্যামানিটা মাসকারিয়া নামের ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে এক ধরনের ছত্রাক, ক্যানাবিস ইন্ডিকা বা গাঁজা –এদের প্রত্যেকটিরই ওষধি গুণ রয়েছে এবং এদের প্রত্যেককেই সোম রসের উৎস বলে কল্পনা করা হয়। কিন্তু আসলে যে সোম রস কোন উদ্ভিদ থেকে তৈরী হয়, তার হদিস আজও মেলে নি।
তবে চীনের একটি প্রাচীন সমাধিতে খুঁজে পাওয়া একটি কার্পেটে একটি চিত্র অঙ্কিত হয়েছিলো যে, জোরোস্ট্রিয়ান দেবতা আহুরা মাজদা একজন পুরোহিতকে ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে একটি উদ্ভিদ উপহার দিচ্ছেন। সেই অর্থে, অ্যামানিটা মাসকারিয়াও হয়তো সোম রসের উৎস হতে পারে।
আবার গবেষণায় দেখা গেছে, এফিড্রা সিনিকা নামের গাছটি থেকে এফিড্রিন নামের একটি রস নিষ্কাশিত হয়, যা অ্যাড্রিনালিন হরমোনের মতোই উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। বর্তমানেও এই এফিড্রিন ওষুধ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। এমনকি পাকিস্তানের পার্বত্য প্রদেশের বাজারে এই এফিড্রিন সোম রস নামেই ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। এই এফিড্রিন থেকে আবার তৈরী হয় আরেকটি ওষুধ, অ্যাম্ফিটামিন। স্নায়বিক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করা এই ওষুধটি অধিকাংশ লেখক ও শিল্পীরা ঘুম তাড়ানোর জন্য সেবন করে থাকেন। এই এফিড্রিনই সোম রস হবার অনেক বড় একটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়, কারণ উনিশ শতকের দিকে পারস্যের জোরোস্ট্রিয়ান ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য এফিড্রিনই তাদের মূল উদ্দীপক পানীয় হিসেবে ব্যবহার করতেন।
আসলে অবহেলা তো আমাদেরই। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে আমরাই নিজেদের অমূল্য সব সম্পদগুলোকে হারিয়ে যেতে দিয়েছি। আমরাই প্রাকৃতিক চিকিৎসার পরিবর্তে কৃত্রিম চিকিৎসার ওপর নিজেদেরকে নির্ভরশীল হতে দিয়েছি। ঋগ্বেদের পুরো একটি অধ্যায় যেই সোম রস নিয়ে রচিত হয়েছে, তা নিশ্চয়ই নিরর্থক কিংবা কাল্পনিক কোনো বস্তু নয়। হয়তো এর অস্তিত্ব ও অবস্থানের কথা হারিয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া সংস্কৃত ভাষার কোনো এক কোণায় আজও লিখিত রয়েছে। হয়তো আজও উপযুক্ত গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে হারিয়ে যাওয়া সেই অসীম শক্তি ও জ্ঞান অর্জনের ভেষজ। হয়তো হারিয়ে যাওয়া সেসব ওষধি উপাদানগুলো পুনঃরুদ্ধার করতে পারলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের অসংখ্য অনিরাময়যোগ্য রোগের কবল থেকে আমরা রক্ষা করতে পারবো সমগ্র মানবজাতিকে।
রেফারেন্স: