প্রাচীন মিশর এক সময় নারী ফারাও এর দ্বারা শাসিত হয়েছে, যদিও পুরুষদের তুলনায় সেই সংখ্যা ছিলো খুবই কম। এই নারী ফারাওদের অনেকের নাম ইতিহাস থেকে মুছেও ফেলা হয়েছে। তবে নিশ্চিহ্নকরণের এই প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল হতে পারে নি। প্রাচীন মিশরের এমনই একজন নারী ফারাও ছিলেন হাতশেপসুত।
হাতশেপসুত ছিলেন রাজা প্রথম থুতমোস এবং তার প্রধান স্ত্রী রাণী আহমোসের মেয়ে। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১৫০৭ সালে হাতশেপসুতের জন্ম। ফারাও এর একমাত্র বিশুদ্ধ রাজকীয় সন্তান হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ফারাও তো তারই হবার কথা। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন নারী। আর নারীর শাসন মিশরীয়রা কখনোই মেনে নেয় নি। তাই প্রথম থুতমোসের মৃত্যুর পর ফারাও হন তার আরেক সন্তান, হাতশেপসুতের সৎ ভাই, দ্বিতীয় থুতমোস। দ্বিতীয় থুতমোসের সাথে হাতশেপসুতের বিয়ে হয়। শুনতে অন্য রকম লাগলেও ভাই-বোনের বিয়ে তখনকার মিশরীয় সমাজে ছিলো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। রাজবংশের রক্ত বিশুদ্ধ রাখার একটি অন্যতম প্রক্রিয়া ছিলো এটি।
দ্বিতীয় থুতমোস ফারাও হলেও তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কিছু তিনি করে যেতে পারেন নি। কিন্তু দ্বিতীয় থুতমোসের মৃত্যুর পর আবারও সেই একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো মিশরকে- কে হবেন পরবর্তী ফারাও?
প্রধান স্ত্রী হাতশেপসুতেরও ছিলো কন্যা সন্তান। আর অন্য স্ত্রীর গর্ভে দ্বিতীয় থুতমোসের ছয় বছর বয়সী এক ছেলে ছিলেন। কিন্তু মিশরের শাসনভার গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ভীষণ অনুপযুক্ত। সব দিক বিবেচনায় মিশর পরিচালনার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন হাতশেপসুত নিজেই। তিনি ছিলেন একজন যোগ্য নারী, একজন ফারাও এর মেয়ে এবং সেই সাথে একজন রাণী। কিন্তু সব সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে পরবর্তী ফারাও ঘোষণা করা হলো দ্বিতীয় থুতমোসের ছয় বছর বয়সী ছেলে তৃতীয় থুতমোসকেই। যেহেতু এতো কম বয়সে রাজ্য পরিচালনা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না, তাই তার অভিভাবক হিসেবে মিশরের সিংহাসনে বসলেন হাতশেপসুত।
সিংহাসনে বসার পর থেকেই হাতশেপসুতের উদ্দেশ্য ছিলো নিজেকে একজন যোগ্য ফারাও প্রমাণ করা। মিশরীয় ধর্ম ও বিশ্বাস অনুযায়ী ফারাও প্রথম থুতমোস ছিলেন মহাদেবতা আমুনের
বংশধর। সেই হিসেবে ফারাওদের মতো হাতশেপসুতও একজন ঐশ্বরিক নারী। তবে এ ছাড়াও হাতশেপসুতের জন্ম নিয়ে অন্য একটি বিশ্বাসও প্রচলিত ছিলো। সেই বিশ্বাস অনুযায়ী, হাতশেপসুতের মা আহমোসের সঙ্গে দেবতা আমুন তার স্বামী প্রথম থুতমোসের ছদ্মবেশে দেখা করতে গিয়ে তাকে গর্ভবতী করেন এবং আহমোসের সেই বিশেষ সন্তানই ছিলেন হাতশেপসুত। এই ঘটনা তার ফারাও হবার পথে নতুন সম্ভাবনা তৈরী করেছিলো, কেননা ফারাওদের ক্ষেত্রে ঐশ্বরিক অস্তিত্বের প্রমাণ থাকা ছিলো বাঞ্চনীয়।
হাতশেপসুত ছিলেন ভীষণ সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী। তবুও শুধুমাত্র নারী হবার কারণেই তাকে ফারাও হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকেই। রাজ্যের মানুষের সম্মান লাভের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন পুরুষ ফারাও এর আবাসন। পূর্ববর্তী সমস্ত পুরুষ ফারাও এর মতো তিনিও কিল্ট এবং নকল দাড়ি পরতে শুরু করলেন। অবশ্য এর ফলও তিনি পেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে তার এই প্রয়াস গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো সবার কাছে।
হাতশেপসুত সম্পূর্ণ নিজ যোগ্যতায় প্রায় বাইশ বছর মিশরের একজন সফল শাসক হিসেবে কাজ করে গেছেন। বিভিন্ন রাজকীয় স্থাপনা থেকে শুরু করে সমাধি, মন্দির, ওবেলিস্ক বা সুউচ্চ মূর্তি এবং অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন তিনি। অন্য ফারাওদের মতো তিনিও নিজের শবাগার মন্দির নির্মাণ করেছিলেন দেইর-আল-বাহরিতে, ফারাও প্রথম মেন্টুহোটেপের শবাগার মন্দিরের পাশেই। মন্দিরটির নির্মাণশৈলী এতো সুন্দর যে, হাজার বছর পরের গ্রিক সভ্যতাকেও তা হার মানায়। মন্দিরের দেয়ালে হাতশেপসুতের জন্মের পৌরণিক কাহিনীটি ও তার সাফল্যগাঁথা খোদাই করা আছে, যেখানে তাকে মহাদেবতা আমুনের মেয়ে বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে মন্দিরের দেয়ালে উল্লেখিত হাতশেপসুতের নাম পরবর্তীতে ইচ্ছাকৃতভাবেই মুছে দেয়া হয়েছিলো। হয়তো ফারাও হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নকে প্রশ্রয় না দেবার উদ্দেশ্যেই পরবর্তী ফারাও তৃতীয় থুতমোসই এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
বিখ্যাত কার্নাকের মন্দিরেও হাতশেপসুত ৯০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট চারটি বিশাল ওবেলিস্কের নির্মাণকাজ পরিচালনা করেছিলেন। মাত্র সাত মাসের মধ্যে বিশাল ওবেলিস্কগুলোকে খনি থেকে কেটে মন্দিরে স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিলো, যা এক প্রকার বিস্ময় জাগানিয়া।
হাতশেপসুত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও সফলতা দেখিয়েছিলেন। পান্ট যাত্রার মধ্যে দিয়ে দুইশো বছরের ভেঙে যাওয়া সম্পর্ককে জোড়া লাগিয়েছিলেন তিনি। পান্ট হলো বর্তমান লোহিত সাগরের কাছাকাছি একটি জায়গা। পান্ট থেকে লোবান, গন্ধরস, সোনা, রেজিন, কৃষ্ণকাঠ, দারুচিনি ও হাতির দাঁতের তৈরী জিনিসপত্রসহ অনেক দুর্লভ বস্তু মিশরে এনে বাণিজ্য শুরু করেন হাতশেপসুত। হাতশেপসুতের এই পান্ট অভিযান শুরু হয়েছিলো তার রাজত্বের নবম বছরে। পান্ট থেকে ৩১ টি গন্ধরসের গাছ মিশরে এনে লাগানো হয়েছিলো, যা সে সময় মিশরে রোপণ করা প্রথম বিদেশি গাছ ছিলো। লোবান পুড়িয়ে গুঁড়ো করে তৈরী করা হতো চোখের কাজল। শুধু এগুলোই নয়, পান্ট থেকে আনা হয়েছিলো জিরাফ, বেবুন ও ঘোড়াসহ অনেক দুর্লভ পশু-পাখি এবং হাতশেপসুতের রাজত্বকালেই মিশরের প্রথম চিড়িয়াখানার প্রচলন হয়েছিলো। পান্টের সাথে মিশরের এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক হাতশেপসুতের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বজায় ছিলো।
হাতশেপসুতের মৃত্যুর পর তৃতীয় থুতমোস সিংহাসনে বসেন। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, তৃতীয় থুতমোস হাতশেপসুতের স্থাপনাগুলো থেকে শুধু তার নাম মুছে ফেলারই চেষ্টা করেন নি, সেই সাথে তিনি ও তার ছেলে হাতশেপসুতের কীর্তিগুলোকে নিজের বলে চালানোরও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মিশরের ইতিহাসে হাতশেপসুতের অবদান এতো বেশি যে, শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। সমস্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে হাতশেপসুত ঠিকই নিজের কিছু না কিছু চিহ্ন রেখেই গেছেন। উনিশ শতকের বিখ্যাত মিশরতত্ত্ববিদ ও হায়ারোগ্লিফিক কোডার জন ফ্রান্সিস শ্যাম্পলিয়ন হাতশেপসুতের নাম আবারো সবার সামনে তুলে ধরেন। বর্তমানে মিশরে তার তৈরি এ সব স্থাপনাগুলোই পর্যটকদের কাছে পিরামিডের পরই প্রধান আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়।
শক্তিশালী ও প্রবল যোগ্যতাসমপন্ন এই নারীকে সমাহিত করা হয়েছিলো একজন ফারাও হিসেবেই, রাজাদের উপত্যকায়। বাবা প্রথম থুতমোসের পাশেই তিনি শায়িত ছিলেন। ১৯০২ সালে হাওয়ার্ড কার্টার সমাধিটি আবিষ্কার করলেও হাতশেপসুতের মমিটি সেখানে ছিলো না। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে হাতশেপসুতের মমিটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো।