ছক ভাঙার খেলায় অদ্ভুত বোহেমিয়ান যাপন যাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সমগ্র জীবদ্দশায়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম অথবা বাংলাদেশ – তাবৎ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যখনই যুদ্ধের কুচকাওয়াজ, বর্ণবিদ্বেষ, শোষণ বঞ্চনার তাণ্ডব সংগঠিত হয়েছে; তিনি গর্জে উঠেছেন লুম্পেনী লিরিক্সে। তিনি মানুষের হৃদয়ে হয়ে উঠেছেন ‘The voice of protest’। হ্যাঁ, ঠিকই আন্দাজ করেছেন। প্রসঙ্গ মার্কিন বাউল রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান। দুনিয়া তাঁকে চেনে গীতিকবি, লেখক বব ডিলান নামে।
ইংরেজীতে একটা এক্সপ্রেশন আছে ‘Appealling to the burgeoning counterculture’ – তথাকথিত সভ্যতার শীর্ষে যাঁরা বসে রয়েছেন তাঁদের ছকে বাঁধা ‘culture’ ভেঙে বেরিয়ে এসে মুক্ত, স্বাধীন, রণতাণ্ডবহীন people’s culture-এর মুখরিত প্রচারক তিনি। সব রকমের শোষণ বঞ্চনার অপচ্ছায়া অবলুপ্তির গান, প্রতিবাদের প্রতিভূ তিনি। ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথের দখলদারিত্ব নিয়েছিল সেই গিটার হাতে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ছেলেটা। ‘Blowing in the wind’ (১৯৬৩), ‘The Times They Are a-changin’ (১৯৬৪) — নাগরিক অধিকার ও যুদ্ধবিরোধী একের পর এক কালজয়ী গণসঙ্গীত তাঁর কলম থেকে ফুটে উঠে পৃথিবীর মুখ দেখেছিল। ষাটের দশক তাঁর গানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিয়েছিল। তথাকথিত শৌখিন আর্টিষ্ট্রি থেকে বেরিয়ে এসে সেই কঠিন রক্তমাখা সময়টাকে দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের মনে এঁকে দিয়েছিলেন সম্মোহিত শব্দচয়নের অদ্ভুত তুলিতে।
বিপ্লবী চে’র কথা – “If you tremble with indignation at every injustice , then you are a comrade of mine.”
যখনই প্রতিবাদ প্রতিরোধের ডাক উঠেছে তিনি কলম ধরেছেন, প্রতিরোধে গর্জে উঠেছেন – “আমার হাতে বন্দুক নেই, আমার হাতে কলম আছে।” তিনি বিক্ষোভে বিদ্রোহে গেয়েছেন –
“How many roads must a man walk down
Before you can call him a man?
How many seas must a white dove sail
Before she sleeps in the sand?
Yes, and how many times must the cannonballs fly
Before they’re forever banned?”
প্রশ্নগুলোকে তিনি গ্রেনেডের মতো সাম্রাজ্যবাদী ক্যাবারের মধ্যে ছুড়ে দিয়েছেন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে দাঁড়িয়ে। তিনি প্রশ্ন করছেন সাম্রাজবাদী যুদ্ধ পিপাসুদের – এমন কি কোনোদিন আসবে না যেদিন শান্তির বার্তাবাহী কোনো শ্বেত পায়রাকে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে না কারণ তখন চারদিকে শুধু শান্তি বিরাজ করবে?
একটা সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতিরোধের কণ্ঠ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর দেশের স্বাধীনতাকামী গণআন্দোলনের বিদ্রোহী গানে পরিণতি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহ করতে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ঐতিহাসিক কনসার্ট ‘The Concert for Bangladesh’-এ তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। গান যে সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এটা প্রমাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু এবার রবীন্দ্রনাথের পর বব ডিলান আবার তা প্রমাণ করেছেন বিশ্বের বহুধাবিভক্ত সাহিত্য দরবারে। ১৯৯০-এর দশকের কোনো এক বসন্তে তিনি কলকাতার ঢাকুরিয়ায় এসেছিলেন বন্ধু পূর্ণদাস বাউলের ছেলের বিয়েতে ঝটিকা সফরে। এই মহীরুহের গান সাম্রাজবাদীদের বিরুদ্ধে মানুষের গড়া ব্যারিকেডের এপারে প্রতিবাদের এক মূর্ত ভাষ্য।
“When the winds of changes shift
May your heart always be joyful
May your song always be sung
And may you stay forever young
May you stay forever young…!”
 
লেখা – Debabrata Das
ডিজাইন – বাপ্পাদিত্য

লেখাটি প্যারালাল ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া