১৫৭৩ সামরিক ব্যবস্থাপক এবং নির্দেশক [ইরা মুখুটির ৯৩-৯৬ পাতায় প্রেক্ষিতটা বলা আছে]

[গুজরাটের আহমেদাবাদে বিদ্রোহ দমনে আগরা থেকে একাদিক্রমে ১১ দিন ধরে ১৫৭৩ সেপ্টে-অক্টোএর অভিযান বিষয়ে মোটামুটি অনেকেই জানেন। ১৫৮৪-৮৫তে ব্রজেন্দ্রনাথ দে’র অনুবাদে শেষ বয়সে গুজরাটের মুঘল বক্সী পদে বৃত হওয়া নিজামুদ্দিন আহমেদ এর তবাকই আকবরি থেকে এই ঘটনাটা নেওয়া। নিজামুদ্দিন যদিও আকবরের সঙ্গী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর এই ঘটনা সম্পর্কে খুঁটিনাটি জ্ঞান থাকাই স্বাভাবিক।]

[আহমেদাবাদের] খান-ই-আজমের জরুরি সাহায্য চাওয়ার আবেদনক্রমে মহামহিম বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর, আমলাদের নির্দেশ দিলেন এই অভিযান সফল করার জন্যে শীঘ্র রসদ ইত্যাদি যোগাড় করার জন্যে নির্দেশ পাঠালেন। [গুজরাটে] পূর্ব অভিযান করতে অন্তত এক বছর সময় লেগেছিল। যুদ্ধ শেষ করে ফেরার সময় প্রায় কপর্দকহীন ক্লান্ত সেনা বাহিনী বিভিন্ন মুঘল জায়গির থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের পথ রসদের সমস্যা সমাধান করেছে। এবারের অভিযানে তিনি খাজাঞ্চিখানা থেকে শাহী বাহিনীর জন্যে খোলা হাতে মাইনে এবং সাম্মানিক বিতরণ করলেন। তাছাড়া তিনি আলাদা করেই যুদ্ধের উপকরণ জোগাড় জন্যে পরিকল্পনা করেছেন।

শুজাত খানের নেতৃত্বে শাহী শিবির বাহিনী অগ্রিমভাবে রওনা করিয়ে দিলেন যাতে আগেভাগেই সে পিছনে আসা বড় বাহিনীর জন্যে দ্রুত নানান রসদ যোগাড়যন্ত্র করে রাখতে পারে। তাছাড়া অগ্রগামী শাহী শিবির বাহিনীর সঙ্গে তিনি বেশ কিছু শাহী ঘোড়া দিয়ে খাজা আকা জানকে জুড়ে বাহিনীর সঙ্গে থাকা শাহী দেওয়ানি আমলাদের বাহিনীর নানা সুযোগসুবিধে দেখাশোনার নির্দেশ দিলেন। যে সব অভিজাত, আমীরকে এই অভিযান সফল করার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সাঁজাওল[মার্শাল] তাদের শহরের বাইরে রওনা করিয়ে দিল এবং অগ্রগামী শাহী শিবির বাহিনীকে রওনা হওয়ার দিনের সংবাদটি পাঠিয়ে দেওয়া হল। মহামহিম বাজিনীর সাজসজ্জা এবং রওনা করিয়ে দেওয়ার সময় স্পষ্টভাবে বাহিনীর প্রত্যেককে বারবার জানিয়ে দিয়েছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি পৌঁছবার আগে যেন একজনও যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা না দেয়। বাহিনী দৃঢ়ভাবে তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল।

মহামহিম ১৮তম ইলাহি বছর, ১৫৭৩এর ২৩ আগস্ট দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে একটি সুন্দর দ্রুতগামী কিন্তু সারাক্ষণ একই তালে চলার ক্ষমতা রাখা মেয়ে-উট জুম্মুজায় চেপে বসলেন। দরবারের আর সেনাবাহিনীর পিছনের অংশটা দুইকুঁজওয়ালা উটে চেপে তাকে নিরাপত্তা দিয়ে চলল। তিনি টোডা পৌঁছনো পর্যন্ত বাহিনীর গতিতে লাগাম টানেন নি; সেখানে তিনি রাতখাবার সারলেন; সোমবার অতিসকালেই সর্বশক্তমানের পথ নির্দেশে বাহিনীকে দ্রুত চলার নির্দেশ দিয়ে হংস মহলে একবার ছোট বিরতি দরকার হল। আবারও দ্রুত চলে মঙ্গলবার রাতের তিন পহরে মোজাবাদ গ্রামে বাহিনী উপস্থিত হয়ে শিবির ফেললেন। মহামহিমের কিছুটা ক্লান্তি আর কয়েকজন পিছনে পড়ে থাকায় আরও কিছু সময় সেখানে অপেক্ষা করে ক্লান্তি অপনোদন করে চাঙ্গা হয়ে নিলেন। পিছিয়েপড়া সাথীরা চলে এলে তিনি দ্রুতগামী গাড়ি করে বিরতি না দিয়ে সারারাত চললেন। বুধবার মাসের ২৬ তারিখ ধুলোভরা রাস্তাবেয়ে তিনি পৌঁছলেন খাজা মুইনুদ্দিন চিস্তির মাজারে। স্বর্গীয় মাজারে ফেরা লাগিয়ে কিছু সময় নিজের তৈরি অপূর্ব প্রাসাদে বিশ্রাম নিলেন। খাজার দয়ায় আজমেঢ় শহরের কাউকে ভিক্ষে করতে হয় না।

১৫৭২ সালে সুরাটে আকবরের বিজয়ী প্রবেশ

সেই সন্ধ্যেই তিনি বিশ্বজয়ী ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে ঘোড়ায় চড়ে আজমেঢ় থেকে রওনা হলেন বৈরাম খানের পুত্র, বংশসূত্রে খানইখানান উপাধিপ্রাপ্ত, পিতার দক্ষতা, বুদ্ধি বহন করা মির্জা খান, সৈফ খান কোকা, জৈন খান কোকা, খাজা আবদুল্লা কুজাক এবং নাকিব খান উপাধিপ্রাপ্ত খাজা মীর গিয়াসুদ্দিন আলি আখন্দ যাদের ইতিহাস আর জীবনীর জ্ঞান অতুলনীয় এবং মীরজাদা আলি খান, দাস্তম খান এবং মীর মহম্মদ জামান, মির্জা ইয়ুসুফ খানের ভাই, সৈয়দ আবদুল্লা খান এবং খাজা গিয়াসুদ্দইন আলি বক্সী, যিনি যুদ্ধ জয়ের পরে আসফ খান উপাধিপ্রাপ্ত হবেন, প্রত্যেককে সঙ্গে নিয়ে। পূর্ণিমার চাঁদের মত আলোছড়াতে ছড়াতে রাতেই তিনি বাহিনীকে নিয়ে বহুদূরত্ব পেরিয়েগেলেন। ফতেপুর সিক্রি থেকে রওনা হয়ে ঘটনাস্থলে আগে থেকেই উপস্থিত হওয়া শাহ কুলি খান মহরম এবং মহম্মদ কুলি খান তকবাই তাকে সালাম জানালেন। তারা সম্রাটকে জানালেন কিছু দূরে পালি শহরে বিশ্বজয়ী সেনাবাহিনী মহামহিমের জন্যে অপেক্ষা করছে। খাজা আবদুল্লা এবং আসফ খান বক্সী আর রাইসল দরবারিকে সম্মানিত করে তাদের সঙ্গে নিয়ে সম্রাট এগিয়ে চললেন।

৩০ আগস্ট ১৫৬৭৩ গুজরাটের পাটন শহর থেকে ২০ ক্রোশ দূরে দিশা শহরে উপস্থিত হলেন। [জায়গিরিদার] মীর মহম্মদ খান কালানের পক্ষে, দিশা শহরের শিকদার, বক্সী লঙ্কার পুত্র শাহ আলি শাহী মুঘল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। মহামহিম, আসফ খানকে মীর মহম্মদ খানের কাছে পাঠালেন বাহিনী নিয়ে পাটনের ৫ ক্রোশ দূরে বালিসনায় তৈরি শিবিরে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে। প্রাতঃরাশের সময় মহামহিম পাটনের রাস্তা থেকে কিছু দূরে বালিসনায় শাহী বাহিনীর জন্যে শিবির তৈরির নির্দেশ দেওয়ার মুহূর্তে সাম্রাজ্যের প্রতীকের সঙ্গে তাঁর বাহিনী নিয়ে বালিসনায় পৌঁছলেন মীর মহম্মদ খান। এছাড়া শাহী পরিবারের সেবক যেমন উজির খান, দিল্লির দুবাদার তাহির মহম্মদ খানের পুত্র নাকাবত খান এবং তৈয়ব খান উপাধিধারী শাহ ফকরুদ্দিন খান মষদি, বহু আগে ফতেপুর থেকে খানইআজমের বাহিনীতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা রাজা ভগবান দাসের ভাইপো খাঙ্গর এবং কয়েকজন রাজপুত সকলে শিবিরে পৌঁছলে প্রত্যেককে উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হল।

শিবিরে নির্দেশজারি করে প্রত্যেক বাহিনীকে পুনর্জাগরণের দিনে জড়ো হওয়ার দিনের কথা স্মরণ করে যুদ্ধের মাঠে জমায়েত হওয়ার নির্দেশ জারি করা হল। মহান আমীরেরা অভিজাতরা খোলা তরোয়াল হাতে তাদের যুবা বাহিনীকে নিয়ে, তাদের অভিজ্ঞ সেনানীদের নিয়ে যুদ্ধের মাঠে জড়ো হলেন। মহামহিম নিজে বিজয়ী বাহিনীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, সর্বশক্তিমানের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বাহিনীর কেন্দ্রে(কালব) যাকে কাউলও বলা হয়, পৌঁছলেন, যেখানে বৈরাম খানের পুত্র প্রধান সেনাপতি খানইখানান মির্জা খানের স্থান। মহামহিম, বীরউত্তম সৈয়দ মহম্মদ খান বারহা, শুজাত খান এবং সাদিক খান এবং অন্যান্যদের কেন্দ্র এবং ডান দিকের অংশ সুরক্ষায় মোতায়েন করলেন। বাহিনীর বাঁদিকের অংশটার দায়িত্ব দেওয়া হল উজির খানকে। অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হল মহম্মদ কুলি খান তকবাই এবং তারখান দেওয়ানের সঙ্গে আরও কিছু সেনানায়ককে। স্বয়ং মহামহিম কয়েক হাজার বাছাই করা ঘোড়সওয়ারের মধ্যে থেকে কয়েকশকে বেছে বাহিনীর পিছনে দাঁড়ালেন, যাতে সমস্যা হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে রসদ নিয়ে সাহায্য করতে তুরন্ত সেখানে পৌঁছে যেতে পারেন।

রক্ষাব্যুহ সাজাবার পর নিজের বাহিনী ছেড়ে না যাওয়ার কঠোরতম হুঁশিয়ারির শাহী নির্দেশনামা জারি করা হল অবলম্বে। বিপক্ষের কুড়ি হাজার সেনার তুলনায় শাহী বাহিনীর শক্তি ছিল মাত্র ৩ হাজার। সম্রাট দিনের শেষে বালিসনা থেকে আহমেদাবাদের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি একটি অগ্রসর বাহিনী পাঠালেন আহমেদাবাদে অবরুদ্ধ খানইআজমের উদ্দেশ্যে যাতে তারা বেচারাকে শাহী বাহিনী আসার সুখবর দিতে পারে। সারা রাত হেঁটে শাহী বাহিনী আহমেদাবাদের থেকে ২০ ক্রোশ দূরে কাড়ি শহরে পৌঁছল। অগ্রবাহিনী খবর আনল শাহী বাহিনীর সেনা আর ঘোড়ার পায়ের আঘাতে উড়তে থাকা ধুলোর সংকেত লক্ষ্য করে একটি সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধের জন্যে অগ্রসর হচ্ছে। বিপক্ষ বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার জন্যে একটি সেনা টুকরিকে নির্দেশ দিয়ে বলা হল তারা বাহিনীটাকে রাস্তা থেকে হঠিয়ে দেবে কিন্তু কোনওপভাবেই তারা কড়ি কেল্লা দখল করার চেষ্টা করবে না। বিশ্ববিজয়ী বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে চোখের পলক ফেলা মাত্রই বিপক্ষের বাহিনী হেরে গেল; বিন্দুমাত্র লড়াই দিতে পারল না, ভাগ্যাহতরা মারা গেল, হাতেগোণা কয়েকজন প্রাণ বাঁচিয়ে কেল্লায় আশ্রয় নিল। তাদের কেল্লা দখলে নির্দেশ না থাকায়, বাহিনী কেল্লাকে দূরে রেখে কাডি শহর ছাড়িয়ে ৫ ক্রোশ এগোনোর সংবাদ পেয়ে মহামহিম তাদের থেমে, পশু এবং বাহিনীর সেনাদের বিশ্রাম নিতে বললেন। সকাল অবদি বিশ্রাম নিয়ে তারা ভোরে নতুন করে যাত্রা শুরু করে।

সূর্যকে ছাতার মত মাথায় ধরে শাহী বক্সীরা বিশাল বাহিনীকে নিয়ে অগ্রসর হয়ে আহমেদাবাদের তিন ক্রোসের মধ্যে পৌঁছলেও তারা রাস্তায় বৃষ্টি পেলেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে মহামহিম একটি নির্দেশে বললেন যে সব সেনার কোনও যুদ্ধাস্ত্র বা যুদ্ধ সজ্জার অভাব আছে, তাদের জন্যে শাহী অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র/সমরসজ্জা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। যুদ্ধক্ষেত্রের মাঠে শাহী অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র এবং অন্যান্য সাজসজ্জা নিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল। যাদের অস্ত্র/সমরসজ্জার অভাবছিল, যাদের নিকৃষ্ট অস্ত্র/সমরসজ্জা ছিল প্রত্যেকেই ভর্তুকি পেয়ে খুশি। খাজা গিয়াসুদ্দিন আসফ খানকে শাহী বাহিনী পৌঁছনোর সংবাদ দেওয়ার জন্যে এবং খানইআজমকে বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ার সংবাদ পাঠানো হল। এবার শাহী বাহিনী আহমেদাবাদের সমতলে রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়ার জন্যে তৈরি।

ফতেহপুর সিক্রিতে বুলন্দ দরওয়াজা ১৫৭৫ সালে আকবর গুজরাটের বিরুদ্ধে তার বিজয়ের স্মরণে তৈরি করেছিলেন।

মহামহিম ফতেহপুর থেকে আহমেদাবাদের নদীর ধারের সমতলভূমিতে পৌঁছতে মাত্র ৯ দিন সময় নিয়েছেন। মহামহিম সংবাদ নিয়ে জানলেন বিপক্ষের সেনারা চূড়ান্ত অপ্রস্তুত এবং বহু সেনা মাতাল হয়ে আছে, যুদ্ধকে খুব একটা গুরুত্ব দিতেও রাজি নয়। নিজের বাহিনীকে উত্তেজিত করতে অনুপ্রাণীত স্বরে মহামহিম বললেন, ‘অপ্রস্তুত বিপক্ষকে আক্রমন করা বীরত্বের লক্ষ্মণ নয়। তাদের তৈরি হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে রাজি’। কাড়া-নাকাড়া-শিঙ্গার আওয়াজে শত্রুপক্ষের বাহিনী বিহ্বল হয়ে ওঠায় ঘোড়া আর ঘোড়সয়ারদের মধ্যে দ্রুত উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ল। [বিদ্রোহী] মহম্মদ হুসেন মির্জা দুতিনজন ঘোড়সওয়ার নিয়ে নদীতীরে এসে নিজের চোখে শাহী বাহিনী দেখলেন। মহম্মদ হুসেন মির্জা চিৎকার করে প্রশ্ন করলেন, ‘হে সেনানী এটা কার বাহিনী’? শুভান কুলি উত্তর দিল, ‘শাহী বাহিনী। সম্রাট স্বয়ং বাহিনী নিয়ে ফতেপুর থেকে এখানে এসেছেন সম্রাটের নুন খেয়েও যারা অবিশ্বাসী থেকেছে তাদের ধরাধাম থেকে মুছে দিতে’। মহম্মদ হুসেন মির্জা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার চরেরা চৌদ্দ দিন আগে ফতেহপুর থেকে শাহী বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়েছিল। এই বাহিনীই যদি শাহী বাহিনী হয়, তাহলে কোথায় তাদের হাতিযুথবাহিনী, যে বাহিনীকে কোনও দিন সেনাবাহিনীর থেকে আলাদা করা হয় না’? শুভান কুলি উত্তর দিলেন, ‘পাহাড়ের মত মস্ত বিশাল হাতিবাহিনী নিয়ে কীভাবে মাত্র কয়েকদিনে কয়েকশ ক্রোশ পার হওয়া যাবে’?

যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তীব্র অবাক এবং পালাবার পথ খুঁজে না পাওয়া মহম্মদ হুসেন মির্জা ফিরে গিয়ে বিশাল প্রান্তরে বাধ্য হয়ে সৈন্য সাজালেন। তিনি ইখতিয়ারুল মুলকের অধীনে পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন খানইআজম যাতে কোনওভাবেই কেল্লা থেকে বেরোতে না পারে সেটা নিশ্চয় করতে হবে। বিপক্ষের আক্রমণের সময় পেরিয়ে গেলে সম্রাট অগ্রগামী বাহিনীকে নদী পেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, এমন সময়ে এক সাধারণ সেনা বিপক্ষের এক সেনার কাটা মুণ্ডু নিয়ে সম্রাটের ঘোড়ার পায়ের কাছে রাখলেন। মহামহিম একে শুভ ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়ে উজির খানের বাঁদিকের বাহিনীকেও নদী পার হওয়ার নির্দেশ দিলেন। শাহী সাম্রাজ্যের ছাতা মাথায় নিয়ে সম্রাটও নদী পার হলেন।

নদী পার হওয়ার সময় বিশাল বাহিনী একসঙ্গে জলে নেমে পড়ায় সেনাবাহিনীর সমরসজ্জায় কিছুটা বিশৃংখলা তৈরি হল। জল কেটে কিছুদূর এগিয়ে পাড়ে ওঠার পর শাহী বাহিনী অনতিদূরে বিশাল বিপক্ষের বাহিনী দেখেতে পেল। ১৫০০ আত্মনিবেদনী অগ্রগামী সেনাবাহিনী স্বয়ং মহম্মদ হুসেন মির্জার নেতৃত্বে মহম্মদ কুলি খান তোকবাই এবং তারখান দেওয়ানের বাহিনীকে আক্রমন করে। বিদ্রোহীদের আরও একটা হাবসি এবং আফগান বাহিনী উজির খানের বাহিনীকে আক্রমন করায় যুদ্ধ এখন হাতাহাতি লড়াইতে পর্যবসিত হল।

শাহী অগ্রগামী বাহিনীর দুর্বলতা এবং আতান্তর অবস্থা দেখে সম্রাট রাগী বাঘের মত সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিপক্ষ বাহিনীর ওপরে। সম্রাটকে তীব্রভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে প্রাণহাতে নিয়ে ‘ইয়া মুমিন’ যুদ্ধচিতকারে প্রত্যেকটি শাহী সেনা যেন তিনজন হয়ে লাফিয়ে পড়ল বিপক্ষের বাহিনীর ঘাড়ে। সৈয়দ খান কোকা ব্যর্থ আক্রমণের পরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে শহীদ হলেন। বিদ্রোহী পক্ষের মহম্মদ হুসেন মির্জা আর শাহ মির্জা প্রথম সময়ে কিছুটা প্রতিরোধ খাড়া করার পরে, যখন বুঝতে পারলেন তারা একটা হারা লড়াই লড়ছেন, যুদ্ধক্ষেত্রকে পিছনে রেখে পালিয়েগেলেন, বাকি শত্রু বাহিনী কচুকাটা হল। মাত্র কয়েক হাজার সেনা নিয়ে মহামহিম এক মহান বিজয় হাসিল করলেন।

আহত বিদ্রোহী মহম্মদ হুসেন মির্জা ঘোড়া চেপে পালাতে চেয়ে কাঁটা-ঝোপ টপকাতে ঘোড়া ঘাড় মটকাল, তিনি ঘোড়ার তলায় পড়লেন। পিছন নেওয়া শাহী বাহিনীর জনৈক তুর্কি সেনা গাদা আলি, ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে হুসেন মির্জাকে বন্দী করে। শত্রুপক্ষের বাহিনীর বাঁদিকের অক্ষের দায়িত্বে থাকা সেনাপতি উজির খান প্রাণ হাতে নিয়ে লড়লেন। হাবসি আর গুজরাটি বিদ্রোহীরা শেষ অবদি লড়ে বার বার বিভিন্ন প্রান্তে আক্রমন শানাতে শানাতে মহম্মদ হুসেন মির্জার হেরে যাওয়ার সংবাদ শুনে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পালাতে থাকে। ডানদিকের অক্ষের সেনাপতি মীর মহম্মদ খান বিদ্রোহী শের খান ফৌলাদির বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করে তার তরোয়ালে বিদ্রোহী নেতাকে মাটির সঙ্গে গেঁথে ফেলল এবং সেখানেই যুদ্ধ প্রায় শেষ।

সম্রাটের ভাগ্যাকাশের উদিতসূর্যের রশ্মির বিজয় ঘোষণা যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিটা কোণাকে শুদ্ধ করেছে। খান কালানের বাহিনীর গদা আলি এবং অন্য এক সেনা আহত মহম্মদ হুসেন মির্জাকে বন্দী করে সম্রাটের সামনে আনলেন, নদীর পাড়ের প্রতিরোধের খাড়াই দেওয়াল থেকে মহামহিম লাফিয়ে নেমে সর্বশক্তিমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। আগত দুই দুজনেরই দাবি তারাই বিদ্রোহী নেতাকে গ্রেফতার করেছে। রাজা বীরবল প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাকে কে গ্রেফতার করেছ’?  মহম্মদ হুসেন মাথা নামিয়ে জানালেন, ‘মহামহিমের নুনের প্রতি আনুগত্য আমার বন্দীত্বের কারন’। কী সত্যই তিনি বলে উঠলেন! মহামহিম তাকে যথাবিহিত তিরষ্কার করে রাই সিংহের হাতে তুলেদিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিদ্রোহী দলের বন্দীদের বিচার করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হল জনৈক ভিক্ষুক হুসেন মির্জা। তার দাবি সে বিদ্রোহী নেতার কোকা ভাই। অবিলম্বে পুণ্যবান সম্রাট হাতে ধরা বল্লম ছুঁড়ে তাকে হত্যা করলেন, উপস্থিত সেনার তীরে তার দেহ ছিন্নবিছিন্ন হয়েগেল। জানাগেল সারনালের যুদ্ধে এই ব্যক্তি রাজা ভগবান দাসের ভাইকে হত্যা করেছিল।

সারনালের যুদ্ধ, ১৫৭২, আকবরনামা

বিজয়লাভের একঘন্টাও ব্যয় হয় নি বিদ্রোহীদের একটা বাহিনী ফিরে আসার সংবাদে শাহী বাহিনী সচকিত হয়ে ওঠে। অগ্রগামী বাহিনী সংবাদ নিয়ে এল খানইআজমের রাস্তা আটকে রাখা ইখতিয়ারুল মুলক গুজরাটির নেতৃত্বে শত্রু বাহিনী মহম্মদ হুসেন মির্জার পতনের সংবাদে কেল্লা অবরোধ ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। মহামহিম নির্দেশ দিলেন শাহী অগ্রগামী বাহিনীকে তুরন্ত এগিয়ে গিয়ে জীবনহরণ তীরান্দাজীতে শত্রুপক্ষকে হারিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিশ্চিতভাবে হঠিয়ে দিতে হবে। নির্দেশ জারি হতে না হতেই বিপক্ষের সেনানায়ক ইখতিয়ারুল মুলক আর তার বাহিনীর আবির্ভাব ঘটলে কয়েকজন মাত্র রক্তপিপাসু ঘোড়সওয়ার এগিয়ে গিয়ে বিপক্ষের বাহিনীকে তীব্র গতিতে আক্রমন করলে নেতাশুদ্ধ বাহিনী প্রতিরোধের দেওয়ালের দিকে, যেখানে শাহী নিশানটি উড়ছিল, পাশ দিয়ে পিঠটান দিতে বাধ্য হয়। আতঙ্কিত ইখতিয়ারুল মুলকের বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় শাহী বাহিনী বিপক্ষের সেনাকে চাঁদমারি করে মারতে শুরু করে।

ইতিমধ্যে জনৈক তুর্কমান সেনা শুহরাব বেগ ইখতিয়ারুল মুলককে চিনেফেলে তার পিছু ধাওয়া করে। ইখতিয়ারুলের ঘোড়াও কাঁটাঝোপ লাফ দিয়ে পেরোতে গিয়ে ঘাড়মুড়ে পড়ে মারা যায়। শুহরাব ঘোড়া থেকে নেমে ইখতিয়ারুলকে গ্রেফতার করে। ইখতিয়ারুল মুলক শুহরাবকে বলে, ‘তোমায় দেখে তুর্কমান মনে হচ্ছে। তুর্কমানেরা মুর্তাজা আমীর দাস[অনুগত]! সর্বশক্তিমান তাঁকে আশীর্বাদ করুন। আমি বুখারার সৈয়দ। আমায় মেরো না’। শুহরাব বেগ বলল, ‘আমি তোমার চিনেছি বলেই তোমার পিছু নিয়েছি, তুমিই ইখতিয়ারুল মুলক’। শুহরাব তরোয়াল বের করে তার মাথা ছিন্ন করল। ঘুরেই দেখে কেউ তার তুর্কি ঘোড়াটি চক্ষুদান করেছে। জামার ঝুলে কাটা মাথাটি মুড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে সম্রাটের অবস্থানের দিকে সে এগোতে থাকে।

যখন ইখতিয়ারুল মুলক পালিয়ে যাচ্ছে নদীর তীর বেয়ে, সম্রাটের উপস্থিতিতে রাই সিংহের যে সব রাজপুত সেনা মহম্মদ হুসেইন মির্জার দায়িত্বে ছিল, তারা তাকে হাতির পিঠ থেকে নামিয়ে এনে তাদের বল্লম দিয়ে হত্যা করল।

বিজয়ের পরে ঘেরাও হওয়া খানইআজম এবং অন্যান্য আমীর এসে সম্রাটের পা চুম্বন করার সম্মান পেলেন। মহামহিম ঔদার্য দেখিয়ে আজম খানকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বহু সম্মান এবং উপহারে সম্মানিত করলেন।

প্রত্যেক আমীর অভিজাত তাদের পদাধিকার আর স্তর অনুযায়ী সম্মান আর উপহার পেলেন। আমীরদের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষ হয় নি এমন সময় তুর্কইমান শুহমান বেগ এসে ইখতিয়ারুল মুলকের কাটা মাথা মহামহিম শাহের পদতলে লুটিয়ে দিল। সর্বশক্তিমানের দানে তিনি বারংবার তাঁর নাম উচ্চারণ করলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ২০০০ বিদ্রোহীর কাটা মাথা দিয়ে মিনার তৈরি করার নির্দেশ দিলেন যাতে এই মিনার দেখে যে কোনও মানুষের বিদ্রোহ করতে হৃদয় কেঁপে ওঠে।

যুদ্ধের সাফল্য এবং শত্রু বিজয়ের আনন্দে সম্রাট গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদের দিকে অগ্রসর হয়ে সুলতানের প্রাসাদকে নিজের আবাসগৃহ বানালেন। শহরের বিখ্যাত আমীর, অভিজাত, সমাজের বিভিন্নস্তরের মানুষ, কারিগর উপহার নিয়ে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বিজয় উদযাপন নিয়ে প্রচুর সভা এবং সম্বর্ধনা আয়োজন করা হল। প্রাসাদে আনন্দ উপভোগের চারটি মহার্ঘ দিন কাটিয়ে সম্রাট শহরের মাঝখানে অবস্থিত ইতিমদ খানের বাড়িতে গিয়ে যে সব মানুষ সেনানী অংশ নিয়েছেন তাদের নানান উপহার এবং সম্মান দিলেন। তাঁর নির্দেশে প্রতিজন সেনানায়কের পদোন্নতি হল এবং মাইনে বাড়ল। তাছাড়া লেখকদের বিজয় কাহিনী বয়ান করার নির্দেশ দিলেন। মহম্মদ হুসেইন মির্জা আর ইখিতিয়ারুল মুলকের মাথা আগরা এবং ফতেপুরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হল।

মহামহিম আহমেদাবাদের প্রত্যেক মানুষের হৃদয় জয় করার পর প্রত্যেককে শান্তি আর সুরক্ষার ভবিষ্যৎ উপহার দিলেন।

১৫৭৪-৭৫ দূরদৃষ্টি এবং কার্যক্রম – সাম্রাজ্যের কাঠামো তৈরির উদ্যম

[সম্রাটের ১৯তম শাসনবর্ষে ১৫৭৪-৭৫ রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করার জন্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করলেন। প্রত্যেক মুঘল আমলা/ভৃত্য/কর্মচারী একদেহী মনসবের অধিকারী হলেন। বাহিনীর সংখ্যার ওপর নজরদারি করতে দাগ ব্যবস্থার প্রবর্তন হল। আঞ্চলিক জমিদারির ভূখণ্ডকে খাজনাকে নির্দিষ্ট আমলার খরচ তোলার জন্যে দেওয়া হল খালিসার অন্তর্ভূক্ত করে। তাছাড়া রাজত্বের জমি মাপন করে যে অর্থনৈতিক তথ্য তৈরি হল, সে সব অবলম্বন করে নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হল। আমরা প্রশাসনিক কাঠামো সংস্করের বয়ান আবুলফজলের আকবরনামা থেকে নিয়েছি।]

আবুলফজলের সরকারি বয়ান

তাঁর রাজত্বে এমন কোনও বছর বা মাস অতিবাহিত হয় নি, যে বছর বা মাসে মহামহিম সম্রাট অতুলনীয় দূরদৃষ্টি অবলম্বন করে নতুন সংস্কার নীতি প্রবর্তন করেন নি। তিনি দূরের দিকে তাকিয়ে সাম্রাজ্যের বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকায় সেনাবাহিনী এবং কৃষকদের জন্যে আরও ভাল পরিবেশ তৈরি করতে সচেষ্ট হলেন। তিনি সাম্রাজের বিস্তার ঘটিয়েছেন, সাম্রাজ্যের সম্পদ বাড়িয়েছেন, নানা ধরণের আইন তৈরি করেছেন, কঠোর অনুসরণযোগ্য নীতিমালা তৈরি করিয়েছেন। তাঁর সংকারের অন্যতম প্রধানটি হল দাগ প্রথা প্রবর্তন। কোনও বাহিনীর সেনাপতি(তাবইনবাসি) দরবার থেকে তার বাহিনীর ভরণপোষণ করার জন্যে যে অর্থ পেতেন, সেগুলি তিনি সেনা্দের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন না; ফলে অধিকাংশ সেনা প্রভুদের কথা শুনত না, নির্দিষ্ট কোনও এক বাহিনীতে অর্থ/রসদ বকেয়া থাকলে সে অন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হত। সাধারণ সেনা প্রভুদের অর্থ লোভের শিকার হত। এই পরিকল্পনায় খুচরো সেনাদের বাহিনীর প্রতি আনুগত্য তৈরি হত না, ফলে মাঝেমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এই বছর ১৫৭৪এ পূর্ব দিকে সাম্রাজ্য বাড়াবার আগে সম্রাট সাম্রাজ্যের আমলাদের সঙ্গে এ ধরণের সংস্কার বিষয়ে আলাপআলোচনা শুরু করেন। কিন্তু বাংলা জয় সম্পূর্ণ হওয়ার আগে আর এ বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয় নি। বঙ্গ অভিযান থেকে বাহিনী ফিরে এলে নতুন করে এই আলাপআলোচনার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়; দাগ এবং মনসব বিষয়ে আলাদা আলাদা নীতি তৈরি এবং প্রযুক্ত হয়। সাম্রাজ্যের কৃষকদের খুশি নিশ্চয় করতে এবং সাম্রাজ্যজুড়ে প্রশাসনের ওপর নজর রাখতে তিনি সামগ্রিক সাম্রাজ্যের জমিকে খালিসার অধীনে নিয়ে আসেন। একটা দীর্ঘ সময় ধরে মহামহিম নিজেকে লুকিয়ে রেখে, নিজেকে সামনে না এনে সাম্রাজ্যের আমলাদের গুণাগুন ইত্যাদি পরীক্ষা করছিলেন; তারা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল, শহর, নগর এবং গ্রামে এস্টিমেটেড রেভিনিউ বা আনুমানিক আয় বা জমার পরিমান কোথাও বাড়িয়ে কোথাও কমিয়ে অর্থ তছরূপ করছিল। যে সব জমিদার মনসবদার আমলাদের বেশি অর্থ দিত, তাদের জন্যে লাভের দরজা খোলা থাকত আর যারা দিতে পারত না তারা হেরে যেত। যারা কম সুযোগ পেত, তারা বারবার অভিযোগ জানাত। বর্তমানে আকাশ পরিষ্কার হয়েছে, সম্রাট তার ঘোমটা খুলে বিভিন্ন বিষয় নিজে দেখছেন; তার অন্যতম উদ্যমটাই হল সাম্রাজ্যের সমগ্র জমিকে খালিসার অধীনে নিয়ে আসা। দরবারি অভিজাত এবং আমলাদের নগদ অর্থে, উলুফাইনকদ বিদায় দেওয়া হল। প্রখ্যাতদের আনুগত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রত্যেককে নির্দিষ্ট মনসবদারি দেওয়া হল।

দক্ষ আর ভরসাযোগ্য মানুষদের নিয়োগ করে হিন্দুস্তানের মাপজোক, জাবত করা হল এবং সেই অঙ্কের হিসেবের ওপর দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায় হালইহাসিল নির্দিষ্ট করা হল যাতে অত্যাচারীরা আর অত্যাচারের সুযোগ না পায়। বাংলা, বিহার আর গুজরাটে পুরোনো সময়ের হিসেব/আদায় রেখে দেওয়া হল; কাবুল, কান্দাহার, গজনি, কাশ্মীর, থাট্টা, স্বাদ, বাজাউর, তিরথ,বাঙ্গাশ, সৌরাথ এবং ওডিসা যেহেতু বিজিত হয় নি, তাই ১৮২জন রাজস্ব আদায় করা আমলা, আমিলকে খালিসা জমির রাজস্ব আদায়ের নিয়োগ দেওয়া হল। প্রত্যেক আমিলএর ওপর ১ কোটি টাকা তুলে দেওয়ার বরাত দেওয়া হল, জনগণের ভাষয় এদের নাম হল ক্রোড়ি।

সম্রাটের পরিকল্পিত সংস্কারের বার্তা বিশ্বস্তভাবে প্রশাসনের নানানস্তরে বয়েনিয়েগেলেন শাহাবাজ খান, খাজা গিয়াসুদ্দিন, আলি আসফ খান, রায় পুরখোত্তম এবং রাই রাম দাসের মত উচ্চপদস্থ আমলা। ফলে একদিকে যেমন সেনাবাহিনীতে আনুগত্য ফিরল, সেনারা ঠিকমত রেস্ত পেতে শুরু করল, তেমনি দেশ পেল যথাযোগ্য সরকার একইসঙ্গে প্রশাসনে স্থিতিশীলতা এল, প্রশাসনিক প্রতারণা এবং অর্থ তছরুপের প্রবণতা কমল।

এর পাশাপাশি ঠিকমত জমি মাপের (জারিব) ব্যবস্থা করে মহামহিম রাজত্বের বৃহত্তর আর্থিক সমৃদ্ধির সূচনা করলেন। এর আগে জমি মাপের জন্যে যে দড়ি ব্যবহৃত হত তার মাপ এলাকা অনুযায়ী কমত বাড়ত, ভিজালে বা শুকনো করলে দড়ি ছোট/বড় হত, এর সুযোগ নিত অসাধু আমলারা। তিনি লোহার শিকলি দিয়ে কয়েকটা নির্দিষ্ট মাপের বাঁশ বেঁধে মাপন দণ্ড তৈরি করলেন। এইধরণের সত্যনিশ্চয় করা নানান প্রযুক্তি প্রয়োগ মার্ফৎ দুর্ণীতি সহ্য করতে থাকা মানুষের বিক্ষুব্ধ মন শান্ত হল, দেশে চাষের প্রসার হল দুষ্কর্ম আর মিথ্যাচারের কবর তৈরি হল।

তাছাড়া সম্রাট নির্দিষ্ট উপায়ে যথাযোগ্য তথ্য/সংবাদ নথিকরণের জন্যে প্রশাসনিক গাণিতিক হিসেবে দক্ষ কিছু মুন্সি নিয়োগ করলেন। মহামহিম এই দুরন্ত ভাবনাটি সরকারি নির্দেশবলে কার্যকর করেন। তাঁর নির্দেশে প্রশাসনিক আয়-ব্যয় খুঁটিয়ে দেখা হতে শুরু হল, তিনি সে সব হিসেবের খুঁটিনাটির সমস্যাগুলো দরবারে ব্যখ্যা করতেন যাতে সাম্রাজ্যের আমলারা সেসব থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সর্বশক্তিমানের দুয়ায় মহামহিমের মনে যে সব প্রশাসনিক সংস্কারের ভাবনা আসত সেগুলোকে বাস্তবে যথাযথ রূপদেওয়া গিয়েছে। এই সংস্কারগুলো প্রয়োগ করার মাধ্যমে আমরা যেন সর্বশক্তিমানেরই উপাসনা করতে পারছি। সাম্রাজ্যের নীতিমালাগুলি আইনিআকবরির শেষ খণ্ডে বিশদে উল্লিখিত হয়েছে।

১৫৭৫-৭৬ ইবাদত খানায় আকবর এবং ধর্মতাত্ত্বিকেরা

[১৫৭৫-৭৬এ সম্রাট আকবর ফতেহপুর উপাসনাগৃহ, ইবাদতখানা তৈরি করলেন মুসলমান ধর্মতাত্ত্বিকদের সঙ্গে আলাপআলোচনার উদ্দেশ্যে। কেন তিনি ইবাদতখানা তৈরি করলেন, ধর্মতাত্ত্বিকদের সঙ্গে আলাপআলোচনায় তিনি কী লাভ অর্জন করেছেন, সে সব বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন ঐতিহাসিক বাদাউনি। ইবাদতখানার আলোচনাসভাগুলোয় অন্যতম আমন্ত্রিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন বাদাউনি। আকবইরের দরবারের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন প্রখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক মখদমুল মুলক আবদুল্লা সুলতানপুরী; আকবর তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে সম্পূর্ণভাবে খুশি ছিলেন না। তিনি ধর্মআলোচনাসভার জন্যে ইবাদতখানা তৈরি করলেন যেখানে অন্যান্য ধর্মের তাত্ত্বিকরাও উপস্থিত থাকতেন। এই অংশটা নিয়েছি বাদাউনির মুন্তাখাবুলতাওয়ারিখ থেকে। অনুবাদ করেছি শিরিন মুসভির মূলের ইংরেজি অনুবাদ থেকে।]

১৫৭৫-৭৬এ ইবাদতখানা তৈরি সম্পূর্ণ হল। ইবাদতখানা তৈরির গভীর উদ্দেশ্য ছিল। অতীত বছরগুলিতে সম্রাট একেরপর এক যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছেন, প্রতিদিন সাম্রাজ্যের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে, সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকল না। মহামহিম সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গ খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন, [আজমেঢ়ের] প্রয়াত মুইন চিস্তির সঙ্গে তিনি দীর্ঘসময়ধরে সর্বশক্তিমান, মহান নবী এবং অতীন্দ্রিয়বাদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতেন। দর্শন আর আইন আলোচনাতেও তার দিলচস্তপি কম ছিল না। মহামহিম রাতভর সর্বশক্তিমানের গুণগান করতেন; তিনি বারংবার ‘ওহ তিনি [সর্বশক্তিমান]’ ‘ওহ পথনির্দেশক’ আবৃত্তি করে তাঁর গুণগুন করতেন। সত্যকারের সর্বশক্তিমান-দাতার জন্যে তার হৃদয় সদা উতসর্গিত থাকত; সম্রাট তার অতীত সাফল্যের জন্যে সর্বশক্তিমানকে কৃতজ্ঞতা জানাতে প্রায় প্রতিদিন ঊষাকালের ওম মেখে আগরা প্রাসাদের থেকে বহুদূরে পুরোনো এক পাথরের গুহায় একা একা ধ্যানে সময় কাটাতেন। তিনি শুনেছিলেন বাংলার শাসক সুলেইমান করনানি প্রতি সকালে প্রায় ১৫০ জনের মত শেখ আর উলেমার সঙ্গ সান্নিধ্যে, মহান নবীর নাম এবং কাজকর্ম ইত্যাদি আলোচনা করে সময় কাটাতেন। সকালের উপাসন শেষ হলে তিনি সেনাবাহিনী, রাষ্ট্র এবং প্রজাদের কাজে সময় ব্যয় করতেন। তাছাড়া বাদাকশনের শাহজাদা মির্জা সুলেইমানের অতীন্দ্রিয়তার ওপর তীব্র আকর্ষণ ছিল; ভাবাবেশের আকর্ষণে তাঁর বহু অনুগামীও তৈরি হয়েছিল। এইসব আধ্যাত্মিক উদাহরণে মহামহিম উদ্বুদ্ধ হয়ে একদা শেখ ইসলাম চিস্তির অনুগামী, পরে মোকাম পাল্টে মহাদিভি গোষ্ঠীতে অন্তর্ভূক্ত হওয়া আবদুল্লা নিয়াজি শিরহিন্দির অনুগামী হন। তাঁর গুরুর জন্যে সিক্রির এই পাহাড়ি জায়গায় চারদিক ঘিরে একটি প্রেক্ষাগৃহ বানান। একই সঙ্গে অনুপ তালাও নামে একটি বড় জলাশয়ও তৈরি করেন। তিনি প্রেক্ষাগৃহটির নাম দেন ইবাদতখানা, উপাসনাগৃহ যা পরে ইয়াদত খানায়(অসুস্থদের ঘর) রূপান্তরিত হয়।

ইবাদতখানায় আকবর

শুক্রবার উপাসনার পর মহামহিম শেখ ইসলামের নতুন তৈরি বাসস্থানে নিয়মিত গিয়ে সেখানকার উপাসনা গৃহে বৈঠক করতেন। মহামহিম সেখানে কিছু শেখ, কিছু উলেমা, কিছু পূণ্যাত্মা আর কয়েকজন সহকারী নিয়ে আলাপআলোচনায় বসতেন। বিভিন্ন ব্যবহারিক বিষয় সেই সব আলোচনায় উঠে আসত। আমার পৃষ্ঠপোষক জালাল খান কুর্চি দরবারে আমার অন্তর্ভূক্তির আলোচনায় মহামহিমকে বললেন, ‘আমি সেদিন আগরায় শেখ মহম্মদ ঘাউসের পুত্র শেখ জিয়াউল্লাহের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে দেখি, তাদের জীবনে দারিদ্র ঘিরে ধরেছে; মনে আছে একদিন আলোচনা শেষে তিনি আমার থেকে এক সের দানাশস্য চাইলেন। এর একাংশ তিনি নিজের জন্যে ব্যবহার করবেন, একাংশ আমায় দেবেন, আর একাংশ বাড়ির মানুষদের খাদ্য হিসেবে পাঠাবেন’। তাঁর এই কথা শুনে সম্রাটের হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠল; একদিন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ইবাদতখানায় তাঁর সম্মানে একটি বৈঠক আয়োজন করলেন। প্রতি শ্রক্রবার রাতে[অর্থাৎ প্রতি শুক্রবারের আগের রাতে] তিনি সৈয়দ, শেখ, অভিজাত আর উলেমাদের আমন্ত্রণ জানাতেন। আমন্ত্রিতদের বসারক্রম নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হলে প্রত্যেকের বসারক্রম নির্দিষ্ট করেদিলেন স্বয়ং মহামহিম। তিনি নির্দেশ দিলেন অভিজাতরা বসবে পূর্ব দিকে, সৈয়দেরা পশ্চিমে, উলেমারা দক্ষিণে আর শেখেরা উত্তরে। তিনি মাঝেমাঝে প্রত্যেক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসে সত্য এবং বিশ্বাসসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। আলচনাসভা চালানোর সময় বিপুল পরিমান সুগন্ধী জ্বালানো হত। সম্রাটের অভিজাত দরবারিদের সুপারিশে যেসব মাননীয় ব্যক্তি ইবাদতখানায় প্রবেশ করতেন, তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের দক্ষতা এবং বৌদ্ধিকতার সম্মান অনুযায়ী বিপুল অর্থ সাহায্য দেওয়া হত। ইতিমদ খান গুজরাটির গ্রন্থাগারের বহু উল্লেখযোগ্য বই এবং গুজরাট অভিযানে যে সব দখল করা বই শাহী গ্রন্থাগারে রাখা ছিল, সে সব পূণ্যাত্মা এবং অন্যান্য জ্ঞানীর মধ্যে বিতরণ করা হল। তাঁর হাত থেকে আমি যে সব বই পেয়েছিলাম, তার মধ্যে উজ্জ্বলতমটি ছিল মাশকুতুলআনোয়ারের জোড়াপাতার অংশ আনোয়ারুলমাশকুট। আর যেসব বই [বিতরণ করা হল না] পড়ে থাকল, সে সব অর্থের বিনিময়ে ‘ইরমাস’ বা শত্রু ধ্বংসকারী হিসেবে বিতরণ করা হল।

এই ধরণের আলোচনা চলতে চলতে এক রাতে এক বর্ষীয়ান উলেমা গলার ধমনী ফুলিয়ে তীব্র চিতকার শুরু করায় ইবাদতখানায় তীব্র গোলযোগ শুরু হল। উলেমাদের গর্হিত ব্যবহারে তীব্র ক্ষুব্ধ হয়ে মহামহিম আমায় জানালেন, ‘ভবিষ্যতে তোমার যদি মনে মনে হয় কোনও ব্যক্তি আংসাং ভুলভাল বকছে, তুমি আমায় জানাবে। আমি তার এখান থেকে বার করে দেব’। আমি নিচুস্বরে আসফ খানকে জানালাম, ‘আমায় যদি সম্রাটের নির্দেশ মান্য করতে হয়, অধিকাংশ উলেমাকে এই প্রেক্ষাগৃহ থেকে বহিষ্কারের প্রস্তাব দিতে হবে’। নিচুস্বরে কী বললাম শুনতে না পেয়ে মহামহিম জিজ্ঞাসা করলে, আমি জানালাম আসফ খানকে আমি কী বলেছি। মহামহিম আমার জবাবে খুবই তুষ্ট হলেন, এবং তার পাশে বসা কয়েকজনকে আমার বক্তব্যটা নতুন করে শুনিয়ে দিলেন। তিনি প্রায়শই মুখদুমুল মুলক মৌলানা আবদুল্লা সুলতানপুরীকে অসন্তুষ্ট করার জন্যে ইবাদতখানায় নিয়ে আসতেন। তার বিরুদ্ধে হাজি ইব্রাহিম শেখ আবুলফজল এবং আরও নতুন আসা তাত্ত্বিকদের লড়িয়ে দিয়ে মজা দেখতেন। প্রত্যেকেই আবদুল্লা সুলতানপুরীর প্রতিটা বাক্যের বিরুদ্ধাচরণকরে বক্তব্য পেশ করতেন। মাঝেমাঝের সম্রাটের ইঙ্গিতে কিছু দরবারি অভিজাতও তাঁর সামনে এমন কিছু প্রশ্ন নিয়ে আসতেন যা দিয়ে তাকে তুচ্ছ করা যায় এবং তার তত্ত্বে ঠুকরোনো যায়; তাছাড়া তার সম্বন্ধে নানান অদ্ভুত গপ্প বলতেন।