ইনকার সোনাই কি ইউরোপের পরাশক্তি হয়ে উঠবার প্রধান যোগানদাতা?, Stay Curioussis

১৫৩২ সাল। ইনকা সাম্রাজ্যের ছোট্ট শহর কাজামার্কা। সবেমাত্র শেষ হয়েছে গৃহযুদ্ধ। স্বর্ণভূমি ইনকায় বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাস বইতে শুরু করেছে। সম্রাট আতাহুয়ালপা আজ ভীষণ প্রফুল্ল। প্রকৃতি ও গৃহযুদ্ধের বিজয়কে উপভোগ করছেন তিনি। প্রস্তুতি নিচ্ছেন রাজধানী কুজকোতে জয়োল্লাসের সাথে প্রবেশের। ঠিক এমন সময় আতাহুয়ালপার সাম্রাজ্যে অনুপ্রবেশ ঘটলো এক অযাচিত অতিথির। সুদূর স্পেন থেকে আগত এই ফ্যাকাশে বর্ণের অতিথিরা তামাটে বর্ণের সহজ-সরল ইনকাদের কাছে ছিলো দেবতাতুল্য। এই অদ্ভূত ও অবাঞ্ছিত বিশ্বাসই কাল হয়ে দাঁড়ালো আতাহুয়ালপাদের জন্য। লোভী স্পেনীয়দের ফাঁদে নিজে থেকেই পা রাখলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ধনী সাম্রাজ্যের অধিপতি আতাহুয়ালপা। এভাবেই ধ্বংস হয়ে গেলো সমৃদ্ধ স্বর্ণসভ্যতা ইনকা। এ যেনো আরও একবার হার্নান্দো কোর্তেসের অ্যাজটেক হননেরই পুনরাবৃত্তি।

MAP OF THE INCA EMPIRE Scaled, Stay Curioussis

ইনকা সাম্রাজ্যের মানচিত্র

‘ইনকা’ শব্দটির অর্থ হলো ‘সূর্যের সন্তান’। সূর্যের উপাসক এই জাতির চিরাচরিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সূর্যদেবতাই এই সভ্যতার জন্মদাতা। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই সাম্রাজ্য ছিলো ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, চিলি ও উত্তর আর্জেন্টিনা পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলোম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর স্পেনে ফিরে গিয়ে এর স্বর্ণপ্রাচুর্যের কথা যেভাবে প্রচার করেছিলেন, তা স্পেনীয়দের মনে এক অদম্য লোভের জন্ম দিয়েছিলো। ১৫২০ সালে হার্নান্দো কোর্তেসও এই লোভের বশবর্তী হয়েই অ্যাজটেক সাম্রাজ্য (বর্তমান মেক্সিকো) আক্রমণ করেছিলেন এবং তার প্রায় বারো বছর পর একই লোভ পেয়ে বসে ফ্রান্সিসকো পিজারো গঞ্জালেসকে। কোর্তেসের পদচিহ্ন অনুসরণ করেই যেনো ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে কিছুটা দূরে দক্ষিণ আমেরিকায় এবার নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন স্পেনীয় কমান্ডার পিজারো।

%E0%A6%9B%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87 %E0%A6%AB%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A7%8B %E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8B %E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9C, Stay Curioussis

ফ্রান্সিসকো পিজারো গোঞ্জালেজ, © Wikipedia

স্পেনের একজন অবৈধ সন্তান হিসেবেই বেড়ে ওঠা ফ্রান্সিসকো পিজারো গঞ্জালেসের। মায়ের পরিবারে অবহেলায় বড় হওয়া ও নিজের বাবার অধীনে একজন কর্মচারীর মতো আচরণ পাওয়া পিজারো ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে একরাশ ঘৃণা পুষে রেখেছিলেন। সামান্যতম অক্ষরজ্ঞান লাভেরও সুযোগ হয় নি তার। মায়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর তার জীবন আরও দুঃসহ হয়ে ওঠে। পরিণত বয়সে একজন বেপরোয়া ও নিষ্ঠুর মিলিটারী ব্যক্তিতে পরিণত হন পিজারো।

গভর্নর পেড্রো অ্যারিয়াস দাভিলার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার সুবাদে পিজারো প্রাচুর্যের দেশ পেরুর দিকে অগ্রসর হবার অনুমতি পান। তিনি একজন স্পেনীয় ধর্মযাজক হার্নান্দো ডি লুক এবং স্পেনীয় সৈন্য ডিয়েগো ডি অ্যালমার্গোকে নিয়ে তার প্রথম অভিযান পরিকল্পনা করেন। অর্জিত সম্পদকে নিজেদের মধ্যে সুষমভাবে বন্টনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন তারা। অভিযানের নেতৃত্বে থাকতেন পিজারো, ধর্মযাজক ডি লুক অর্থ ও রসদ সরবরাহ করতেন এবং অ্যালমার্গো সরবরাহ করতেন সৈন্য ও খাদ্য। ১৫২৪ এবং ১৫২৬ সালে পেরুর দিকে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করেন পিজারোরা। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাদের দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়।

ইনকা সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য তৃতীয় অভিযানের প্রস্তুতি নিতে চাইলে নতুন-নিযুক্ত গভর্নর পেড্রো ডি লস রিয়স তা নাকচ করে দেন। তাই পিজারো এবার সরাসরি চলে যান রাজা পঞ্চম চার্লসের কাছে। এর আগে হার্নান্দো কোর্তেসের অ্যাজটেক অভিযানের সফলতা থেকে আসা বিপুল পরিমাণ সম্পদ রাজা পঞ্চম চার্লসের মনে ভীষণ লোভের জন্ম দেয়। তাই তিনি পিজারোকে ইচ্ছেমতো যে কোনো অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়ে দেন। সেই সাথে দিয়ে দেন পর্যাপ্ত অনুদানও।

Atahualpa, Stay Curioussis

ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা © National Geographic

অন্য দিকে আতাহুয়ালপা অনেক দিন ধরেই তার বৈমাত্রেয় ভাই হুয়াস্কার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। বাবার মৃত্যুর পর ইনকা সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিবাদের কারণে ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী এক গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয় দুই ভাইয়ের মধ্যে। ১৫৩২ সালে সংঘটিত এ যুদ্ধে আতাহুয়ালপা বিজয় লাভ করেন এবং ভাই হুয়াস্কাকে হত্যা করে একটি শান্তিপূর্ণ সাম্রাজ্য রচনার স্বপ্ন বুনতে থাকেন। ঠিক এমন সময় কাজামার্কাতে এসে পৌঁছান পিজারো।

পিজারো মাত্র ১৮০ জন সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে কাজামার্কায় এসেছিলেন। বিশাল ইনকা সেনাবাহিনীর সংখ্যার তুলনায় তা ছিলো একেবারেই নগণ্য। তাই আতাহুয়ালপার মনে সামান্যতম ভয়েরও সঞ্চার হয় নি। উল্টো পিজারোকে ‘ইনকা’ বা ‘সূর্যসন্তান’ ভেবেই উৎফুল্ল মনে তার দাওয়াত গ্রহণ করেন আতাহুয়ালপা।

অন্য দিকে পিজারো এবার ইনকায় এসেছিলেন অব্যর্থ পরিকল্পনা নিয়ে। তার লোকবল কম হলেও স্পেনীয়দের কামান, বন্দুক ও ৬২টি ঘোড়ার সামনে ইনকাদের বর্শা, তলোয়ার, তীর-ধনুকের কোনো মূল্যই রইলো না। সহজ-সরল ইনকারা এমন ভয়ানক অস্ত্র আগে কখনও দেখেও নি, নামও শোনে নি। তার উপর ইনকার বিদ্রোহী জনগণ ও আতাহুয়ালপার শত্রুপক্ষ হুয়াস্কার অনুসারীদেরকেও পিজারো আগেই নিজের পক্ষে নিয়ে রেখেছিলেন।

ARREST OF ATAHUALPA, Stay Curioussis

পিজারো এবং আতাহুয়ালপাকের লোকেদের সাথে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে ইনকা নেতা আতাহুয়ালপাকে ক্যাজামার্কার স্কোয়ারে বন্দী করা হয়। © National Geographic

নিজ জাতির এমন বিশ্বাসঘাতকতায় আতাহুয়ালপা আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েন। পিজারো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে তার সেনাবাহিনী দিয়ে আতাহুয়ালপা ও তার দলবলকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। যতোক্ষণে আতাহুয়ালপা বুঝতে পারলেন যে, নৈশভোজের নিমন্ত্রণের নামে তাকে বন্দী করা হয়েছে, ততোক্ষণে বেশ দেরী হয়ে গেছে। পিজারোর সেনারা প্রায় নিরস্ত্র ও হতবিহ্বল ইনকা সেনাদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করলো।

লোভী স্পেনীয় পিজারোরা আর দেরী না করে আতাহুয়ালপার কাছে মুক্তিপণ দাবী করে। নিরুপায় আতাহুয়ালপা বন্দীদশা থেকে মুক্তির আশায় তাদেরকে এক ঘরভর্তি সোনা ও তার দ্বিগুণ রূপা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে বড় মুক্তিপণ আর কখনও কেউ কাউকে দেয় নি। সে সময় স্পেনীয়রা ইনকা সাম্রাজ্য থেকে প্রায় ২৪ টন সোনা ও রূপা লুট করেছিলো।

Gleams Of Gold 1024x768, Stay Curioussis

সোনাই সোনার ঝলক © National Geographic

এতো পরিমাণ সম্পদ আত্মসাৎ এর পরও আতাহুয়ালপাকে মুক্তি দেয়া হয় নি। তাকে নিজের ভাই হুয়াস্কাকে হত্যা এবং আরও কিছু ছোট ছোট অপরাধের দায়ে তথাকথিত স্পেনীয় আদালতে পাঠানো হয়। সেখানে আতাহুয়ালপাকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। পিজারোর সঙ্গে আসা স্পেনীয় ধর্মযাজক ভিনসেন্টে ডি ভালভাড্রে আতাহুয়ালপার সামনে দুটি উপায় খোলা রাখেন। প্রথমটি হলো, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণে অসম্মত থেকে জীবিত অবস্থায় আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ এবং দ্বিতীয়টি হলো, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে শ্বাসরোধে মৃত্যুবরণ। অসহায় আতাহুয়ালপা কোনো উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেন। এরপর পিজারোর নির্দেশে লোহার শেকল দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় আতাহুয়ালপাকে।

আতাহুয়ালপাকে হত্যা করার পর ইনকা রাজধানী কুজকো দখল করা পিজারোর জন্য বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে সমগ্র ইনকা সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন পিজারো এবং হুয়াস্কার ভাই মানকো ইনকা ইউপানকিকে পুতুল সম্রাট হিসেবে ইনকার সিংহাসনে বসায় স্পেনীয়রা।

ইনকার সোনাই কি ইউরোপের পরাশক্তি হয়ে উঠবার প্রধান যোগানদাতা?, Stay Curioussis

পিজারোর তত্ত্বাবধানে মন্দির লুট © National Geographic

আতাহুয়ালপার মুক্তিপণ থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদ পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী রাজা পঞ্চম চার্লস ও নিজের সহযোগীদেরকে বন্টন করে দেন পিজারো এবং বাকিটা নিজের জন্য রেখে দেন। এমন তাল তাল সোনা-রূপার ভান্ডার দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় স্পেনবাসী। নিজের গচ্ছিত সম্পদ নিয়ে পেরুর রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর লিমা প্রতিষ্ঠা করেন পিজারো এবং সেখানেই স্থায়ী হন তিনি। আর রাজা পঞ্চম চার্লস তার ভাগের ২০ শতাংশ সম্পদের এক বিশাল অংশের মাধ্যমে জার্মানি ব্যাংকারদের সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করেন এবং তুরস্কে অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ব্যয় করেন।

ইনকার সোনাই কি ইউরোপের পরাশক্তি হয়ে উঠবার প্রধান যোগানদাতা?, Stay Curioussis

১৫৫৫ সালে তৈরি রাজা পঞ্চম চার্লস-এর ব্রোঞ্জ উপমা। © National Geographic

এভাবে ইনকার বিশাল সম্পদ ব্যবহার করে পরিচালিত একের পর এক যুদ্ধ ও অভিযানে সফলতাই এক দল নির্মম স্পেনীয় তথা ইউরোপীয়দের শক্তিকে বৃদ্ধি করেছিলো। ইনকা সভ্যতার অস্তিত্বকে ধ্বংস করবার ক্ষেত্রে স্পেনীয়রা যে চরম নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলো, তা আসলে নজিরবিহীন। ইনকা সম্রাটের স্ত্রীসহ অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ, লুটপাট ও নির্মম গণহত্যা পরিচালনা যেনো সর্বযুগের সমস্ত কদাচারকে হার মানায়। হয়তো যুদ্ধগুলো এমনই ছিলো। কিন্তু এটি স্বীকার করতেই হবে যে, সোনার লোভে স্পেনীয়দের বোধ-বুদ্ধি অনেকাংশেই লোপ পেয়েছিলো। শুধু নির্মম আচরণই নয়, ইনকাদের ধর্মবিশ্বাস ও আবেগেও আঘাত হেনেছিলো স্পেনীয়রা। তাদের চোখের সামনে তাদের প্রধান সূর্যদেবতা ইন্তির স্বর্ণমূর্তিকে গলিয়ে ফেলা হয়েছিলো। যে দেবতাকে নিজেদের উৎপত্তির কারণ হিসেবে ইনকারা বিশ্বাস করেছিলো, তার মূর্তিকে নিমিষেই ধ্বংস হতে দেখে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলো তারা।

PIZARROS PENNILESS END 1024x683, Stay Curioussis

পেরুর রাষ্ট্রপতির সরকারী বাসভবনটি সেই জায়গাটি দখল করে যেখানে পিজারোর বাড়ি একসময় দাঁড়িয়ে ছিল। © National Geographic

অসম্ভব নির্মমতায় গড়া সম্পদের পাহাড় দিয়ে ইউরোপীয়রা পুরো বিশ্বে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছিলো, পরিণত হয়েছিলো এক অপ্রতিরোধ্য মাফিয়াতে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শোষণ যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ইনকাদের প্রভু ইন্তিকে গলিয়ে নিজেরাই অর্জন করেছিলো প্রভুত্ব। সমগ্র পৃথিবী শোষণের এই প্রক্রিয়াটি সোনায় সমৃদ্ধ আমেরিকান সভ্যতাগুলোর লুটকৃত সম্পদেরই ফসল নয় তো?

 

রেফারেন্স: