১৫৮৫র আগস্টে সৎভাই কাবুল-শাসক মির্জা হাকিমের মৃত্যু সংবাদে সময় নষ্ট না করে সম্রাট আকবর সেই বছরের শেষে সেনাপতিদের নেতৃত্বে শাহী বাহিনী পাঠিয়ে কাবুল দখল নিয়ে সেনা ছাউনি বসান। মৃত শাহজাদার দুই শিশু বালক পুত্র কায়কোবাদ আর আফ্রাসিয়াবকে লাহোরে অন্তরীণ করেন।

মির্জার প্রয়াণ, কাবুল দখল আর মির্জার দুই পুত্রকে অন্তরীণ করা আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার এবং সংস্কার পরিকল্পনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। মির্জার প্রয়াণের পরে শাহী পরিবারের মধ্যে আকবরের সাম্রাজ্য পরিচালনার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানাবার আর কোনও শাহী রক্ত বেঁচে রইল না। মুঘল অভিজাতদল বা উলেমাদের মধ্যেও আকবরের রাজনৈতিক এবং ধার্মিক উদ্যমগুলোর বিরোধিতার চিহ্নও মুছে গেল। আকবরের শাসনকর্মের ওপরে মির্জা হাকিমের দীর্ঘ ছাওয়া সরে যাওয়ায় আকবরের পক্ষে অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক বা ধার্মিক বিপক্ষকে পাত্তা দেওয়ার কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা রইল না।

মুনিস ফারুকি বলছেন, একমাত্র মির্জা হাকিমের মৃত্যুই ব্যাখ্যা করে কেন আকবরের শুধু এক সময়ের মুসলমান ধর্মীয় এলিটদের তুষ্ট করার নীতি থেকে সরে এসে হঠাতই ধর্ম বিষয়ে অনেক মুক্ত এবং উদার অবস্থা গ্রহণ করলেন। তবুও প্রাচীন বা আধুনিক ইতিহাস মির্জা হাকিমের প্রয়াণের সঙ্গে আকবরের নতুন ধর্মীয় অবস্থানের যোগসূত্র স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। মির্জা হাকিম এবং আকবরের মধ্যে দ্বন্দ্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কেন ১৫৫০ উত্তর সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া কেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমশ দক্ষিণ এশিয়া নির্ভর হয়ে উঠল।

Emperor Akbar the Great

সাম্রাজ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একা এবং শুধুই আকবরের মনীষা দায়ী, সাম্প্রতিক ইতিহাসের এই বয়ানকেও মুনিস ফারুখি স্পষ্টতই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। মুনিস ফারুখি যথাযথ সম্মান দিয়েই বলছেন ইকতিদার আলম খানের গানপাউডার এন্ড ফায়ারআর্মস…; হস গোমানসের মুঘল ওয়ারফেয়ার; আফজল হুসেইনের দ্য নোবিলিটি আন্ডার আকবর এন্ড জাহাঙ্গির; আলম, সুব্রহ্মণিয়ম সম্পাদিত দ্য মুঘল স্টেট, ১৫২৬-১৭০৭; ইরফান হাবিবের আকবর এন্ড হিজ ইন্ডিয়া; জন রিচার্ডসএর দ্য মুঘল এম্পায়ার; ডির্ক কফএর নৌকর, রাজপুত এন্ড সিপয়…; ডগলাস স্ট্রেউসেন্ডএর দ্য ফরমেশন অব মুঘল এম্পায়ার, জন রিচার্ডাসের সম্পাদনায় দ্য ইম্পিরিয়াল মনিটারি সিস্টেম অব মুঘল ইন্ডিয়া ইত্যাদি কাজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছে কোন জটিলতম ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে সম্রাট আকবর মুঘল সাম্রাজ্যকে গড়ে তুললেন। তাদের গবেষণায় আমরা বুঝলাম আকবরের শের শাহের প্রশাসনের নীতিগুলোর ওপর নির্ভরতা; হুমায়ুন এবং শের শাহের নির্দেশনা বা কর্মপদ্ধিতি নির্ভর করে আকবরের রাজপুত নীতি বিকাশ; সাম্রাজ্য গড়নে বারুদ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সেনা শ্রম বাজারের গুরুত্ব; শতাব্দ-প্রাচীন ইন্দো-পারসিক রাজকীতার বৈধতা চাওয়ার পরম্পরাকে আত্মীকরণ করা এবং নতুন বিশ্বের আবিষ্কৃত রূপোর ওপর নির্ভর করে মুঘল আমলের ক্ষমতা আর সম্পদের বিস্তারের জটিল বিষয়ের দিকগুলি। এসব গুরুত্বপূর্ণ অবদান সত্ত্বেও অধিকাংশ গবেষকই তাদের কাজে মির্জা হাকিমের রাজনৈতিক, ধর্মীয় নীতি কীভাবে আকবরের কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করেছে, সেই বয়ানটিকে স্রেফ অগ্রাহ্যই করেছেন।

মুঘল সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার সময় মির্জা হাকিমের অবদান ভুলে, শুধুই আকবরের কৃতি সোচ্চারে নথিকরণ করার যে চেষ্টা মুঘল সময়ের উপনিবেশপূর্ব, উপনিবেশিক এবং সাম্প্রতিক ইতিহাস করেছে তার কারন খুঁজেছেন মুনিস (তিনি বলছেন শুধু ব্যতিক্রম সঞ্জয় সুব্রহ্মনিয়ম আর মুজফফর আলম সম্পাদিত দ্য মুঘল স্টেট বই এবং মির্জা হাকিমের রাজত্বকাল নিয়ে সঞ্জয় সুব্রহ্মনিয়মের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ‘আ নোট অন দ্য কাবুল কিংডম আন্ডার মহম্মদ মির্জা হাকিম(১৫৫৪-১৫৮৫))। এই যৌথ বিস্মৃতির কারন সেই সময়ের ঘটমান বর্তমানেই নিহিত রয়েছে। তাকেই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।

[ছবি মির্জা হাকিম, সূত্র রয়াল কালেকশন ট্রাস্ট]

বিস্মৃতপ্রায় শাহজাদা মির্জা হাকিম এবং মুঘল সাম্রাজ্য কাঠামো

মুঘল সময় বুঝতে এতদিন ঐতিহাসিকেরা মূলত শেখ আবুলফজল আল্লামির আকবরনামা, আবদুল কাদির বাদাউনির মুন্তাখাবুলতাওয়ারিখ, খাজা নিজামুদ্দিন আহমাদের তবাকইআকবরি, মইম্মদ আরিফ কান্দাহারির তারিখইআকবরি আর বায়াজিদ বায়াতের তাজকিরাইহুমায়ুনওয়াআকবরএর তথ্য, তত্ত্ব ব্যবহার করেছেন। আকবরকে তীব্র সমালোচনায় ভরিয়ে দেওয়া বাদাউনির ইতিহাস ছাড়া প্রত্যেকটি ইতিহাসেই মির্জা হাকিম ভিলেন হিসেবে গণ্য হয়েছে। এমন কী বাদাউনির ইতিহাসেও আকবরের রাজত্বের, নীতির সক্রিয় বিরোধিতা থাকলেও, তিনি কিন্তু হিন্দুস্তানের আকবরি সাম্রাজ্য শাসনের বৈধতা চ্যালেঞ্জে কাবুলের মির্জা হাকিমের দাবিকে সমর্থন করেন নি। যে মানুষটা আকবরকে তীব্র সমালোচনায় ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি কেন মির্জা হাকিমকে নিয়ে লেখার সময় তীব্র অনাসক্তির চাদর জড়িয়ে রাখছেন এবং মির্জার জীবন নিয়ে বিশদ বর্ণনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখছেন? ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে মুঘল আমলে মির্জা হাকিম চরিত্রকে নিয়ে কেন এই তীব্র অনাসক্তি?

এর একটা একটা ব্যাখ্যা হল আমরা যে সব মুঘল ঐতিহাসিকের কথা আলোচনা করলাম, তাদের মধ্যে একমাত্র বাদাউনি বাদে প্রত্যেকের শেকড় গভীরভাবে বাঁধা ছিল মুঘল দরবারে। প্রত্যেকেরই সরাসরি পৃষ্ঠপোষক আকবরি দরবারি সম্পদ, শৌর্য। আকবর নিজেই যেখানে উদ্যমী হয়ে তার সৎভাইকে কাপুরুষ, স্বার্থান্বেষী, মাথামোটা, রাজনৈতিকভাবে অস্থিরমতি দাগিয়ে দিচ্ছেন, সেখানে আকবরের অর্থে প্রতিপালিত, আকবরের স্তুতি করা ঐতিহাসিকেরা তার ভাইএর পক্ষে, আকবরের অবস্থানের বিপরীত বয়ান লিখবেন এটা ভাবাই বাতুলতা। ফলে মির্জা ঐতিহাসিকভাবে অখ্যাত হয়ে থেকেছেন এবং তার ভাগ্যে অখ্যাতি ছাড়া অন্য কিছু বরাদ্দ ছিল না। মুনিস ফারুখি বলছেন শেখ আবুলফজলের আকবরনামা, খাজা নিজামুদ্দিন আহমদের তবাকইআকবরি, মহম্মদ আরিফ কান্দাহারির তারিখইআকবরি, বায়াজিদ বয়াতের তাজকিরাইহুমায়ুনওয়াআকবরএ তার নামে স্রেফ কুৎসা করা হয়েছে। বাদাউনি সহ মুঘল ঐতিহাসিকদের একচোখামি এবং তীব্র পক্ষপাতের দরুন আগামী দিনে আকবরের কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীই ইতিহাসে ঠাঁই পাবেন না।

ঠিক যেমন করে মির্জা হাকিম, আকবরের রাজত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইতিহাসে ব্রাত্য হয়েছেন, একই ভাগ্য আকবরের বাবার হুমায়ুনের রাজত্বের সময়ে তার ভাই মির্জা কামরানের(প্রয়াণ ১৫৫৩) ক্ষেত্রে হয়েছে। সে সময়ের মুঘল ঐতিহাসিককেরা মির্জা কামরানের বিরুদ্ধে তাঁর কাবুলবাসকে ব্যঙ্গ করে পরোক্ষে তাঁকে বিদেশি হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে বলেছেন তিনি মুঘল হিন্দুস্তানের ব্যাপারে বেআইনিভাবে নাক গলাচ্ছেন। মির্জা হাকিমের বিপক্ষে আরও কয়েকটা বিষয় গিয়েছে – তাঁর মুঘল হিন্দুস্তানে বাস না করা এবং হিন্দুস্তানিদের বিষয়ে, হিন্দুস্তানের রাজনীতি বিষয়ে উৎসাহ না দেখানো। একটা উদাহরণ দিই, ১৫৮৫তে মির্জার মৃত্যুর এক দশকেরও বেশি সময় পরে লেখা আকবরনামায় আবুলফজল বারবার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ১৫৮১তে কাবুল থেকে তাঁর হিন্দুস্তান দখলের ব্যর্থ চেষ্টা আদতে জাবুলিস্তাঁর[জাবুলিস্তাঁ হল কাবুলের আশেপাশের অঞ্চল] বোকাপাঁঠাদের ব্যর্থ উদ্যম(হারজাদায়ারানইজাবুলিস্তাঁ), কারন তারা হিন্দুস্তানের জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে চরমতম ব্যর্থ। তাছাড়া মির্জা হাকিম কোনওভাবেই শাসক শ্রেণীর অংশ নন, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ সাফাভি আমলের লেখক আমিন আহমদ রাজির হফত ইকলিমে স্পষ্টভাবে দেখি। হফত ইকলিম ভৌগোলিক, জীবনীমূলক এবং ঐতিহাসিক জ্ঞানভাণ্ডার। তিনি মির্জাকে হিন্দুস্তানে কাটানো প্রয়াত শাহজাদার তালিকায় ঠাঁই দিয়েছেন। রিজভি যদি সত্যিই জ্ঞানচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ হতেন, তাহলে তিনি মির্জা হাকিমের তুলনায় অনেক বেশি হিন্দুস্তানে সময় কাটানো কাবুলের শাসক, হাকিমের কাকা মির্জা কামরান সম্বন্ধেও একই কথা লিখতেন। আদতে রিজভিও তাঁর হিন্দুস্তানি পাঠকের মতই মির্জার বিদেশিত্বর ধারণায় বিশ্বাসী।

Portrait of Akbar

আদতে মির্জা হাকিমের হিন্দুস্তানিত্ব নিয়ে সন্দেহ তো ছিলই, তার সঙ্গে জুড়েছিল, তাঁর পক্ষে বহুভাষিক উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্তানকে শাসন করার যোগ্যতার প্রশ্ন। মুঘল ঐতিহাসিকের অনেকেই, স্বয়ং আবুলফজল, বাদাউনি, খাজা নিজামুদ্দিন, এমন কী ফরিস্তাও মির্জা হাকিমের কাবুলের মত ছোট ভৌগোলিক এলাকা শাসন করার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ফলে আকবরের সময় প্রায় অসুরক্ষিত, তুলনায় অনেক বেশি জটিল মুঘল হিন্দুস্তানের শাসক হিসেবে তার দক্ষতা এবং যোগ্যতা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

হিন্দুস্তানে তাঁকে নিয়ে যখক কুৎসা চলছে, সেই প্রচারের কাউন্টার করা কথা নিশ্চই তিনি কাবুলের দরবারে ভেবেছেন। কিন্তু হয় তাঁকে নিয়ে আকবরের হিন্দুস্তানের দরবারের আমীর বা অন্যান্য অভিজাত কী ভাবছে সে বিষয় নিয়ে তিনি উদাসীন ছিলেন, না হয় সেই বিপুল তাত্ত্বিক আক্রমনকে প্রতিহত করারমত সম্পদ তার ছিল না। ফলে হাসান আলি আলমুনসি আলখাকানির আখলাকইহাকিমি ছাড়া মির্জা হাকিমের পৃষ্ঠপোষকতায় তার রাজত্বে প্রকাশিত অন্য কোনও বইএর কথা আমরা আজও জানি না। তবে আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি, মির্জা হাকিমের দরবারে হাসান আলি যে বইটি লিখলেন সেটি কী তার চরিত্রকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বা মুঘল সিংহাসন দখলের চেষ্টা সফল করার জন্যে যথেষ্ট ছিল? আখলাকইহাকিমি ১৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত একটি আইনি প্রতর্ক। প্রত্যেকটি অধ্যায় ছটি অধি-অধ্যায় বিচার[আদালত], ধৈর্য[সবর], উদারতা[শাখাওয়াত], সহানুভূতি[আফভ], শৌর্য[শুজাত] এবং আলোচনা[মশবরাত] বিভক্ত। যদিও প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শুরুতে এবং শেষে মির্জার স্তুতি গাওয়া হয়েছে, কিন্তু স্তুতিটির মর্মবাণী যেন দায়সারা। একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে মির্জা হাকিমের জীবনের গল্প বা তার বক্তব্য কোনওটাই স্তুতি পর্বে আলোচনা করা হয় নি। বরং তিনি তার বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে ইসলামপূর্ব এবং ইসলাম পরবর্তী যুগের নবি মহম্মদের কথিত হদিসের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছেন। বইতে রাজনৈতিক বক্তব্যের অপ্রতুলতা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, আকবর তার উদ্দেশ্যপূরণে যেভাবে লিখিত ইতিহাস সাহিত্যকে ব্যবহার করেছেন, মির্জা হাকিম সেইভাবে নিজের পক্ষে প্রচার তুলে আনতে পারেন নি। আখলাকইহাকিমি কোনওভাবেই মির্জা হাকিমের উচ্চাশার প্রতিফলন নয়। বরং আমরা পরের দিকে দেখব মির্জা হাকিম আকবরের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে অন্য সূত্র নির্ভর করবেন।

আকবরের দরবারি ঐতিহাসিকেরা যেভাবে আকবরকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছেন, সে তুলনায় মির্জা হাকিম ইতিহাসে নিষ্প্রভই থেকে যান। তাই সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতকে মুতামদ খানের ইকবালনামাইজাহাঙ্গিরি, কামওয়ার খানের তাজকিরাতুসসালাতিনইচাঘতা, সুজনরাইভান্ডারির খুলাসতউততাওয়ারিখ বা কাফিখানের মুন্তাখাবুললুবুব এবং অন্যান্য পারসিক ঐতিহাসিক দুএকটা ছোটখাট ব্যতিক্রম ছাড়া মূলত তাদের পূর্বজদের কথিত বয়ান অনুসরণ করে আকবরের পক্ষ নেন এবং মির্জা সম্বন্ধে প্রায় এক্কেবারেই উচ্ছসিত হন না। মির্জা হাকিমের বিরোধিতায় কাফিখান সকলকে ছাপিয়ে মির্জাকে উপস্থিত করেন এমন এক চরিত্র হিসেবে যে নমনীয়, কাপুরুষ, প্ররোচনাযোগ্য, আড়ম্বরপূর্ণ, সুবিধাবাদী এবং যাকে খুব সহজে পথভ্রষ্ট করা যায়।

এখানেই শেষ নয়, উপনিবেশিক আমলেও ভারত এবং আফগানিস্তানের ঐতিহাসিকেরাও তাদের বয়ান লিপিবদ্ধ করেছেন মুঘল আমলের ঐতিহাসিকদের তৈরি করে দেওয়া বয়ান অনুসরণ করে। সামগ্রিক উপনিবেশিক ইতিহাসচর্চায় তিনি শুধু যে উপেক্ষিত থাকেন তাই নয়, বরং তার চরিত্র ব্যাখা করতে যে বিশেষণগুলি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হয় যেমন দুর্বল-ইচ্ছা, আবেগপ্রবণ তাই শাসন কাজে অনুপযুক্ত, কাপুরুষ, মূল্যহীন লম্পট, মদ্যাসক্ত দুর্বল প্রকৃতির ইত্যাদি। উপনিবেশিক পূর্ব ইতিহাস যে কাজটা করে নি, সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করল উপনিবেশিক ইতিহাস – মির্জা হাকিম হয়ে উঠলেন সংকীর্ণমনা ধর্মান্ধ গোঁড়া মুসলিম শাসক, যিনি never ventured to question the truth of Islam। ব্রিটিশদের বয়ানে মির্জা হাকিম যেন আকবরের সমন্বয়বাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, সহনশীল শাসনকে উলটে দিতে চান। মুঘল এবং উপনিবেশিক ঐতিহাসিকদের বানানো মির্জা চরিত্রটি অনুসৃত হবে ব্রিটিশ এবং ততপরবর্তী সময়ে।

১৯৪০এর দশকের শেষের দিক থেকে গবেষকেরা মির্জা হাকিমকেনিয়ে নতুঙ্কোনও পথ দেখলেন না, পূর্বজদের চোখেই দেখলেন, তাঁর সম্বন্ধে নতুন কোনও উচ্ছ্বাস তৈরি হল না। ভারতীয়, পাকিস্তানি, ইওরোপিয় এবং আমেরিকিয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে তিনজন মুজফফর আলম, সঞ্জয় সুব্রহ্মনিয়ম এবং জন এফ রিচার্ডসই মির্জাকে আকবরের পাল্টা ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখলেন, যিনি আকবরের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেন। ইকতিদার আলম খানের আকবর এন্ড হিজ এজ, ইরফান হাবিবের আকবর এন্ড হিন ইন্ডিয়া, নিরু মিশ্রর সাকসেসন এন্ড ইম্পিরিয়াল লিদারশিপ এমং দ্য মুঘলস ১৫২৬-১৭০৭, ডগলাস স্ট্রেউসান্ড দ্য ফরমেশন অব মুঘল এম্পায়ারএ মির্জা হাকিম প্রায় অনুপস্থিত আর মুন্নি লালের আকবর, আই এইচ কুরেশির জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর, ঈশ্বরী প্রসাদের মুঘল এম্পায়ার, রমেশচন্দ্র মজুমদারের  এন এডভান্সড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বা এ এল শ্রীবাস্তবের আকবর দ্য গ্রেটে মির্জা হাকিম উপহাসের চরিত্র হয়ে ওঠেন।

বিংশ শতাব্দের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক দল বা সোভিয়েতপরবর্তী সময়ের মধ্য এশিয়ার ঐতিহাসিকদের দায় ছিল মির্জা হাকিমকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার, তাঁকে বিশ্লেষণ করার, তার সম্মান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার। আশ্চর্যের তারাও সেই পথে হাঁটেন নি। পারস্যভাষী মির্জার কাবুল শাসন, তাঁর তুর্কি আদিবাসী চরিত্র এবং গোঁড়ামির ফলে জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে বর্জনই করেছেন। আফগানিস্তানের দারি এবং পুস্তু ভাষী ইতিহাসচর্চায় তিনি ব্রাত্য থেকে যান। ১৯৭৭এর পূর্বে রাষ্ট্র নির্ভর জাতীয়তাবাদের বাধ্যবাধকতা(পড়ুন পাখতুন) – বিশেষ করে অঞ্জুমানইতারিখ(ইতিহাস সমিতি) এবং পস্তি তোলানার(পস্তু একাডেমি) ইতিহাসচর্চায় তিনি ব্রাত্য থাকেন তার অপাখতুন চরিত্রের জন্যে। মির্জা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাবুলে রাজত্ব করলেও, অঞ্চলের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিলেও আফগান ইতিহাসচর্চায় তিনি ব্রাত্য থেকে যান। তার মিশ্রচরিত্রের জন্যে তিনি অন্যান্য আফগান গোষ্ঠী উজবেগ, তাজিক, হাজারার ইতিহাস চর্চার স্মৃতিতে উঠে আসেন না। ১৯৭৭এর পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানজুড়ে উথালপাথাল ঘটনাবলী ঘটতে থাকায় ইতিহাসচর্চার বৌদ্ধিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মির্জা হাকিমের ফিরে আসাই বন্ধ হয় না, অঞ্চলের সামগ্রিক ইতিহাসচর্চাই ব্যহত হয়। একইভাবে হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকদের মুসলমান চরিত্রের প্রতি অনাকর্ষণ এবং পাকিস্তানের ইতিহাসচর্চায় দক্ষিণ এশিয়া বনাম মধ্য এশিয়া উত্তরাধিকারের বিতর্ক মির্জা হাকিমের পক্ষে যায় নি। ফলে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় মুঘল সাম্রাজ্যে গঠনের ইতিহাস চর্চায় মির্জা হাকিম প্রায় একটি প্রান্তিক চরিত্র হিসেবে আজও গণ্য হন।