উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান মোহাম্মদ আল-ফতেহের (The Conquror) ইস্তাম্বুল জয় করার পর বসবরাস প্রণালী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। কৃষ্ণ সাগর থেকে মারমারা সাগর পর্যন্ত অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে বসবরাস জলপ্রণালী। তোপকাপি রাজপ্রাসাদের প্লেন বৃক্ষরাজির অনেক পাতা পড়েছে ঝরে। সুলতান মোহাম্মদও ৪৯ বছর বয়সে অকালে ঝরে গেলেন ১৪৮১ সালে। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে উসমানীও সাম্রাজ্যকে সম্প্রসারিত করে যান ২২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারে। অবিশ্বাস্য!
মুহাম্মাদ ফাতিহ; Image source: Wikimedia
তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে বাইজিদ দ্বিতীয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন ১৪৮১ থেকে ১৫১২ সাল পর্যন্ত। বাইজিদ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন স্পেনের বিতাড়িত ইহুদী এবং মুসলমানদের উসমানীয় সাম্রাজ্যে আশ্রয় দিয়ে। ১৪৯২ সালে স্পেন যখন ইহুদী এবং মুসলমানদের বের করে দিচ্ছিলো আলহাম্বরা ডিক্রি জারী করে, বাইজিদ তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার জন্য তখন এডমিরাল কামাল রেইসের নেতৃত্বে নৌবাহিনীর অনেক জাহাজ পাঠান স্পেনে। সুলতান ঘোষণা করলেন যে, উসমানীয় সাম্রাজ্যে স্পেনের বিতাড়িত ইহুদীরা বাস করবে নিজেদের জন্মভূমির মতো। তিঁনি এমনকি হুশিয়ারও করে দেন যে, ইহুদীদেরকে তাঁর সাম্রাজ্যের কেউ অত্যাচার করলে, তাদেরকে দিবেন মৃত্যুদন্ড। তাঁর জনগণকে ইহুদীদের সব দিক দিয়ে সহায়তা করার আদেশ দিলেন বারবার। স্পেনের ইহুদী বিতরণের সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করে স্পেনিশ এরাগন রাজা ফার্ডিনান্ড এবং ক্যাস্টিল রানী ইসাবেলাকে তিরস্কারও করেন বাইজিদ কঠিনভাবে। পরবর্তীতে আল-আন্দালুসের বিতাড়িত মুসলমান ও ইহুদীরাই নতুন নতুন ধারণা, জ্ঞান এবং শিল্প-সাহিত্য নিয়ে অনেক অবদান রাখেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের উদীয়মান শক্তিতে। ১৪৯৩ সালে কনস্টান্টিনোপলের (বর্তমানে ইস্তাম্বুল) প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্পেন থেকে বিতাড়িত ইহুদীরাই।
বাইজিদ দ্বিতীয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান
মহানুভব বাইজিদকে ক্ষমতা থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত করে উসমানীয় সুলতান হন তাঁরই ছেলে সেলিম। সুলতান সেলিম ছিলেন একজন নিষ্ঠুর শাসক। তিঁনি রাজত্ব করেন ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। অলিখিত এক নীতি অনুযায়ী পূর্বে উসমানীয় কোন সুলতান মুসলিম সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন নাই। এ নীতিটি প্রথম ভঙ্গ করলেন সেলিম। ১৫১৭ সালের মধ্যে সেলিম মধ্যপ্রাচ্য এবং আরবের সিরিয়া, লেবানন, ইরান, মিশর, মক্কা, মদিনা, এমনকি জেরুজালেম জয় করে ফেলেন। সেলিম তাঁর আগ্রাসী সামরিক শক্তি দিয়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যর আকার দ্বিগুন করে ফেলেন কয়েক বছরের মধ্যেই।
সেলিম ডাকনাম ইয়াভুজ; Image source: Wikimedia
১৫২০ সালে সেলিমের আকস্মিক মৃত্যুর পর, তার ছেলে সুলাইমান ২৬ বছর বয়সে হন উসমানীয়দের দশম সুলতান। তিঁনি ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শাসন করেন উসমানীয় সাম্রাজ্য। ষোলো দশকে ইউরোপের ভূ-রাজনীতির এক অন্যতম প্রভাবশালী শাসক ছিলেন এই নবীন সুলতান। এমনকি বিশ্ব রাজনীতিতে তিঁনি পরিচয় লাভ করেন এক শক্তিশালী এবং প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে। ১৫২১ থেকে ১৫২৬ সালের মধ্যে তাঁর সেনাবাহিনী একে একে জয় করে নেয় বেলগ্রেড, রোডস দ্বীপপুঞ্জ, হাঙ্গেরী; এমনকি ভিয়েনা জয় করেন ১৫২৯ সালে। তাঁর নেতৃত্বেই ইউরোপে উসমানীয়রা আত্মপ্রকাশ করে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে।
সুলাইমান বা সুলায়মান দ্য ম্যাগ্নিফিসেন্ট
ভুমধ্যসাগর এলাকায় সুলাইমান দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন স্পেনের সাথে। সুলাইমান বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সাম্রাজ্যকে আরো বিস্তৃত করতে হলে, প্রয়োজন বিশাল এক চৌকষ নৌবাহিনী এবং একজন অভিজ্ঞ নৌ-অধিনায়ক। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। খুঁজে খুঁজে বের করেন ভূমধ্যসাগরীয় এক দুর্ধর্ষ জলদস্যুকে, যা’র নাম বারবারোসা। বারবারোসাকে নিয়োগ দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন খোলা চেক, নির্দেশ দিলেন তাঁর নৌবাহিনী গড়ে তোলার জন্য। সুলাইমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অচিরেই বারবারোসা নির্মাণ করে ফেললেন ২০০ বিশাল আকারের যুদ্ধ জাহাজ। কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর শক্তিশালী নৌবাহিনী দিয়ে সুলাইমান উসমানীয় সাম্রাজ্যকে বিস্তারিত করেন তিনটি মহাদেশে; রাশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত।
হাইরেদ্দীন বারবারোসা; Image source: Wikimedia
শুধু সামরিক শক্তি দিয়েই নয়, স্থাপত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দক্ষ প্রশাসন এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নয়ন করে তাঁর সাম্রাজ্যকে গড়ে তুলেন পশ্চিম ইউরোপের মতো উন্নত। সুলাইমান তাঁর সাম্রাজ্যে প্রবর্তন করেন আইনের শাসন। তাঁর সময়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের আইন-কানুনের গুণগত মানকে নিয়ে যান ইউরোপের সমকক্ষে। তাঁকে বলা হয় সুদক্ষ আইনজ্ঞ। তিনি শাসন করেন এমন এক বিশাল সাম্রাজ্য, যা’র অধিবাসী ছিল আড়াই কোটির উপরে। তখনকার সময়ে এ সংখ্যাটি ছিল বিশাল। সুলাইমানকে পশ্চিমা বিশ্ব চেনে The Magnificient নামে। তাঁকে এই উপাধি দেবার সম্ভবত মূল কারণ ছিল কয়েকটি: বিশ্ব ইতিহাসে সুলাইমানের প্রভাব, তাঁর সাম্রাজ্যের অপ্রতিরোধ্য বিস্তৃতি, জনগণের কল্যাণ করার অদম্য প্রচেষ্টা, এবং তাঁর ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব।
The Magnificient
সুলাইমানের স্ত্রী ছিলেন রোক্সেলানা, পূর্ব পোল্যান্ডের অধিবাসী। ক্রিমিয়ান তাতারদের হাতে বন্দী হয়ে তাঁকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। পরবর্তীতে রোক্সেলানার স্থান হয় ইস্তানবুলে রাজকীয় হেরেমখানায়। শীঘ্রই হয়ে উঠেন সুলতানের প্রিয়। ফলশ্রুতিতে, সকল প্রকার রীতি ভেঙে সুলাইমান বিয়ে করেন রোক্সেলানাকে। তাঁর তুর্কি নাম দেয়া হয়, হুররেম সুলতান। রাজপ্রাসাদে তিঁনি হয়ে উঠেন অনেক প্রভাবশালী। তিনি ছিলেন সুলতানের প্রধান উপদেষ্টা। তাদের রোমান্টিক সম্পর্ক রোক্সেলানার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছিল অটুট। রোক্সেলানাকে নিয়ে সুলতান লিখে ফেলেন এক কবিতা, যেখানে তিঁনি স্ত্রীকে তুলনা করেন পৃথিবীর যাবতীয় সুন্দর বস্তু এবং উপলব্ধির সাথে। কবিতা থেকে কয়েকটি পংক্তি এখানে না দিয়েই পারলাম না।
হুররেম সুলতান
Throne of my lonely Niche, my Wealth, my Love, my Moonlight.
My most sincere Friend, my Confidant, my very existence, my Sultan, my One and Only love.
The most Beautiful among the Beautiful…
My Spring time, my Merry faced Love, my Daytime, my Sweetheart, smiling Leaf…
My Plants, my Sweet, my Rose, the One Only who does not Distress me in this world…
১৫৬৬ সালে সুলাইমানের মৃত্যু হয় ৭২ বছর বয়সে, আর রোক্সেলানার মৃত্যু হয় এর আট বছর আগে, ১৫৫৮ সালে। সুলাইমান রেখে যান এমন এক সাম্রাজ্য যা’ ছিল অত্যন্ত আধুনিক এবং প্রগতিশীল, ইউরোপের সমকক্ষ। নাগরিকের গুণগত মান উন্নয়নের দিক দিয়ে সুলাইমান উসমানীয় সাম্রাজ্যকে রূপান্তর করেন ইউরোপীয় সমমানের। সুলাইমানের মৃত্যুর পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরবর্তী সুলতানদের জয় করার আর কোন কিছুই বাকী ছিল না। ষোলো শো শতাব্দীর শেষ দিক থেকে উসমানীয়দের সামরিক শক্তি হ্রাস পেতে থাকে দ্রুত।
সুলেমানের ইস্তাম্বুলে সমাধি
সুলাইমান-পরবর্তী সময়ে উসমানীয় সুলতানরা ইস্তাম্বুলের রাজপ্রাসাদে মগ্ন থাকতো আরাম-আয়েশে, যুদ্ধে যাবার আর কোনো আগ্রহ তাদের ছিল না। বিশাল উসমানীয় সাম্রাজ্যকে শাসন করা এসব আরাম-প্রিয় সুলতানদের জন্য হয়ে পড়লো দুরূহ। ফলশ্রুতিতে, ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যর সার্বিক অবস্থা হয়ে পড়লো নিম্নগামী। একের পর এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্টানগুলো ভেঙে পড়তে লাগলো। এমন এক অবস্থায়, ১৫৯৫ সালে মোহাম্মদ তৃতীয় হত্যা করে ১৯ জন উসমানীয় রাজপুত্রকে শুধু মাত্র ক্ষমতায় যাবার জন্য। ঐ হত্যাকান্ডকে বিবেচনা করা হয় ইতিহাসের অন্যতম এক জঘন্য ঘটনা।
মোহাম্মদ তৃতীয়
আস্তে আস্তে উসমানীয় সামরিক বাহিনীর হতে থাকলো অবক্ষয়, ভেঙে গেলো চেইন-অফ-কমান্ড, প্রশিক্ষণ হয়ে পড়লো নিম্ন মানের। উসমানীয়দের এমন দুর্বল অবস্থার সুযোগে ১৭৭৯ সালে রাশিয়া দখল করে নেয় উসমানীয়দের কিছু রাজ্য। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ন আক্রমণ করে উসমানীয়দের মিশর। সামরিক বাহিনী হয়ে পড়লো দুর্নীতিগ্রস্থ। সুলতানের বিরুদ্ধে শুরু হলো অধিক বেতনের দাবীতে বিদ্রোহ। উসমানীয় সাম্রাজ্যের এমন বিশৃংখলার এক পর্যায়ে সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয় গড়ে তুলেন ১০,০০০ সৈন্যের এক নতুন বাহিনী। উসমানীয়দের আগের জানাসারী বাহিনীকে (Jannisary Corps) বিলুপ্ত করেন চিরতরে।
আধুনিক সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন রাষ্ট্রীয় কর সংগ্রহের ব্যবস্থা, বিচারালয়, এবং সরকারী প্রশাসন হয়ে পড়লো স্থবির ও অকার্যকর। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা হয়ে পড়লো দুর্নীতি পরায়ণ। উসমানীয় সাম্রাজ্যকে তখন মনে করা হতো “ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি।” অন্য দিকে, ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে হতে থাকলো শক্তিশালী।উসমানীদের প্রতিযোগী রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়ে গেলো অনেক।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝিতে সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয়ের ছেলে সুলতান আব্দুল মাজেদ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে চেয়ে বসলেন সাহায্য। তিঁনি ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে, সুলতান মাজেদ ১৮৪৩ সালে তোপ কাপি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দেন। ১৮৭৬ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্য হয়ে যায় দেউলিয়া। সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মন্দায় দুর্বল ও প্রায়-বিধস্ত উসমানীয় সাম্রাজ্যকে নিয়ে যান বিংশ শতকে।
১৯১২ এবং ১৯১৩ সালের বলকান যুদ্ধ এবং তুর্কী জাতীয়তাবাদীদের উত্থান উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে দ্রুত।
দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ; Image source: Wikimedia
রাষ্ট্রে বেড়ে যায় অসহিষ্ণুতা। সাম্রাজ্য হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। ১৯১৫ সালে উসমানীয়রা লক্ষ লক্ষ আর্মেনিয়ানকে বিতাড়িত করে দেশ থেকে। ঐ বিতাড়নের প্রধান কারণ ছিল, উসমানীয়-রাশিয়ার দ্বন্দে আর্মেনিয়ানরা সমর্থন করেছিল রাশিয়াকে। হাজার হাজার আর্মেনিয়ান এতে হয় নিহত। আর্মেনিয়ানদের প্রতি উসমানীয় সেই নির্দয় ব্যবহার আজো তাড়িয়ে বেড়ায় তুরস্ককে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্য জার্মানির পক্ষে যুদ্ধ করে। পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে উসমানীয় সাম্রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে, সেভ্রেস চুক্তির(Treaty of Sevres) মাধ্যমে উসমান গাজীর প্রতিষ্ঠিত উসমানীয় সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে।
উসমানী সাম্রাজ্যের পতনের কতগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অধিবাসী ছিল অশিক্ষিত, কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি, শিল্প বিপ্লবকে অবহেলা করা, বিশ্বের পরিবর্তিত রাজনীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা, শাসনকালের শেষভাগে বেশীরভাগ সুলতানের ভোগ-বিলাসে মগ্নতা ও অদক্ষতা, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর পক্ষে থাকা।
১৯২৩ সালে তুরস্ককে করা হয় রিপাবলিক। কামাল আতাতুর্ক হন তুরস্কর প্রথম রাষ্ট্রপতি। ছয় শো বছরেরও বেশী সময় ধরে বিশ্বকে তাকে লাগিয়ে দেয়া সাম্রাজ্যের ইতি টানা হয় এভাবেই।
মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক; Image source: Wikimedia