বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশে আদি যুগের মানুষের বসবাসের এলাকা হিসাবে নরসিংদী জেলার উয়ারী বটেশর বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী । কয়রা নামক একটি প্রাচীন নদীখাতের দক্ষিণতীরে উয়ারী বটেশরের অবস্থান। গ্রাম দুটি হতে এত অধিক সংখ্যক ও রকমারী প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে যা বাংলাদেশের অন্য কোথাও পাওয়া যাযনি । এদের মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব প্রস্তর যুগের হাত কুঠার , নব্য প্রস্তর যুগের বাটালী, ছুরি ,আকরিন লোহার তৈরী হাতকুঠার লোহার ফলক, লোহার হাতুড়ি, প্রচুর ছাপাস্কিত রৌপ্যমুদ্রা মূল্যবান পাথরের গুটিকা, পোড়ামাটির গোলক ও চাকতি, মৃৎপাত শিলনোড়া, পাথর ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে যে প্রাচীনকালে বাংলার অধিকাংশ স্থান সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। কেবলমাত্র ঢাকার ভাওয়ার, নরসিংদীর পাহাড়িয়া অঞ্চল, ময়মনসিহের মধূপুর গড় উওরবঙ্গের বরেন্দ্র, কুমিল্লার লালমাই, চট্টগ্রাম পার্বর্ত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের কতিপয় অঞ্চলে স্থলভ’মি ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায় ।

উয়ারী-বটেশ্বরের মানচিত্র; Source: Banglapedia.com

সপ্তখ শতকে হিউয়েন সাং সোনারগায়ের নিকটই সমুদ্র দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তাই অনেকে এই অঞ্চলে একটি সমৃদ্ব বন্দর নগরী থাকা বিচিত্র নয় বলে সৃষ্টি হয়। খুব সম্ভবত ষোড়শ শতকের শেষদিকে এই নামকরণ করা হয়। কিন্তু উয়ারীর ইতিহাস নিঃসন্দেহে আরও অনেক প্রাচীন। উয়ারীর পার্শ্ববর্তী বাজনাভ গ্রাম। বৌদ্ব দোহার ভাষায় বাজনাভ অর্থ বজরা নৌকা। বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে নৌকার প্রাচুর্য লক্ষ্য করে বৌদ্ব আমলে নামটি রাখা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন আবার নরসিংদীর বহু গ্রাম গঞ্জ ও নদীর নামকরণে আরবীয় নৌবাণিজ্যের স্বাক্ষর স্পষ্ট। এগুলো সবটাই তাত্বিক আলোচনা। এবারে বাস্তবতায় ফেরা যাক।

পাথরখণ্ড হাতে হাবিবুল্লা পাঠান এবং পাশে হানিফ পাঠানSource: Dailystar.net

১৯৩৩ সালে একদল শ্রসিক মাটি কাটতে গিয়ে অনেক রৌপ্যমুদ্রা খুজে পান। শ্রমিকরা এর মূল্য না বুঝেই স্থানীয় বেদেপল্লীতে এগুলো বিক্রি করে দেন। স্থানীয় সবুজপল্লী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হানিফ পাঠান এগুলোর কয়েকটি সংগ্রহ করে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পএিকায় প্রচীন মুদ্রা প্রাপ্তি শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। এরপর হতেই চাষাবাদের সময়ে কিংবা বৃষ্টিজনিত কারণে মাটি সরে গেলে নানা রকমের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালে কয়েকটি ত্রিকোনাকার লৌহ কুঠার পাওয়া যায়। এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে চলে লেখালেখি।

কিছু হাতিয়ার

২০০০ সালে এখানে খননকাজ শুরু হয়। এ সময় মাত্র পনের বর্গমিটার এলাকা খনন করা হয়। পাওয়া যায় বেশকিছু হাতলওয়ালা পণ্য, মূল্যবান মুদ্রা, রুলেটেড ওয়্যার নবড ওয়্যার নামের মৃৎপাত্র উওরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ পাত্র। এসবের বয়স জানাব প্রয়োজনে কার্বন টেস্টের জন্য এগুলোকে  পাঠানো হয় নেদারল্যাগেুর সেণ্ট্রাল ডোর আইসোটোপেন অন্তারজোয়েফে। পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় উয়ারী এলাকাটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে। রুলেটেড পাত্রগুলো যে তথ্য দিয়ে তা কৌতহলের জন্ম দেয় । পত্রগুলোর গায়ে খোদাই করা এক ধরণের দাগ রয়েছে। এরকম ভারতের বিভিন্ন স্থানেও পাওয়া গিয়েছে।

উয়ারী-বটেশ্বর খনন স্থান পরিমাপ

গবেষকেরা বলেছেন এগুলো এখানে এসেছে রোমান সাম্রাজ্য হতে অর্থৎ গবেষকরা যা বলতে চাইছেন তা হলো ভ’মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে এই সভ্যতার মানুষের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। দক্ষিন পূর্ব ত্রশিয়ার সাথেও এই অঞ্চলের বাণিজ্যক সম্পর্ক ছিল যার প্রমাণ নবড ওয়্যার নামের এক ধরনের মৃৎপাত্র। ত্ররকম পাত্রের সমতল মধ্যভাগ হঠাৎ উঁচু হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে ত্রই অঞ্চল হতে কেবল মাটির নয়, ধাতুর তৈরী নবও পাওযা গেল। ত্রই ধাতব নবকে বলা হয়ে থাকে হাইটিন ব্রোঞ্চ। ব্রোঞ্চের আর টিনের সংমিশ্রণে তৈরী ত্রটি ।দক্ষিণ পূর্ব ত্রশিয়াতে ত্র ধরনের ব্রোঞ্চ তৈরী হতো।

রৌপ্যমুদ্রা ও পাতিল

বিগত ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব। অধিদপ্তর ত্রই অঞ্চলে খনন কাজ পরিচালনা করে। ত্রই খননে ত্রকটি দেওয়াল কাঠামো আবিস্কৃত হয়েছে।দেওয়ালটি নীচের দিকে প্রসারিত এবং ওপরের দিকে সংকুচিত। দেওয়াল কাঠামোটি কক্ষের নাকি নয়। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে তা ত্রই মুহূর্তে বলা সম্বব নয়। দেওয়ালে কাদার গাথুনি ব্যবহৃত হয়েছে বলে অনুমতি হয়।

বৌদ্ধ মন্দিরের পদ্ম

দেওয়ালে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে তাতে দেওয়ালটি সপ্তম-অষ্ঠম শতক অর্থাৎ পালযুগীয়  বলে মনে হয়। এ ছাড়া জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব  বিভাগ উয়ারী বটেশ্বরে একটি রাস্তা আাবিষ্কার  করেছেন যাকে তারা আড়াই হাজার বছরের পুরাতন বলে দাবী করেছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পন্ডিতরাও আবার দ্বিধাবিভক্ত। সবকিছু মিলিয়ে এটুকুই বলা যায় যে, ওয়ারী বটেশ্বরের মত একটা বড় প্রত্নতত্ত্ব  স্থল সম্বন্ধে তাৎক্ষণিভাবে কোনরকম সিদ্ধান্ত গ্রহন সমীচিন নয়। বরং খননের আগেই পুরো এলাকাটি সতর্কতার সাথে জরীপ করে নেওয়া যেতে পারে।

প্রাপ্ত তাবিজ

সবশেষে প্রত্নতত্ত্ববিদের কাছে অনুরোধ ইতিহাস পুর্নির্মাণের চেয়ে ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাসষ চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতা যেন বড় হয়ে না ওঠে সে আশংকাকে দমিয়ে রাখার জন্য আমাদের সকলকে সৎ এবং আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।

বিভিন্ন মাপের বাটখারা;

তথ্যসূত্রঃ

১। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন: উয়ারী বটেশ্বর

-মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান

২। নরসিংদী জেলার উয়ারী বটেশ্বর

একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা

৩। ভারত বিচিত্রা জানুয়ারী, ২০০৩