কর্ণ, ভীষ্ম সংবাদ, Stay Curioussis

রাত্রি দ্বিপ্রহর। চারিদিক নিস্তব্ধ, ভয়ংকর নিরবতায় আচ্ছন্ন। দূরথেকে কয়েকটা কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। কুরুক্ষেত্রের বিশাল প্রান্তর এখন যেনো এক বিরান মরুভূমিতে পরিনত হয়েছে। হঠাৎ কৌরব শিবিরের একটি তাঁবু থেকে দীর্ঘকায়, সুঠামদেহী একটি ছায়ামূর্তি বের হয়ে এলো। পাহারারত প্রহরীরা মশালের আলোয় ছায়ামূর্তিটিকে চিনতে পেরে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিলো। প্রহরীদের অতিক্রম করে ছায়ামূর্তিটি কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনের দিকে এগোতে লাগলো। দমকা হাওয়ায় ছায়ামূর্তির ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল উড়ছিলো। নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করে এক জায়গায় থামলো ছায়ামূর্তি, যেখানে কৌরবপক্ষের শর-সেনাপতি, বীরশ্রেষ্ঠ মহামহিম ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত আছেন।  বহুল পরিচিত মুখটিরকাছে এসে থামলো আগন্তুক।চাঁদের আলোয় বড্ড ক্লান্ত, শ্রান্ত, যন্ত্রনাক্লিষ্ট বৃদ্ধ মানুষটির জন্য আগন্তুকের চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।সংসারে অপরাজেয় ছিলেন যে যোদ্ধা, স্বয়ং ভগবান পরশুরামও যে অতুল বলবান যোদ্ধাকে পরাস্ত করতে পারেন নি, সারাটাজীবন যে ব্যক্তি কুরু বংশের কল্যানে ব্যায় করলেন, ধর্মকে আগলে রাখতে রাখতে তাঁর এমন করুন পরিনতি দেখে যেনো আগন্তুকের বুক চিড়ে তীব্র একটা হাহাকার বের হয়ে আসতে চাইলো। নিজেকে সংযত করে ভরাট কন্ঠে আগন্তুক ছায়ামূর্তি বলে উঠলো-

কর্ণ, ভীষ্ম সংবাদ, Stay Curioussis

কর্ণের রাজ্যাভিষেক

—প্রনাম নেবেন , মহামহিম।

অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালেন ভীষ্ম।
—অঙ্গরাজ কর্ণ! এই মধ্য রজনীতে আমায় কি বলতে এসেছেন?
— আমি শুধু আপনাকে প্রনাম জানাতে এসেছি, মহামহিম। আর এই আশায় যে আপনি আমায় আশির্বাদ করবেন।আগামিকাল আমি রণক্ষেত্রে মিত্র দুর্যোধনের কল্যাণার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবো।

ম্লান হাসি হেসে ভীষ্ম বললেন-
—মহারথী কর্ণেরও এই বুড়োর আশির্বাদের প্রয়োজন হয়?
—এই অন্তিম সময়ে এসেও কি আপনি আমাকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়বেন না…মহামহিম…??? আমার প্রতি আপনার কিসের এতো অভিমান..কিসের এতো ক্রোধ..??? কিছুটা ক্ষোভের সাথে বলে উঠলেন কর্ণ।

ভীষ্ম জবাব দেন না। উদাস চোখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন।
—সব সময়ে আপনি আমাকে মিত্র দুর্যোধনের কাছ থেকে দূরে সরাতে চেয়েছেন। নানা কটু কথায় আমাকে জর্জরিত করেছেন।আমার জাত, আমার সামর্থ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন আপনি।

শরশয্যায় শায়িত বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বললেন কর্ণ।
—-আমি তোমার আসল পরিচয় জানি পুত্র।

এতক্ষনে কথা বলেন ভীষ্ম।
——আমি জানি তুমি কৌন্তেয়, জ্যৈষ্ঠ পান্ডব তুমি।তুমি এই আর্যাবর্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনুর্বীর। বীরত্ব, দান -দাক্ষিণ্যে তোমার সমকক্ষ কেউ নেই।তুমি ধার্মিক। কিন্তু পুত্র, তুমি যে তোমার জীবনভর অধর্মের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছো। দুর্যোধনের ঔদ্ধত্যের মূল কারন তোমার সামর্থ, সে তোমাকে তার কার্যোদ্ধারের হাতিয়ার করেছে। কথা গুলো বলে একটু দম নেন ভীষ্ম।

কর্ণ, ভীষ্ম সংবাদ, Stay Curioussis

ভীষ্মের ভীষণ প্রতিজ্ঞা

—অধর্ম ..??? কাকে অধর্ম বলছেন আপনি পিতামহ…???
জন্মের পরপরই নিজের জন্মদাত্রী আমাকে পরিত্যাগ করেছেন। আমার শৈশব- কৈশোর কেটেছে সূতপুত্রের লাঞ্চনা,গন্জনা সহ্য করে। বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছি এই সমাজ থেকে।আমার শক্তি আর সামর্থ্যকে বারবার অবদমিত করে রাখা হয়েছে।আমার বিদ্যা শিক্ষাকে মেনে নেয় নি আপনার কথিত ধর্ম। মিত্র দুর্যোধন আমার দু:সময়ে আমাকে সম্মান জানিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে, আমাকে সমাজে মর্যাদা দিয়েছে, সর্বদা আমার উপর নির্ভর করেছে..তাঁকে আমি ত্যাগ করবো ধর্মের খাতিরে…??? পান্ডবরা আমার ভাই বলে…,,,???

একসাথে বলে উঠলেন কর্ণ।
যন্ত্রণাক্লিষ্ট কন্ঠে ভীষ্ম বললেন—
—-তোমাকে আর দুর্যোধনকে ধর্মের পথ অনেক বাতলিয়েছি আমি, কিন্তু তোমরা আমার কথা শোনো নি। দুর্যোধনের জেদ আর ক্ষমতালোভের ফলাফল আজকের এই মহাসমর। এত প্রাণহানি, এত ক্ষতির একমাত্র কারন দুর্যোধনের সীমাহীন উচ্চাভিলাষ।তুমি নিজের অজান্তেই অর্জুনের সাথে অযাচিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলে, নিজের সহোদরদের সাথে চিরশত্রুতায় নিপতিত হয়েছিলে, তাই আমি সর্বদা তোমাকে হস্তিনাপুর থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম। আর এইজন্যই যুদ্ধের প্রথমেই তোমাকে বিরত রেখেছিলাম।ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের যুদ্ধ হোক- এ আমি কখনো চাইনি। কিন্তু আমার সমস্ত প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হয়েছে পুত্র।
—আজ আর আপনার সাথে তর্ক করবো না পিতামহ। আমি জানি, আমার যা করা উচিত ছিলো আমি তাই করেছি, ভবিষ্যতেও করবো। আপনার আশির্বাদ কামনা করি, যে গৌরবের স্বপ্ন আমি দেখেছি সারাজীবন তা যেনো এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমি অর্জন করতে পারি।
—-পুত্র, তোমার প্রতি আমার উপদেশ এই যে, ধর্ম -অধর্মের এই যুদ্ধে তুমি ধর্মের পক্ষে, স্বীয় ভ্রাতাদের পক্ষে যুদ্ধ করো।যুধিষ্ঠির তোমাকে বরণ করে নেবে।

ম্লান হেসে কর্ণ বললেন—
—-তা হয় না পিতামহ…মিত্র দুর্যোধন এই যুদ্ধ আমার ভরসাতেই শুরু করেছেন। এই ক্রান্তিকালে যদি তাঁকে ত্যাগ করি তবে সমগ্র জগতে আমি মিথ্যবাদী কপটচারী, সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত হবো।লোকে অপবাদ দেবে যে, অঙ্গরাজ কর্ণ রাজত্বের লোভে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে তাঁর পরম মিত্র যুবরাজ দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করেছেন। এ আমি কখনই মেনে নিতে পারবো না পিতামহ।আমি কৌরবপক্ষেই যুদ্ধ করবো।এটাই আমার ধর্ম। যতক্ষন আমার এই দেহে প্রাণ আছে ততক্ষন আমি দুর্যোধনের কবচ হিসেবে লড়বো।তাঁকে আঘাত করতে আসা পান্ডবদের প্রতিটি অস্ত্রের বিপরীতে প্রয়োজনে নিজের বুক পেতে দেবো।
—-ধর্মের স্বরূপ আসলে খুব জটিল বিষয়, পুত্র। আমরা সবসময় যা ধর্ম মনে করি, বস্তুত অন্যের কাছে তা অনেকসময়ই অধর্ম বলে প্রতিয়মান হয়। তোমাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই, তবে তুমি যে পক্ষেই লড়াই করো, নিজের নীতিতে শেষ পর্যন্ত অবিচল থেকো।

কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে ভীষ্ম আবার বললেন—-
——আর আমি পান্ডবদের জয়ের আশির্বাদ দিয়ে দিয়েছি পুত্র। তোমাকে শুধু বলতে পারি  যে, নিজ কর্তব্য পালন পূর্বক বীরগতিপ্রাপ্তের জন্য যুদ্ধ করো,আগামি কাল রণক্ষেত্রে তোমার প্রতি এই হবে আমার আশির্বাদ।এই মহাযুদ্ধের পর তুমি জগতে কীর্তিমান ও চিরঅম্লান হবে। যে বীরত্বের খ্যাতির স্বপ্ন তুমি সর্বদা দেখে এসেছো তা তোমার এই যুদ্ধের মাধ্যমেই অর্জিত হবে।

চোখের অশ্রু মুছে পিতামহ ভীষ্মের চরণধূলি নিয়ে,  তাঁকে বিদায় জানিয়ে কৌরব শিবিরে নিজের তাঁবুর দিকে পা চালালেন কর্ণ। আগামিকাল রণভূমিতে মিত্র দুর্যোধনের যে তাঁকে খুব প্রয়োজন।