পেন্সিলভ্যানিয়ার নদীতে ভেসে যাচ্ছে মাঝারি সাইজের একটি জাহাজ। জাহাজটির নাম ‘হায়দার আলী’। পেন্সিলভ্যানিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মনে হায়দার আলীর প্রতি এমন বিনম্র শ্রদ্ধার কারণ কি? কে এই হায়দার আলী?

হায়দার আলী নাকি সুদূর দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে অবস্থান করেই আমেরিকানদের শত্রু ব্রিটিশদেরকে এক হাত দেখিয়ে দিয়েছেন। আর এ জন্য প্রতি মুহূর্তে হায়দার আলীকে স্মরণ করছে আমেরিকার অধিবাসীরা। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মুখেই আজ গুঞ্জরিত হচ্ছে ‘হায়দার আলী’ নামটি।

সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে সুদূর আমেরিকাতে ১৭ শতকের সময়টাতে হায়দার আলী এতো জনপ্রিয়তা কেনো পেলেন, তার কিছুটা হয়তো আপনারা আন্দাজ করে ফেলেছেন। এক সময় আমেরিকা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন উপনিবেশ এবং এই উপনিবেশ থাকাকালীন সময়ে ব্রিটিশদের অন্যায় ও অবিচারের প্রতিবাদস্বরূপ আমেরিকার তেরোটি কলোনি একত্রে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু ব্রিটিশরা তো আর এতো সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। লেগে গেলো যুদ্ধ।

এই যুদ্ধ চললো বেশ কিছুদিন ধরে। তবে সত্যি বলতে, ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে হাতছাড়া করতে চায় নি বলেই কিন্তু ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ করেছিলো। তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হলো, আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের ১৭৭৬ সালে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, তার সিংহভাগ খরচ এই ভারতবর্ষই যুগিয়েছিলো। আমেরিকার স্বাধীনতা সম্পর্কে যদি এমন উক্তি করা হয়, তাহলে কি আপনারা বিশ্বাস করবেন? আজকের এই প্রবন্ধটিতে এই ব্যাপরটি প্রতিষ্ঠা  করারই চেষ্টা থাকবে।

ব্রিটিশ শাসন থেকে নিজেদেরকে স্বাধীন করবার জন্য আমেরিকা যে যুদ্ধ শুরু করেছিলো, তাকে কিন্তু এক বিশ্বযুদ্ধই বলা যায়। কেননা যুদ্ধটি আমেরিকায় শুরু হলেও তার পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো ভারতবর্ষে। এমনকি ফরাসি এবং ইংরেজদের মধ্যে ভারতবর্ষ ও আমেরিকার সম্পত্তি বন্টন সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো সুদূর প্যারিসে।

আমেরিকার উত্থান ভারতবর্ষের নির্লিপ্ততারই ফসল নয় তো

টিপু সুলতান এবং হায়দার আলী আমেরিকার স্বাধীনতার স্থপতিদের স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন l © scroll.in

আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিলো বেশ কিছুদিন ধরেই। ১৭৬২ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ গ্রেনভিল ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন যে, আমেরিকার কলোনিগুলোকে চালাতে গিয়ে তাদের বছরে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার পাউন্ড খরচ হলেও মাত্র ১ হাজার থেকে ২ হাজার পাউন্ডই আমেরিকার জনগণের কাছ থেকে তারা উসুল করতে পারে। সুতরাং আরো অনেক বেশি কর আদায় করতে হবে। কলোনিগুলোকে লাভজনক করবার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার তাই কলোনিতে বসবাসকারী অধিবাসীদের সবাইকে আরো বেশি ট্যাক্সের আওতায় এনে নিজেদের ক্ষতি পূরণ করার চেষ্টা করে।

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে তাস খেলার কার্ড অবধি -সমস্ত কিছুর উপর তারা ট্যাক্স বসিয়ে দেয়। এই ধরনের অন্যায় ও অতিরিক্ত ট্যাক্স আমেরিকানদেরকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ক্ষিপ্ত হয়ে তারা ব্রিটিশদেরকে জানিয়ে দেয়, যেহেতু পার্লামেন্টে তাদের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত নেই, তাই কোনো প্রকার কর দিতেও তারা ইচ্ছুক নয়। প্রতিশোধের মুখে ইংল্যান্ড সরকার সাময়িকভাবে রাজস্ব নীতি বাতিল করতে বাধ্য হলো।

তবে এতো বড় অপমান হজম করবার মতো শক্তি ব্রিটিশদের ছিলো না। ব্রিটিশরা তাদের উপর ‘টাউনশেন্ড অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন প্রয়োগ করে। এই আইনের আওতায় পেপার, গ্লাস, চা সমস্ত কিছুর উপর কর চাপিয়ে দেয়া হলো। এ সব কারণে ১৭৭০ সালে আমেরিকা যখন প্রতিবাদস্বরূপ পথে নামলো ও ধর্মঘটের ডাক দিলো, তখন ব্রিটিশ সরকারের পোষা সৈন্যদের গুলিতে তিন জন আমেরিকান শ্রমিক নিহত হলো। এই ঘটনা যেনো বারুদের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেবার মতো বিস্ফোরণ ঘটালো। আমেরিকার জনগণ আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো এবং প্রতিবাদ আরো জোরদার হয়ে উঠলো।

আর এই দিকে ব্রিটিশ সরকার সেখানে দৃষ্টিপাত না করে বরং তাদের প্রণীত আইনগুলোকে আরো কঠোরভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করলো। সে সময় চা ছিল ব্রিটিশদের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য, সবচাইতে মহার্ঘ্য এবং রাজস্ব আদায়ের অন্যতম উৎস। এই চা এর উপর যখন ট্যাক্স বসিয়ে দেয়া হলো, তখন বোস্টন হারবারে গিয়ে আমেরিকার কিছু মানুষ চায়ের পাতাগুলোকে সমুদ্রে ফেলে দিলো। এতে ব্রিটিশ সরকার প্রচন্ডভাবে অপমানবোধ করলো এবং আমেরিকানদের উপর আরও চারটি আইন তারা প্রয়োগ করবে বলে ঘোষণা দিলো। এই নতুন প্রণীত চারটি আইন ‘ইনটোলারেবল অ্যাক্টস’ নামে পরিচিত।

আমেরিকার উত্থান ভারতবর্ষের নির্লিপ্ততারই ফসল নয় তো?

১৭৮২ সালে আমেরিকান নৌ জাহাজ ইউএসএস হায়দার অ্যালি এবং ইংরেজ যুদ্ধ জাহাজ জেনারেল মঙ্কের মধ্যে যুদ্ধ।

আমেরিকার জনগণ এই ধরনের অন্যায় আইন মেনে নিলো না। ব্যস, ১৭৭৪ সালে প্রথম আমেরিকান কংগ্রেসের অধিবেশন বসে এবং ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই কংগ্রেস তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেনো বিশ্বযুদ্ধ বললাম, সে সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই প্রয়োজন। ব্রিটেন, ফরাসি, স্পেন, অটোমান (তুরস্ক), রাশিয়া, প্রূশিয়া (জার্মানি) -এই রাজ্যগুলোই ছিলো তখন বিশ্বের বৃহৎ শক্তি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাদের কলোনি ছিলো। দেখা যেতো, কলোনিগুলোর কোনো এক প্রান্তে যুদ্ধ লাগলে অন্য প্রান্তেও তার প্রভাব গিয়ে পড়তো। ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরের যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষকে তাদের এক শক্তিশালী কলোনিতে পরিণত করতে শুরু করেছিলো। ফরাসিরাও সে সময় মাঠেই ছিলো।

১৭৭৬ সালে আমেরিকায় যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিলো, সে সময় আমেরিকার ফরাসিরা হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা আমেরিকার পক্ষেই কাজ করবে। এতে ফরাসি ও ব্রিটিশদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করলো। আগেই বলেছি, ব্রিটিশ এবং ফরাসি উভয় শক্তিই ব্যবসায়িক সম্পর্ক দিয়ে ভারতবর্ষকে তাদের কলোনিতে রূপান্তরিত করবার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলো।

সে সময় ভারতবর্ষের পন্ডিচেরি ছিলো ফরাসিদের অধীনে। ১৭৭৬ সালে ফরাসিদের বিরুদ্ধ অবস্থানের কারণে ব্রিটিশরা সেই পন্ডিচেরি দখল করে নিলো। মনে রাখতে হবে, এই বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত কিন্তু হয়েছিলো আমেরিকায় ফরাসি ও ব্রিটিশদের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব থেকে। উভয়ই ভারতবর্ষের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরীর মাধ্যমে আগে কাজ শুরু করেছিলো। যা-ই হোক, এই দ্বন্দ্বের কারণে পরবর্তীতে ১৭৭৯ সালে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ফরাসিদের ‘মাহে’ নামের আরও একটি বন্দর দখল করে নেয়। ব্রিটিশদের ইচ্ছে ছিলো, ভারতীয় ভূমি থেকে ফরাসিদেরকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করে ভারতবর্ষকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা।

ব্রিটিশদের এই ইচ্ছা পূরণ করবার পথেই বাধা হয়ে দাঁড়ালেন মাইসোরের সুলতান হায়দার আলী। ফরাসিদের সাথে সুলতান হায়দার আলীর বেশ সুসম্পর্ক ছিলো এবং মাহে বন্দর দিয়েই সুলতানের জন্য বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করতো ফরাসিরা। ব্রিটিশরা মাহে বন্দর দখল করে নেয়ার ফলে সুলতানের পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্থ হয়। এতে হায়দার আলী ব্রিটিশদের উপর প্রচন্ড বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের শায়েস্তা করার জন্য অগ্রসর হন। ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টিপু সুলতানের নেতৃত্বে পলিলোরের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা মোটামুটিভাবে নাস্তানাবুদ হয়ে পরাজয় বরণ করে। ভারতীয়দের এত বড় সাফল্যের খবর প্রায় এক বছর পর আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছে। সে সময় তো ব্রিটিশদের সাথে আমেরিকানদের প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে।

আমেরিকার উত্থান ভারতবর্ষের নির্লিপ্ততারই ফসল নয় তো?

মাইসোরীয় সেনাবাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের কুড্ডালোরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

১৯ আগস্ট জর্জ ওয়াশিংটন ইয়র্কটাউনের লড়াইয়ে জয় লাভ করলেন। এই লড়াইটিই ছিলো আমেরিকানদের শেষ লড়াই। এমন সময়েই তারা জানতে পারে হায়দার আলীর গল্প। তাদের কাছে এই খবর পৌঁছায় যে, বিশ্বের অপর প্রান্তে অনেক দূরবর্তী এক অঞ্চলে একজন অসীম সাহসী নেতা ব্রিটিশদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। ‘শত্রুর শত্রু নিজের বন্ধু’ -এমন মনোভাব থেকেই তারা ভীষণভাবে চাচ্ছিলো, যে কোনো যুদ্ধেই ব্রিটিশদের পরাজয় হোক এবং ভারতীয় এই সুলতান বিজয়ী হোক।

নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মুখে মুখে হায়দার আলীর নাম ও তার ঘটনাটি গল্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হায়দার আলী একজন বিদ্রোহী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান আমেরিকায়। কিংবদন্তির রূপে তিনি আমেরিকানদের মনে স্থায়ী হন। হায়দার আলীর প্রতি এতোটাই ভালোবাসা তৈরী হয়েছিলো আমেরিকানদের মনে যে, পেন্সিলভ্যানিয়াতে এক বিরাট যুদ্ধ জাহাজের নাম দেয়া হলো ‘হায়দার আলী’।

হায়দার আলী নামটি তাদের কাছে একটি মোটিভেশনাল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে শুরু করলো। ১৭৮২ সালে ‘হায়দার আলী’ নামের এই জাহাজটি তার চেয়েও বিশাল আকৃতির একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনায় তাদের আবেগ ও মোটিভেশন আরও তীব্র হতে শুরু করলো। হায়দার আলীর প্রতি ভালোবাসা থেকে আমেরিকানরা নিজেদের সাহিত্যে, শিল্পকর্মে ও কবিতায় হায়দার আলীকে স্থান দিলো। শুধু তা-ই নয়, হায়দার আলীর প্রচারণা এমন ভাবে শুরু হলো যে, সে সময় তাদের ভূগোল বইতে মাইসোরের ভৌগোলিক বিষয় সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায়ও যুক্ত করা হলো।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জন অ্যাডামস, জেমস ম্যাডিসন, জন কুইন্সি অ্যাডামস, টমাস জেফারসন -এরা সবাই-ই আমেরিকার স্বাধীনতায় ভূমিকা রেখেছিলেন এবং এদের প্রত্যেকেই ছিলেন হায়দার আলী ও তার ছেলে টিপু সুলতানের সংগ্রামী সময়ের সমসাময়িক চরিত্র। এদের মতো বড় বড় নেতা থেকে শুরু করে আমেরিকার সাধারণ জনগণ পর্যন্ত সবার মনেই মাইসোরের সুলতানকে প্রত্যক্ষভাবে সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করবারও প্রবল ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাদের কাছে তেমন কোনো সেনাবাহিনী ছিলো না বলে সেদিকে তারা আর অগ্রসর হয় নি। তারা প্রতি মুহূর্তে প্রার্থনা করেছে যেনো ভারতীয়দের নিরঙ্কুশ জয় সংঘটিত হয়। এরই মধ্যে ১৭৮০ সালে ঘটে গেলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমেরিকার বন্ধু ফ্রান্স দেউলিয়া হয়ে গেলো এবং উপায় না পেয়ে তারা ব্রিটিশদের সাথে শান্তিচুক্তির জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

ফ্রান্স ও ব্রিটেনের এই শান্তিচুক্তির খবর ভারতবর্ষে এসে পৌঁছতে কিন্তু প্রায় এক বছর লেগে যায়। সে সময়ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ফরাসি ও ব্রিটিশদের লড়াই চলছিলো। ভারতবর্ষের ফরাসিদের কাছে যখন এই খবর এসে পৌঁছে, তখন কিন্তু ফরাসিদের আর ভারতীয়দের পক্ষে যুদ্ধ করবার সামর্থ্য থাকে না।

এদিকে ইংরেজদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে এক নতুন চক্রান্ত। তারা তো ব্যবসায়ী জাতি। তারা দেখতে পাচ্ছিলো, শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। এই শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় কলকারখানাগুলো ছিলো ইংল্যান্ডে। আর এই শিল্প কারখানাগুলো চালাবার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালগুলো যেতো ভারতবর্ষ থেকে। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, ভারতীয় মানুষগুলোর চরিত্র ছিলো মোটামুটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তারা সহজ সরল জাতি। তাদের উপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দিলেও প্রতিবাদ করার মতো তেমন শক্তি তাদের নেই। তাদের উপর যা-ই চাপিয়ে দেয়া হতো, তারা তা মেনে নিতো। অন্য দিকে, আমেরিকার ক্ষেত্রে এ ধরনের জোরাজুরি ছিলো খুবই কঠিন। তাছাড়াও আমেরিকায় অবস্থিত দশ হাজার ব্রিটিশ সৈন্যের যে বাৎসরিক বেতন প্রয়োজন, তা আমেরিকা থেকে প্রাপ্ত আয়ের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব ছিলো না।

ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বার্তা পাঠানো হলো, আমেরিকার তুলনায় ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের অর্থ উপার্জন অনেক বেশি সহজ হবে, সুতরাং যে কোনো ক্ষেত্রে ভারতবর্ষকেই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। এ সমস্ত কিছুর বিবেচনায় অবশেষে ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যারিসে নির্ধারিত হলো ভারতবর্ষের ভাগ্য। ফরাসি, ডাচ ও আমেরিকানদের সাথে ইংল্যান্ডের চুক্তি হলো এবং এই চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকার স্বাধীনতাকে মেনে নেয়া হলো। প্রাচুর্য এবং সম্পদে পূর্ণ ভারতবর্ষকে আঁকড়ে ধরলো ব্রিটিশরা। ১৭৮৩ সালে চুক্তি সংঘটনের সেই সময়টাতে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ডেভিড গর্ব করে বলেছিলেন, “উই হ্যাভ ফাউন্ড ইন ইস্ট ইন্ডিজ রিকম্পেন্স ফর অল আওয়ার লসেস ইন দিস ওয়ার”। এটি আমাদের জন্য ভীষণ দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক বিষয় যে, এই ঘটনার পরবর্তীতে বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ইংরেজরা যতো যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তার সমস্ত খরচ আমাদের পূর্বপুরুষরাই যুগিয়েছিলো।

আমেরিকার উত্থান ভারতবর্ষের নির্লিপ্ততারই ফসল নয় তো?

হায়দার আলীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে ব্রিটিশ কমান্ডার

এখানে কিছু বিষয় লক্ষ করতেই হবে। আমেরিকা যদি ব্রিটিশদের জন্য বেশি লাভজনক হতো, কিংবা ভারতবর্ষের মানুষগুলোও যদি একতাবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ প্রাথমিক অবস্থাতেই গড়ে তুলতে পারতো, তবে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিতো। হয়তো ভারতবর্ষের দুইশো বছরের ইতিহাস আলাদা কিছু হতো। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিপ্লব, নীল বিদ্রোহ ইত্যাদি যেসব খন্ড খন্ড ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমরা এতো দিন জেনেছি, সেগুলো আসলে একটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ঠিক এ কারণেই আমরা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করতে পারি।

আমেরিকার এক সময়ের হিরো হায়দার আলী কিংবা টিপু সুলতান সম্পর্কে আজ যে সব বিকৃত ইতিহাসের অবতারণা ঘটছে, আমাদেরকে সে সব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। শুধু ভিন্ন জাতি থেকে প্রাপ্ত সম্মানই যথেষ্ট নয়, নিজ ভূমিতেও তারা বীরের মর্যাদা পাবার অধিকার রাখেন। ইতিহাসের এ সব বীর সন্তানদেরকে নিজেদের গর্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।

রেফারেন্স: