কাউন্ট লিও টলষ্টয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ান সাম্রাজ্যের টুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা কাউন্ট নিকোলাই ইলিচ টলস্টয় ছিলেন বিশাল জমিদারির মালিক। তিনি ছিলেন পরিবারের চতুর্থ সন্তান। তার যখন দুইবছর বয়স তখন তার মা মারা যান। তখন তার দেখাশোনার ভার নেন তার ফুফু আলেকজান্দ্রা। ১৮৩৭ সালে তার বাবার মৃত্যু হয়। এরপর ১৮৪১ সালে তার ফুফু আলেকজান্দ্রার মৃত্যুর হলে তাকে আরেকজন ফুফু নিজের সাথে কাজানে নিয়ে যান।

ফুফুর সাথে কাজানে থাকার সময় তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে অরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় বরাবরই তিনি অমনোযোগী ছিলেন। ফলাফল খারাপ হবার জন্য তাকে তুলনামূলক সহজ, আইন অনুষদে পাঠানো হয়।সেখানেও তিনি লেখাপড়ায় অমনোযোগী হবার কারনে ফলাফল খারাপ করেন।সে সময় তিনি সাহিত্য ও নীতিশাস্ত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ইংরেজ সাহিত্যিক লরেন্স স্টার্ন এবং চার্লস ডিকেন্সের সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় তার কোন মনোযোগ ছিলোনা। অবশেষে ১৮৪৭ সালে তাকে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই কাজান বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর যখন তিনি তার জন্মস্থান ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় ফিরে আসেন তখন তার বড় ভাই নিকোলাই যিনি সেনাকর্মকর্তা ছিলেন তার পরামর্শে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ককেশাসে তিনি কয়েক বছর সৈনিক হিসেবে কাটান। তার ককেশাসে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি লিখে ফেলেন তার জীবনের অন্যতম সাহিত্যকর্ম ‘ককেশাসের বন্দী ও কসাক’। ১৮৫৪ সালের নভেম্বরে যুবক সৈনিক টলস্টয়কে ককেশাস থেকে পাঠানো হলো ক্রিমিয়ার সেভাস্তপোলে। সেখানে তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগ দেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সহিংসতা দেখে তিনি সেনাবাহিনী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধ শেষ না হতেই তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন।

সোফিয়া নামের একটি মেয়েকে তিনি বিয়ে করেন। তারপর তিনি সোফিয়ার সাথে ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় নিজের জমিদারিতে বসবাস শুরু করেন এবং পরবর্তীতে তাদের ঘরে ১৩ সন্তানের জন্ম হয় ।

তার লেখা War and Peace, উপন্যাসটি ১৮০৫ থেকে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার সমাজের বিভিন্ন পটভূমিতে লেখা। উনিশ শতকের শুরুতে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের রাশিয়া আক্রমণ ও তার ফলে পাঁচটি অভিজাত রাশিয়ান পরিবারের মধ্যে ভাঙা-গড়ার যে খেলা তারই কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। Anna Karenina তার রচিত আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। ১৮৭৮ সালে এটি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। ধারণা করা হয়, ‘আন্না কারেনিনা’য় টলস্টয় নিজের জীবন থেকে নেওয়া কিছু গল্পকে কাল্পনিক রূপ দেন। এই উপন্যাস দুটি প্রথমে টেলিভিশন সিরিয়াল হিসাবে প্রচারিত হয় এবং পরে সিনেমা তৈরি করা হয়। ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাসিকা ‘কসাক’। কসাক রাশিয়ায় জনপ্রিয় হয় এবং টলস্টয় জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

উনিশ শতকের ব্রিটিশ কবি ও সমালোচক মেথু আর্নল্ড টলস্টয় সম্পর্কে বলেছেন ‘’ টলস্টয় শুধু এক শিল্পকর্ম নয়, বরং জীবনের একটি অংশ’’। আরেক বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘’টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী’’। ১৯০১, ১৯০২ এবং ১৯১০ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পুরস্কার তার ভাগ্যে জোটেনি।যেটা নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম।

তিনি নিজের জমিদারিতে স্কুল খুলে গরীব ছেলে-মেয়েদের নিজে পড়াতেন। সরকারের বিরুদ্ধে ঔদাসীন্যের অভিযোগ এনেছেন, আদমশুমারীতে অংশ নিয়েছেন। সম্রাটের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তিনি স্বনামে ও বেনামে দেশের ভিতরে ও বাইরে জার-শাসনের সমালোচনা করে লেখা ছাপিয়েছেন। কিন্তু শাসক গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। আইনের নামে বিচারের প্রহসন কিভাবে হয় তা দেখার জন্য দিনের পর দিন আদালত আর জেলখানায় ঘুরেছেন। তার এই সততা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সত্যিই অবাক হওয়ার মতো।

তিনি যখন গল্প-উপন্যাস-নাটক ইত্যাদি সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করতে শুরু করলেন, তখন সেখানে কোথাও অবাস্তব রোমান্টিক কল্পনা দেখা যায়না, সমাজে তিনি নিজে যেটা দেখেছেন শুধু সেগুলিকেই তার লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি সমাজের নিচু শ্রেনীর মানুষ থেকে শুরু করে রাজদরবারের লোকজনের সাথে অবলীলায় মিশে যেতে পারতেন।তার দীর্ঘজীবনে তিনি সমাজে বা সভ্যতায় প্রচলিত কোন বিশ্বাস বা রীতিনীতি বিনা প্রশ্নে মেনে নেননি।

জীবনের উদ্দেশ্য ও অর্থ সম্পর্কে ধর্ম কী বলে তা জানার জন্য তিনি প্রথমে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চে যান,একসময় তার মনে হয় খ্রিস্টান গির্জাগুলো দুর্নীতিগ্রস্থ এবং মূল ধর্ম থেকে সরে এসে তাদের মনগড়া নিজস্ব বিশ্বাস তৈরি করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। তিনি পাদ্রীদের কাজের বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং তাদের কাজের সমালোচনাও করতেন। এতে করে যাজক সম্প্রদায় তার উপর রাগ করে তাকে খ্রিস্টান ধর্ম থেকে বের করার ঘোষণা দেন এবং আরও বলা হয় টলস্টয়কে আর খ্রিস্টান বলে গণ্য হবেন না। তাদের এই ঘোষনার বিরুদ্ধে তিনি বলেছিলেন, যে বা যারা ঈশ্বর ও যীশুকে নিয়ে ব্যবসা করে তাদের চেয়ে তিনি হাজার গুণ বেশি ধার্মিক খ্রিস্টান।

তার মৃত্যুর পর পাদ্রীরা দল বেঁধে তার মৃতদেহের কাছে আসতে চাইলে তাদের কাউকেই টলস্টয়ের মৃতদেহের কাছে ঘেঁসতে দেয়া হয়নি। দেশ- বিদেশের হাজার হাজার মানুষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই তার শবযাত্রায় শামিল হয়ে তাকে সমাহিত করে। রাশিয়ার আস্তাপভা নামের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের রেলওয়ে স্টেশনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর তাকে তার চিরচেনা ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় কবর দেয়া হয় । তার ইচ্ছানুযায়ী তার মৃত্যুর পর ১৯২৮ ও ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার সাহিত্যকর্ম ৯০ খণ্ডে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত হয়, যার বেশিরভাগই ছিলো তার দিনলিপি ও চিঠিপত্র।