১৮৯৭ সাল। স্পেনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের ভ্যালেনশিয়ান জনগোষ্ঠীর শহর এলচে। অকস্মাৎ এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে আপনাআপনি ধরা দিলো এক প্রত্নবস্তু, একটি আইবেরিয়ান ঐশ্বরিক নারী ভাস্কর্য। বহু আলোচনা-সমালোচনার সম্মুখীন সেই ভাস্কর্যটির নাম রাখা হলো ‘লেডি অফ এলচে’।

১৯৭১ সালের জুলাই মাস। দক্ষিণ স্পেনের শহর বাযা। খাড়াভাবে পতিত তীক্ষ্ণ সূর্যরশ্মির নিচে এক দল শ্রমিক নিরলসভাবে খনন করে যাচ্ছেন বাযার উত্তর প্রান্তের একটি প্রাক-রোমান নেক্রোপলিসে। জায়গাটিকে বলা হয় ‘সেররো দেল সান্তুয়ারিও’। খুঁড়তে খুঁড়তে এক পর্যায়ে একজন শ্রমিকের হাতিয়ারটি শক্ত কোনো কিছুতে আঘাত করে বসে। হালকা লাল-নীল রঙের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। প্রথমে সবাই ভাবলেন, নিশ্চয়ই এটি কোনো রঙিন পাথর। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রান্সিসকো জোসে প্রিসেডো ভীষণ আশাবাদী ছিলেন। তিনি বেশ যত্নসহকারে মাটি পরিষ্কার করে জিনিসটিকে বের করে আনতে বললেন। যতোই মাটি সরে যাচ্ছিলো, ততোই কৌতূহলী হয়ে উঠতে লাগলেন প্রিসেডো। হঠাৎ করেই ফুটে উঠলো এক অদ্ভূত সুন্দর নারীর মুখাবয়ব। এক অভূতপূর্ব আবিষ্কারের নেশায় রোমাঞ্চিত হন প্রত্যেকে। উত্তেজনার ঝড় বইতে শুরু করলো প্রত্নতাত্ত্বিকদের মনে। বের করে আনা হলো সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটিকে। তার নাম রাখা হলো ‘লেডি অফ বাযা’।

চার ফুট উঁচু চুনাপাথরের একটি আইবেরিয়ান ভাস্কর্য ‘লেডি অফ বাযা’। মূর্তিটির শরীরে নানা রকম রত্নখচিত গহনাই বলে দেয়, নিশ্চয়ই কোনো সম্ভ্রান্ত নারী ছিলেন এই ভাস্কর্যের আসল মানুষটি। তার পোশাক-পরিচ্ছদসহ সমস্ত কিছুর মধ্যেই ফুটে উঠেছে আভিজাত্য। তিনি বসে আছেন একটি ডানাযুক্ত সিংহাসনে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়, এটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০ সালে তৈরী করা হয়েছিলো।

ভাস্কর্যটির পোশাকের কোণায় লাল-সাদা ছোট ছোট চতুর্ভুজের মতো আঁকা। সিংহাসন ও মূর্তি উভয়ই একটি মাত্র পাথরের লগ কেটে খোদাই করে তৈরী করা হয়েছে এবং তার উপর বিভিন্ন রং প্রয়োগের মাধ্যমে আরও মানবীয় করে তোলা হয়েছে মূর্তিটিকে। নীল, লাল, কালো, সাদা ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের ব্যবহার দেখা যায় এতে। ধারণা করা হয়, সাদা চুনাপাথরের এই মূর্তিটি আসলে এক সময় সম্পূর্ণ রঙিন ছিলো। আর রঞ্জক দিয়ে রঞ্জিত ছিলো বলেই হয়তো তার গালের পাশে আবছা গোলাপি রঙের আভাও দেখা যায়।

লেডি অফ বাজাতে ব্যবহৃত রঙ্গকগুলি স্পেকুলার আলো দূর করার পরে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। © elpais.com

‘লেডি অফ বাযা’ এবং ‘লেডি অফ এলচে’ এর মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য লক্ষণীয়। দুটি ভাস্কর্যই সুন্দরভাবে রং করা ছিলো। উভয়েরই পরনে ছিলো আইবেরিয়ান পোশাক। তাদের হেড্রেস, কানের দুল এবং নেকলেস এতো সুন্দরভাবে খোদাই করে তৈরী করা হয়েছিলো যে, তা দেখার সাথে সাথেই সেই যুগের নারীদের সাজসজ্জা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ‘লেডি অফ বাযা’ আবিষ্কারের পর ধারণা করা হয়, হয়তো ‘লেডি অফ এলচে’-ও কোনো সিংহাসনে অধিষ্ঠিত মূর্তি ছিলো।

এই শিল্পকর্মগুলোর সাথে গ্রীক ও ফিনিশীয় জনগণের তৈরী বস্তুগুলোর যথেষ্ট মিল রয়েছে। মনে করা হয়, আইবেরিয়ানরা তাদের সাথেই ব্যবসা করতো। ফিনিশীয়রা সামুদ্রিক শামুক থেকে বেগুনী রং তৈরী করে নিজেদের সমাজকে অত্যন্ত বিত্তশালী করে তুলেছিলো এবং অনেকাংশে এর সুফল লাভ করেছিলো আইবেরিয়ানরা।

লেডি অফ বাযা ও প্রত্নসামগ্রী

‘লেডি অফ বাযা’-র শরীরে খোদাই করা অলংকারগুলো সত্যিই ভীষণ কৌতুহলী করে তোলে। রোম ও কার্থেজসহ ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের অন্যান্য অনেক সংস্কৃতির সাথেই যে আইবেরিয়ানদের মিথস্ক্রিয়া ঘটেছিলো, তারই প্রমাণ বহন করে মূর্তিটি। ‘লেডি অফ বাযা’ তৈরী হবার এক শতাব্দী পরই এই দুই শক্তির মধ্যে প্রচন্ড লড়াই হয়।

আইবেরিয়ানরা ‘আর্গার’ নামে পরিচিত একটি সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বেশ যোগ্য একজন নেতার অধীনে তাদের একটি সমাজ গড়ে উঠতো। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে এই আইবেরিয়ান সভ্যতা ভেঙে গিয়েছিলো এবং খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে আবারও একটি নতুন আইবেরিয়ান সমাজের উদ্ভব হতে শুরু করে। ‘আর্গার’ পূর্বপুরুষদের মতো তারাও ধাতব বস্তু তৈরীতে দক্ষ হয়ে উঠেছিলো এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বণিকদের সাথে ব্যবসার মাধ্যমে অত্যন্ত বিত্তবান হয়ে উঠেছিলো।

বর্গাকার একটি সমাধির দেয়ালে আটকানো ছিলো ‘লেডি অফ বাযা’। মূর্তিটির পাশেই একটি পাত্রের মধ্যে কোনো মানুষের দেহাবশেষ রাখা ছিলো। হয়তো এটি যার সমাধি, তার চেহারার আদলেই বানানো হয়েছিলো ভাস্কর্যটি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা শেষকৃত্যের শেষে হয়তো এভাবেই সমাধিস্থ করা হয়েছিলো তাকে। মূর্তিটির চেহারায় এতো বাস্তবিক ও মানবীয় ভাব দেখে ধারণা করা হয়, মূর্তিটি হয়তো অবিকল আসল নারীটিরই এক প্রতিচ্ছবি। যদিও এ নিয়ে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না।

প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রান্সিসকো প্রিসেডো ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে লেডি অফ বাযা আবিষ্কারের পরে © elpais.com

ভাস্কর্যটির সামনে তাকে উপাসনার জন্য বিভিন্ন নৈবদ্য রাখা ছিলো। ধাতব অস্ত্রসহ সিরামিকের পাত্রও পাওয়া গিয়েছিলো সেখানে। ঐ সময় নিশ্চিতভাবেই ফিনিশীয়দের সাথে আইবেরিয়ানদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো এবং ফিনিশীয়রা ‘কার্থেজ’ বা ‘নতুন শহর’ নামে যে শহরটি তৈরী করেছিলেন, সেই শহরের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো বলে মনে করা হয়। কারণ মূর্তিটির মধ্যে যে এক আধ্যাত্মিক ভাব আনার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি কার্থেজীয়দের প্রভাবের ফলেই ঘটেছে। এ জন্য ধারণা করা হয়, ডানাওয়ালা সিংহাসনটি আসলে কোনো দেবীর সিংহাসন, যার বাম হাতে কবুতর ধরে রাখা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইনি ফিনিশীয় মাতৃদেবী এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের প্রধান দেবী ‘তানিত’-এরই প্রতিরূপ। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে তানিতের উপাসনাই ছিলো কার্থেজের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

খ্রিস্টপূর্ব ২৬৪ সালে কার্থেজ ও রোমের যুদ্ধ শুরু হলে কার্থেজ আস্তে আস্তে স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ সালে রোমানদের দ্বারা বিতাড়িত হয় তারা। ফলে আইবেরিয়ান এই অঞ্চলটি রোমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং রোমানদের প্রভাবে স্থানীয় আইবেরিয়ান সংস্কৃতি ও ভাষা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

মানুষের জ্ঞানের অন্তরালে প্রায় ছয় ফুট মাটির নিচে ২৫০০ বছর লুকিয়ে থাকা আইবেরিয়ান শিল্পকর্ম ‘লেডি অফ বাযা’ প্রাচীন স্পেনের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অন্তঃর্দৃষ্টিকে উন্মোচিত করেছে। এতো বছর পর আলোর মুখ দেখা ভাস্কর্যটি স্পেনের এক গৌরবময় সংস্কৃতির প্রমাণ। বর্তমানে স্পেনের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে এটি সংরক্ষিত আছে।

বর্ণমালার উদ্ভাবক জাতি ফিনিশীয়দেরকে নিশ্চিহ্ন করে, তাদের সমস্ত লিখিত দলিল ধ্বংস করে নিজেদেরকে তাদেরই অবদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা রোমানরা নিজেদের ইচ্ছামতো ইতিহাস রচনা করে গেছে। এর মধ্যে কোনটা বাস্তব, আর কোনটা অলীক, তা জানবার কোনো উপায় নেই। অথচ ‘লেডি অফ এলচে’ এবং ‘লেডি অফ বাযা’-র মতো প্রত্নতত্ত্বগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আইবেরিয়ান সভ্যতার ওপর সবচেয়ে বেশি অবদান ছিলো কার্থেজীয়দের। ‘লেডি অফ বাযা’-র পাশে যে মাটির পাত্র মিলেছে, সেটিও কার্থেজীয়দের তৈরী। ভাস্কর্যগুলোর পোশাক-পরিচ্ছদ, হেয়ার-স্টাইল, গহনা, বসবার ভঙ্গি, মুখভঙ্গিমা –সমস্ত কিছুতে যে আধুনিকতার ছোঁয়া; তা স্পষ্টভাবেই এক সমৃদ্ধ ও শিল্পমনস্ক সভ্যতার পরিচায়ক। সুতরাং এ কথা বলাই যায়, রোমানদের লিখিত ইতিহাস সে সব সুদক্ষ ও সংস্কৃতিমনা শিল্পীদের সাথে সুবিচার করে নি। তবে কালে কালে ‘লেডি অফ বাযা’-র মতো প্রত্নসামগ্রী উন্মোচিত হয়ে প্রতিনিয়তই সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরতে থাকবে এবং আমরাও প্রতিনিয়তই নতুনভাবে উন্মোচিত এসব ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করতে সচেষ্ট হবো।

সদ্য উদ্ধারকৃত ভাস্কর্য ‘লেডি অফ বাযা’, যা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিলো তুমুল বিতর্কের ঝড় এবং অবশেষে তার ঠাঁই হয়েছিলো মাদ্রিদের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে © National Geographic

রেফারেন্সঃ