ক্লিফ রিচার্ডঃ একজন এভারগ্রীন ‘পিটার প্যান’ ও উপমহাদেশের গর্ব, Stay Curioussis

১৯৪০ সালের ১৪ অক্টোবর। দেরাদুন থেকে একটি গাড়ি রওয়ানা হয়েছে লখনৌ এর উদ্দেশ্যে। গাড়ির ভেতর প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ডরোথি মেরী। দেরাদুনে ভালো হাসপাতাল না থাকায় এমন গুরুতর অবস্থায় লখনৌ যেতে হচ্ছে ওয়েব পরিবারের সবাইকে। অবশেষে লখনৌ এর ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটের কিং জর্জেস হাসপাতালে জন্ম নিলো ফুটফুটে একটি শিশু। পরিবারের কেউই ভারতীয় না হলেও অদ্ভূতভাবে শিশুটি গায়ের রং পেলো ভারতীয়দের মতো। এ যেনো জন্মস্থানের সাথে শিশুটির অলিখিত যোগসূত্রেরই দলিল। তার নাম রাখা হলো হ্যারি ওয়েব। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো হ্যারি। গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলোতে দাদা ফ্রেডরিক ওয়েবের কাছেই থাকতো সে। লখনৌ এর মাকবারা কলোনির ২৬ নম্বর বাড়িটা সারা গ্রীষ্ম মুখরিত হয়ে থাকতো হ্যারির দুষ্টুমিতে। সুন্দর দিনগুলোর মাঝে হঠাৎ করেই ঝড়ের মতো হ্যারির জীবনে এলো ১৯৪৭ সাল। ব্রিটিশ হবার কারণে ভারতীয়দের চোখে প্রচন্ড ঘৃণা দেখে পরিবারের সাথে ব্রিটেনে ফিরতে হলো সাত বছরের ছোট্ট ছেলেটিকে।

ক্লিফ রিচার্ডঃ একজন এভারগ্রীন ‘পিটার প্যান’ ও উপমহাদেশের গর্ব, Stay Curioussis

ক্লিফ রিচার্ড ১৮ মাস বয়সে

কিন্তু এ তো হ্যারির কাছে অন্য গ্রহের সমতুল্য একটি স্থান। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি জায়গায় এসে খাপ খাওয়ানোই যেখানে ছোট্ট হ্যারির কাছে বিশাল বোঝা, সেখানে ভারতীয় গায়ের রং নিয়ে সাদা চামড়ায় ভর্তি শিশুদের সাথে সহপাঠও হ্যারির জন্য হয়ে ওঠে দুঃসহ। তুলনামূলক কম সাদা গায়ের রং ও উচ্চারণে ভারতীয় টানের জন্য ক্রমাগত আক্রমণাত্মক ব্যবহার ও বুলিং এর শিকার হওয়া ছোট্ট হ্যারি যখন নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলতে বসেছিলো, ঠিক তখনই তার জীবনে আবির্ভাব হয় এক নতুন অধ্যায়ের, মিউজিকের। ঠিক যেনো মৃতপ্রায় প্রাণকে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেবার মতো করে নতুন প্রাণ নিয়ে হ্যারির দরজায় কড়া নাড়লো মিউজিক। আবারো নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলো হ্যারি। একদম কিশোর বয়সেই রেকর্ড ছাড়ালো তার প্রথম হিট গানটি, ‘লিভিং ডল’। শুরু হলো পপ সংগীতের এক নতুন অধ্যায়। আর হ্যারি ওয়েব পেলো এক নতুন পরিচয়, তার নতুন স্টেজ নাম হলো ‘ক্লিফ রিচার্ড’।

ক্লিফ রিচার্ডঃ একজন এভারগ্রীন ‘পিটার প্যান’ ও উপমহাদেশের গর্ব, Stay Curioussis

ক্লিফ রিচার্ড এর মা এবং বাবা

ক্লিফ রিচার্ড নিজের পরিচয় থেকে ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ ট্যাগটি কখনো আলাদা করতে পারেন নি। তবে আসলেই তিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কি না, যুক্তির বিচারে কিন্তু সেই প্রশ্ন রয়েই যায়। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলতে আমরা তাদেরকেই বুঝি, যাদের রক্তে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংমিশ্রণ রয়েছে। কিন্তু ক্লিফ রিচার্ডের মা-বাবা, এমনকি দাদা-দাদীও ছিলেন ব্রিটিশ। তবে তার নানীর মা ছিলেন কিছুটা মেডিটেরিনিয়ান চেহারার হাফ-স্প্যানিশ মহিলা এবং তার দাদী ডোনেলা ইউজিনকে বার্মিজ বংশধর মনে করা হয়। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে তার যোগসূত্র তৈরী হয় তখন থেকে, যখন থেকে তার দাদার বাবা কাজের সন্ধানে এখানে এসেছিলেন। বলা যায়, ক্লিফ রিচার্ডের আগের কয়েক জেনারেশনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই উপমহাদেশেই। তাই শেকড় ব্রিটেনের হলেও পাতা, ফুল, ফল –সবই ভারতীয়। হয়তো এ কারণেই কয়েক জেনারেশন পরের ক্লিফ রিচার্ডের চেহারা কিছুটা ভারতীয় রূপ পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ট্যাগের কারণে তার ছেলেবেলাটা কেটেছে নিদারুণ কষ্টে।

ক্লিফ রিচার্ডঃ একজন এভারগ্রীন ‘পিটার প্যান’ ও উপমহাদেশের গর্ব, Stay Curioussis

ক্লিফ রিচার্ড ভাই বোন দের সাথে। উনার ৮০তম জন্মদিনে প্রথম এই ছবি প্রকাশ করেন উনি।

ক্লিফ রিচার্ডের বাবা রজার ওয়েবের পড়ালেখা এলাহাবাদের একটি স্কুলেই হয়েছিলো এবং এ জন্য হিন্দি ভাষায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। অন্য দিকে, ক্লিফ রিচার্ডের মা ডরোথি মেরীর সাথে যখন রজার ওয়েবের দেখা হয়, তখন ডরোথি পশ্চিম বাংলার আসানসোলে নিজের মা ও সৎ বাবার সাথে থাকতেন। পরবর্তীতে ক্লিফ রিচার্ডও রাজপুর রোডের সেইন্ট থমাস স্কুলে পড়েছিলেন। তাই হিন্দি ও বাংলা ভাষার সাথে ক্লিফ রিচার্ডের পরিচয় কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়।

ক্লিফ রিচার্ড একাধারে একজন পপ তারকা, বাদ্যযন্ত্রী, অভিনেতা, পারফর্মার এবং মানবহিতৈষী। বিটলস এবং এলভিস প্রেসলির পরই তার নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি রেকর্ড বিক্রি করা এই শিল্পীর বয়স বর্তমানে ৮১ বছর। তবে বয়স তার তারুণ্যকে বেঁধে রাখতে পারে নি। এখনও তিনি মঞ্চ-কাঁপানো তারুণ্যেভরা ‘পিটার প্যান’-ই রয়ে গেছেন। কোভিড মহামারীর জন্য দেয়া লকডাউনেও তিনি বাচ্চাদেরকে বিনোদন দেবার জন্য নিজের বাসায় নেচে গেয়ে ভিডিও পোস্ট করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে। এই বয়সেও রয়্যাল অ্যালবার্ট হলকে নাচাতে কার্পণ্য করেন না ক্লিফ রিচার্ড।

ক্লিফ রিচার্ডঃ একজন এভারগ্রীন ‘পিটার প্যান’ ও উপমহাদেশের গর্ব, Stay Curioussis

ক্লিফ রিচার্ড এর একটি গানের রেকর্ড

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে তার অসংখ্য ভক্ত। আমরাই তো ছেলেবেলা থেকে সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দায় ক্লিফ রিচার্ডকে দেখে ও তার গান শুনে বড় হয়েছি। তার ‘সামার হলিডে’ গানটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবানদের একজন, কারণ আমি আমার প্রিয় শিল্পীর একটি অটোগ্রাফ অর্জন করতে পেরেছি।

‘লিভিং ডল’ ও ‘সামার হলিডে’ ছাড়াও ‘মুভ ইট’, ‘দ্য ইয়াং ওয়ান্স’, ‘কংগ্রাচুলেশন্স’, ‘ডেভিল ওম্যান’, ‘সেভিয়ার্স ডে’, ‘উই ডোন্ট টক এনিমোর’ ইত্যাদি অসংখ্য হিট গান দিয়ে ক্রমাগত রেকর্ড গড়েছেন তিনি। এমনকি ২০২০ সালেও ‘দ্য এয়ার দ্যাট আই ব্রীদ’ নামে তার একটি অ্যালবাম বের হয়েছে।

ক্লিফ রিচার্ডঃ একজন এভারগ্রীন ‘পিটার প্যান’ ও উপমহাদেশের গর্ব, Stay Curioussis

১৯৬২ সালে লন্ডনের ৫৯ ক্লাবে প্রিন্সেস মার্গারেট (বাম) এবং রিচার্ড

লখনৌ এর কৃষ্টি-সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমরা শুধু ওয়াজেদ আলী শাহকেই পাই নি, বরং পৃথিবীর আরেক প্রান্তে নিজেকে প্রতিষ্ঠাকারী ৮১ বছরের তরুণহৃদয় শিল্পী ক্লিফ রিচার্ডও কিন্তু আদতে আমাদেরই একজন, যা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তিনি সম্মানিত হলে আমরাও সম্মানিত হই; কারণ এই আকাশের নিচে, এই আলো-বাতাসেই তার বেড়ে ওঠা। তিনি হয়তো বর্তমানে এই উপমহাদেশে থাকেন না, হয়তো লখনৌ এর পথে এখন আর তিনি হাঁটেন না, কিন্তু এই উপমহাদেশের প্রতি তার হৃদয়ের টান একদমই মুছে যায় নি। এখনও ১৪ অক্টোবরে নিজের জন্মদিন পালনের সময় ‘ইন্ডিয়ান কারি’ খেতে কখনোই ভুলে যান না কিংবদন্তী ক্লিফ রিচার্ড।

ক্লিফ রিচার্ডঃ একজন এভারগ্রীন ‘পিটার প্যান’ ও উপমহাদেশের গর্ব, Stay Curioussis

স্যার ক্লিফ রিচার্ড