আলু পোস্ত। বাঙ্গালীর খাবার তালিকায় আলু পোস্ত বা পোস্তর ভর্তা খুব জনপ্রিয় ও মুখরোচক একটি খাবার। কিন্তু আমরা জানিনা এই খাবারটির পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কত বিষাদময় অভিজ্ঞতা। কত কষ্ট, কত বঞ্চনা, কত ক্ষোভ, কত মৃত্যু রয়েছে এই নতুন খাবারটির উদ্ভবের পিছনে। সেই ইতিহাসটুকু জানানোর প্রয়াস করছি।
আফিম বা পপি বীজ বা খাস খাস এই নামগুলোর সাথে ভারতবর্ষ বহু আগে থেকেই পরিচিত। উপমহাদেশের অনেক প্রাচীনতম বই “ধন্বন্তরি নিঘন্টু” তে এই পপি বীজের ঔষুধি গুণাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। প্রায় ২০০০ বছর আগে এই উপমহাদেশে পপির চাষ করা হতো। মোঘল আমলে এই পপি বীজ মনোরঞ্জন করার ঔষুধি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এটি ধীরে ধীরে মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে একটি বিনোদনমূলক মাদক হিসাবে রূপ নিয়েছিল। মোঘল নারীরা এই পপি বীজ অনেকটা শখ করেই খেতেন। সুন্দর ক্রিমসন ফুলটি প্রাসাদের শোভা যেন কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বৃদ্ধ ও শিশুদের এটি দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে দেয়া হতো কারণ এই পপি বীজ শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করতো। তখন রাজকীয়ভাবে এই ফুলের চাষ করা হতো, কিন্তু এই পপি তখন রাজ্ পরিবারের বাইরে কেউ খেতো না। গল্পটি হয়তো মোঘলদের প্রাসাদের ভিতরেই শেষ হয়ে যেত, যদি না পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা আফিমের একট বিশাল বাজার চীনে আবিষ্কার না করতো। ব্রিটিশরা এই পপি বীজ চাষ করা শুরু করে। তখন থেকেই একটি ঔষুধি একটি মাদক দ্রব্যে পরিণত হয়; যা মানুষকে বিকলাঙ্গ করে, অসুস্থ করে। এভাবেই এই পপি প্রথমে ঔষুধ, তারপর মনোরঞ্জনের দ্রব্য, আর পরবর্তীতে একটি মাদক দ্রব্যে পরিণত হয়।
ব্রিটিশরা তখন পপি চাষের জন্য বাংলার এই উর্বর জমিকেই উপুযুক্ত জমি হিসেবে বেছে নিলো। এতে করে বাংলার কৃষক তাদের জমিতে নিত্য প্রয়োজনীয় ফসল যেমন, ধান, গম বা অন্যান্য ফসল উৎপাদন করতে পারছিলো না। যে বাংলার জমিতে উৎপাদিত ফসল গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় খাদ্যের চাহিদা মেটাতো, সেই জমিতেই শুরু হলো আফিমের চাষ। কিন্তু কৃষকরা কি করবে? তারা তো আর আফিম খেতে পারে না। তারা কষ্ট করে উৎপাদন করছে ঠিকই, কিন্তু তা কোন খাদ্যদ্রব্য ছিল না। অনাহারে, অনিদ্রায় তাদের দিন কাটতে লাগলো।
কৃষকরা তখন খুব অসহায় হয়ে পরে। না খেয়ে কাজ করাও তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো। অন্যদিকে আবার ব্রিটিশদের অমানষিক অত্যাচার। একে তো খাবারের অভাব, অন্যদিকে বিট্রিশদের অত্যাচারে কৃষকদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ধান চাষ করতে পারতো না, তাই ভাত তাদের কপালে জুটতো না। তিনবেলা তো দূরেই থাকে, একবেলার খাবার হিমশিম খেতে হতো তাদের। মাঠে ঘটে, বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল শুধু একটু খাবারের আশায়। কেউ কেউ না খেতে পেয়ে চলে গিয়েছিলো না ফেরার দেশে। ক্ষুধার জ্বালা যে কি নির্মম তা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এভাবেই একদিন সেই খাবারের সন্ধান করতে করতে একসময় তারা আবিষ্কার করে এই পপি বীজকে বাটলে বাদামের মতো গন্ধ বের হয় আর এটি সরিষা বা সরিষার তেলের সাথে খুব ভালোভাবে মিশে যায় এবং শরীরকেও ঠান্ডা রাখে। এই পপি বীজের পেস্টটি আলুর সাথে রান্না করে খেলে খুবই সুস্বাদু একটি খাবার হয়। এই থেকেই জন্ম হয় বাঙ্গালীর রান্নাঘরের জনপ্রিয় খাবার আলু পোস্ত বা পোস্তর ভর্তার।
ক্ষুধায় কাতর বাঙ্গালীর কাছে তখন এই খাবারটি ছিল অমৃত। ভাতের ক্ষুধা অনেকটা আলু পোস্ত দিয়েই পুষিয়ে নিচ্ছিলো। কিন্তু একটি ব্যাপার ভেবে অবাক লাগে, এই আফিম বা পপি বীজ, যা একটি মাদক হিসেবে উৎপাদন করা হতো, সেই পপি বীজ বা পোস্ত খেয়ে বাঙ্গালীরা মাদকের দিকে আসক্ত হয়ে পড়েনি। যদি বাঙ্গালী এই কৃষক শ্রেণীর মানুষেরা সেই সময় মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে যেত, তাহলে হয়তো আজ এই বাঙালী জাতির কোন অস্তিত্বই থাকতো না। হয়তো তখন আমাদের আরেকটি চীন দেখতে হতো, যে দেশটি মাদকের থাবায় প্রায় ধ্বংসই হয়ে গিয়েছিল।
আলু পোস্ত খাবারটি যদিও পশ্চিম বাংলায় প্রচলিত খাবার, কিন্তু পদ্মা যদি পেরিয়ে এই জনপ্রিয় খাবারটি পূর্ব বাংলার প্রতিটি বাঙালির রান্নাঘরে প্রবেশ করতে সময় নেয়নি। এখন অবশ্য এই পোস্ত বাটা বিভিন্ন শাক-সবজি, মাছ বা অন্য তরকারির সাথেও খাওয়া হয়। আর যে কোন তরকারিতে এর স্বাদ অতুলনীয়।
স্বাধীনতার পরে, সরকার আফিম বা পপি বা পোস্ত চাষে কঠোর চাপ প্রয়োগ করে। অভাব, ব্রিটিশদের অত্যাচার বা ক্ষুধার তাড়নায় একসময় কৃষকরা এই পোস্ত খেতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু গরিব কৃষকদের পেট ভরার জন্য এই খাবার শুধু বাঙালিদের কাছেই না, পুরো ইউরোপেসহ বিশ্বের প্রায় অনেক দেশেই এটি খুব জনপ্রিয়। পোস্তর প্রেস্টি, বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি জাতীয় খাবারে পশ্চিমা দেশগুলোতে পোস্তর ব্যবহার আছে।
খুব সাধারণ একটি খাবার এই আলু পোস্ত। কিন্তু কি নিদারুন ইতিহাস, কত লোভ, কত অত্যাচার, কত বঞ্চনা, কত মৃত্যু জড়িয়ে আছে এর পেছনে ভাবতেই অবাক লাগে। আমাদের সেইসব কৃষকদের প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকা উচিত কারণ, তাদের এই ত্যাগের কারণেই আমরা আজও একটি জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছি। ব্রিটিশদের লোভ, অত্যাচার বা মাদকের থাবায় আমাদের সেই গরিব, অসহায়, নিরুপায় কৃষকরা হারিয়ে যায়নি। আর আমাদেরকে উপহার দিয়েছে আলু পোস্তর মতো মজাদার একটি খাবার।