টিএসসি এর ভেতরের গ্রিক মন্দির, Stay Curioussis
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ভেতরের লম্বা করিডর ধরে হেঁটে গিয়ে বামদিকের খোলা মাঠের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে হালকা হলুদরঙা ছোট্ট এক স্থাপনার। স্থাপত্যরীতির দিক থেকে একেবারেই বেমানান জরাজীর্ণ এই স্থাপনাকে দেখে অনেক ছাত্র-শিক্ষকই হয়তো একে স্রেফ এড়িয়ে গেছেন। কেউ হয়তো কৌতূহলী হয়ে উঁকিঝুঁকিও মেরেছেন, আবার গেটের ওপরে খোদাই করা ‘আঁকাবাঁকা ইংরেজি’ বর্ণগুলো দেখে কেউ কেউ হয়তো স্থাপনাটি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানার চেষ্টা করেছেন। তবে এড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা হয়তো ভাবতেও পারেননি এই স্থাপনাটির সাথে জড়িয়ে আছে হোমার-সক্রেটিসের দেশের ইতিহাস!
আরমানিটোলার আর্মেনীয় গির্জা বা পোগোজ স্কুলের কারণে আর্মেনীয়দের নাম কিছুটা উচ্চারিত হলেও কালের আবর্তে মাউন্ট অলিম্পাসে থাকা জিউসের সন্তানদের কথা ভুলে গেছে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই। টিএসসি কোণে অযত্নে পড়ে থাকা ঐ স্থাপনাটিই পূর্ববাংলার বুকে টিকে থাকা গ্রিকদের একমাত্র চিহ্ন।
টিএসসি এর ভেতরের গ্রিক মন্দির, Stay Curioussis
বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় বাংলা একসময় ছিল ইউরোপীয় বণিকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। বণিকরা ভারতে পা রাখার আগেও ভারতবর্ষ ও মালাক্কার প্রয়োজনীয় রসদের যোগান দেওয়া হতো বাংলা থেকে। বাংলার সেই জৌলুস হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে ঔপনিবেশিক এই স্থাপনাগুলো এখনো জানান দেয় বাংলার গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কথা। বাণিজ্যবিমুখতার কারণে বাংলার সেই গৌরব অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। এই হারিয়ে যাওয়া গৌরবকেই হয়তো ব্যঙ্গ করা হয়েছে টিএসসির স্মৃতিস্তম্ভের ওপরের লেখাটির মাধ্যমে:
 
ΜΑΚΑΡΙΟΙ ΟΥΣ ΕΞΕΛΕΞΩ ΚΑΙ ΠΡΟΣΕΛΑΒΟΥ
Blessed are those whom You chose and took with You..
 
১৯১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় স্মৃতিস্তম্ভটির একটি ছবি প্রকাশ করা হয়, ছবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, রমনা রোডের ডানপাশে থাকা গ্রিক সমাধিক্ষত্র পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় লোকজন পাথরের সমাধিফলকগুলো চুরি করে নিজেদের বাড়ি বানানোর কাজে ব্যবহার করছে। প্রতিবেদনটি দেখে তৎকালীন ব্রিটিশ পাদ্রী ফাদার মিডলটন ম্যাকডোনাল্ড পূর্ব বাংলার চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে অনুরোধ করেন পরিত্যক্ত সমাধিক্ষেত্রটির ব্যপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে।
অবশেষে গভর্নর লর্ড কারমাইকেল সমাধিফলকগুলো রক্ষা করার জন্য আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার নির্দেশ দেন। স্মৃতিস্তম্ভটির ভেতরে ১০টি সমাধিফলক স্থাপন করা হয়। র্যালি ভ্রাতৃদ্বয়ের অনুরোধে ভারতবর্ষের অর্থোডক্স গির্জার প্রধান আথানাসিওস অ্যালেক্সিও কলকাতা থেকে স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করতে আসেন। ১৯২১ সালে স্মৃতিস্তম্ভের জায়গাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তবে স্থাপনাটিকে আর সরিয়ে নেওয়া হয়নি।
টিএসসি এর ভেতরের গ্রিক মন্দির, Stay Curioussis

গির্জার পুরানো ছবি

অনেক সমাধিফলক থাকলেও মাত্র ১০টি সমাধিফলক কেন স্মৃতিস্তম্ভটির ভেতরে স্থাপন করা হলো, তা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। র্যালি ভাইদের ম্যানেজার এবং ভারতে গ্রিসের রাষ্ট্রদূত থিওডোরোস পৌলিসের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যখন শুরু করা হয়, তখন পুরো জায়গাটি আবার ঢেলে সাজানো হয়। গ্রিকদের গোরস্থানটির উপর মাটি ঢেলে ঘাসের লন বানানো হয়। অর্থাৎ, টিএসসির সবুজ মাঠটি আদতে গ্রিকদের সমাধিস্থল ছিল!
টিএসসি এর ভেতরের গ্রিক মন্দির, Stay Curioussis

গির্জার আর্কিটেকচার নকশা

১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় স্মৃতিস্তম্ভটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এর আগেও হতে পারে। দীর্ঘদিন অবহেলার মধ্যে পড়ে থাকা স্থাপনাটিকে অবশেষে ১৯৯৭ সালে নয়াদিল্লীর দূতাবাসের মাধ্যমে গ্রিক সরকার সংস্কার করার উদ্যোগ নেয় এবং সেই থেকে প্রায়-হলুদরঙা স্মৃতিস্তম্ভটি ওখানেই রয়েছে।
 
লেখকঃ Reza Ghatok