“…তিনি মৃত তবু জীবিতের চেয়ে/ অনেক সজীব এবং কান্তিমান/ ভবিষ্যতের জন্য হেলায়/ দিয়েছেন ছুড়ে আপন বর্তমান।/ বুলেট বিদ্ধ মোহন গেরিলা/ প্রসারিত আজ নিখিল ভূমণ্ডলে।/ লেখার টেবিলে, কপাটে, দেয়ালে/ চে গুয়েভারার সুবিশাল চোখ জ্বলে।” – শামসুর রাহমান, চে গুয়েভারার চোখ।

বিপ্লব কখনো বিপ্লবীর মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে যায় না। তাই আজকের ও আগামীর বিপ্লবীদের মাঝে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অন্যতম চে, চে গেভারা। দুনিয়াব্যাপী ‘চে’ নামে পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম আর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা। স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রিয়’; কিউবায় সফল বিপ্লবের পর তাঁর কিউবান কমরেডরা তাঁর নাম দেন ‘চে’। তিনি এই নামটিকে এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল, অর্থাৎ তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি তাঁর স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহার করতেন শুধুই এই শব্দটি- ‘চে’।

চে’র স্বাক্ষর

১৯২৮ সালের ১৪ই জুন আর্জেন্তিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের উত্তর পূর্বে রোসারিও গ্রামে চে জন্মগ্রহণ করেন; পিতা আর্নেস্তো গেভারা লিনচ ও মাতা সিলিয়া দে সেরনা। আইরিশ পিতা ও স্প্যানিশ মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চে’ই ছিলেন সবার বড়। শৈশব থেকেই একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে উঠবার কারণে রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন চে। সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা চে’র পরিবারে ছিল তিন হাজারেরও বেশি বই যা চে’কে করে তোলে সমাজসচেতন। কার্ল মার্কস, ভ্লাদিমির লেলিন, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সরগারির বইয়ের পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু, আলবার্ট ক্যামাস, রবার্ট ফ্রস্টের বই পড়েছেন তিনি। এবং এভাবেই নিজেকে একজন সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

কিশোর বয়সে গেভারা (বামে) তার পরিবারের সাথে। বাম থেকে ডানে: মা, বোন, রবার্তো, হুয়ান মার্টিন, বাবা এবং মারিয়া।

মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হন কিন্তু খুব ছোটবেলাতেই এই রোগের সাথে যুঝতে গিয়ে তাঁর মধ্যে প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর মানসিক দৃঢ়তা বিকাশ লাভ করে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি খেলাধূলাতেও পারদর্শীও ছিলেন। সাঁতার, গলফ, ফুটবল, শুটিং, সাইক্লিং, রাগবি, ঘোড়সওয়ারি যাই হোক না কেন; কিছুই বোধহয় বাদ দিতে চাননি চে, হয়তো জীবনের কোন স্বাদই! ১১ বছর বয়সে পিতার কাছে দাবা খেলা শেখার পর থেকে প্রায়ই বুদ্ধি শানিয়ে নিতেন দাবার ছকে।

১৯৪৬ সালে আর্নেস্তো বুয়েন্স আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে ভর্তি হন। প্রথম দিকে তিনি একজন প্রখ্যাত গবেষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু তাঁর ভ্রমণপিপাসু মনে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের ঝোঁক চাপে। ১৯৫১ সালে ২৩ বছর বয়সী আর্নেস্তো ২৯ বছর বয়সী বন্ধু আলবার্তো গ্রানাডোর সাথে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণে বের হন। চে’র ‘মোটরসাইকেল ডায়েরীস’ থেকে পাওয়া যায় এই অভিযানটির কথা যার উদ্দেশ্য ছিল মূলত পেরুর সান পেবলোর লেপার কলোনিতে (কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ কলোনি) স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কয়েক সপ্তাহ কাজ করা।

১৯৫১ সালে ২২ বছর বয়সী গেভারা

এই ভ্রমণ তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। এর মাধ্যমে তাঁর চোখে ধরা পড়ে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ কষ্ট, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সার্বিক অসহায়ত্ব। তিনি দেখতে পান তাঁর চেনা জগতের সাথে সমান্তরালে বয়ে চলা এক অচেনা জগত যা শোষিত মানুষের জগত। এই ভ্রমণ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চে বুঝতে পারেন যে, ঐ অঞ্চলের বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। তিনি অনুভব করেন, পরিবর্তন অনিবার্য; আর এই পরিবর্তনের জন্য আরো বেশি অনিবার্য একটি সশস্ত্র বিপ্লব। তিনি বিশ্বাস করতেন বিপ্লব কেউ কাউকে প্রদান করে না, বিপ্লব ছিনিয়ে আনতে হয়, বিপ্লব ঘটাতে হয়। কেউ কাউকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে দেয় না, মুক্ত নিজেদেরকেই হতে হয়।

চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার পর ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে চে তাঁর দ্বিতীয় লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ শুরু করেন। বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা ও হন্ডুরাস হয়ে চে গুয়েতমালায় যান। সেখানে পেরুর রাজনৈতিক কর্মী হিল্ডা গাদিয়ার সাথে আর্নেস্তোর পরিচয় হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে হিল্ডা ও চে বিবাহ করেন। এই গুয়েতমালায় রাষ্ট্রপতি জ্যাকোবো অরবেঞ্জ গুজমানের নেতৃত্বাধীন সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে চে জড়িয়ে পড়েন ১৯৫৪ সালে। কিন্তু হণ্ডুরাস থেকে সিআইএ-এর সমর্থন পুষ্ট হানাদার বাহিনী গুয়েতমালায় আক্রমন করে। প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে অরবেঞ্জ পদত্যাগ করলে চে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং তাঁর বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা দৃঢ়তর হয়।

চিচেন ইতজাতে হিল্ডা গাদেয়ার সাথে গেভারা,তাদের মধুচন্দ্রিমার পথে।

১৯৫৫ সালে মেক্সিকোতে গিয়ে ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রোর সাথে চে’র পরিচয় হয়। ফিদেল চে’কে তাঁর গেরিলা বাহিনীতে গ্রহণ করেন এবং চে তাঁদের ‘ছাব্বিশে জুলাই’ আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য সমুদ্রপথে তাঁরা কিউবায় প্রবেশ করেন। কাস্ত্রো গেরিলা যুদ্ধের জন্য সিয়েরা মায়েস্ত্রোর পার্বত্য অঞ্চলকে বেছে নেন। বিশাল সবুজ বনাঞ্চলে ঢাকা ৬,০০০ ফুট উঁচু এই পার্বত্য অঞ্চলটিতে ১৯৫৬-এ শুরু হয় গেরিলাদের সংগ্রামী প্রশিক্ষণ।

১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে চে গেভারা আন্দোলন, যার মধ্যে ছিল গুয়াতেমালার উত্তরে ভ্রমণ।

খুব অল্পদিনেই চে বিপ্লবীদলের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কম্যাণ্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিউবান বিপ্লবে চে ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। লাতিন আমেরিকার বিপ্লবে ডাক্তাররা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে চে একটি বই লেখেন। দুবছর পর ১৯৫৮ সালে সফল হয় কিউবান বিপ্লব। কিন্তু বিপ্লবীদের কাছে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন সরকার গঠন করা ও দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পরাজিত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের মনে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠেছিল তা মেটানোর দায়িত্বও ছিল বিপ্লবীদের উপর।

বিপ্লব পরবর্তী এই সময়টিতে চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন করেন চে। এই পদাধিকারবলে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান। এর ফলে এই বাহিনী পিগ উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৯৫৭ সালে কিউবায় গেরিলাযুদ্ধ চলাকালে কোনো এক মুহূর্তে (পেছনে বাঁ থেকে দ্বিতীয়) চে গুয়েভারা এবং দাঁড়িয়ে আছেন ফিদেল কাস্ত্রো।

কিউবার মহান বিপ্লবকে চে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের ১লা এপ্রিল চে তাঁর কঙ্গো অভিযানের জন্য ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন। আর ফিদেলের জন্য রেখে যান তাঁর সেই ঐতিহাসিক চিঠি। আবেগ ভারাক্রান্ত সেই চিঠিতে চে লিখেছেন, “আমি পার্টি নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করছি। আমার মন্ত্রীর পদ, কম্যাণ্ডারের পদবী এবং কিউবার নাগরিকত্ব ত্যাগ করছি। কিউবার সঙ্গে আমার কোন আইনি সম্পর্কই থাকলো না, টিকে রইল শুধু সেই বন্ধন যা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করা যায় না।” চে আরো লিখলেন, “অন্য কোনো ভূমি, অন্য কোনো দেশ আমাকে আহ্বান করছে যথাসাধ্য কাজের জন্য। সে আহ্বানে আমি সাড়া দিতে পারি, কিউবার অগ্রনায়কের দায়িত্ব পালনের কারণে তুমি তা পারো না। তাই আমাদের বিচ্ছেদের সময় ঘনিয়ে এসেছে।”

চে কঙ্গোতে ছিলেন মাত্র ছ’মাস। কঙ্গোর স্থানীয় কমিউনিস্ট পর্টি সহযোগিতা না করায় এবং স্থানীয় ভাষা ও মানুষের চরিত্র বুঝে উঠতে না পারায় চে’র কঙ্গো অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। তিনি অভিযানের ব্যর্থতা স্বীকার করে গেরিলা বহিনীকে দেশে ফেরত পাঠান। আর প্রাগ হয়ে হাভানায় ফিরে আসার পথে ডায়েরীতে লেখেন, “যে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে মনোবৃত্তি নেই আমরা তাদের মুক্ত করতে পারি না।” চে সত্যিকার মার্ক্সবাদীদের মত আত্মবিশ্লেষণ করতেন। নিজের ভুলগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিখে রাখতেন। কঙ্গোর ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি বই লিখেছিলেন যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘পর্সাজাস ডি লা গুয়েরা রেভ্যুলুসানিয়া কঙ্গো’, প্রথম পাতায় লিখেছেন ‘ব্যর্থতার ইতিহাস’।

চে কঙ্গোতে

চে’র পরবর্তী গন্তব্য ছিল বলিভিয়া। বলিভিয়া ছিল লাতিন আমেরিকার কেন্দ্রে, তাছাড়া তখন পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বলিভিয়ার মাটিই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত। তাই বিপ্লব পরিচালনার জন্য বলিভিয়াকে বেছে নেয়া হয়। সেখানে বসে চে স্বপ্ন দেখতেন একদিন বলিভিয়ার বিপ্লব দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়বে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে। বিপ্লবের সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। বলিভিয়া হবে আরেকটি ভিয়েতনাম। কিন্তু তাঁর এই স্বপ্ন সত্যি হয়নি। দুঃখজনক ভাবে বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি মোঞ্জের বিশ্বাসঘাতকতা, বলিভিয়া সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ, স্থানীয় কৃষকদের অসহযোগিতা, রসদ ও ওষুধপত্রের অপ্রতুলতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে চে’র বলিভিয়ার বিপ্লব ব্যর্থ হয়। দীর্ঘ ১১ মাস সংগ্রামের পর ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে চে ধরা পড়েন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় লা হিগুয়েরাতে।

বলিভিয়ান হাইকম্যাণ্ড থেকে চে’কে হত্যার নির্দেশ আসে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে চে গেভারা সৈনিকদের বলেছিলেন, “আমাকে গুলি কোরো না। আমি চে গেভারা, আমাকে মেরে ফেলার পরিবর্তে বাঁচিয়ে রাখলে তোমাদের বেশি লাভ হবে।” কিন্তু তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর সারারাত বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে আটকে রেখে তাঁকে হত্যা করা হয়। বলিভিয়ার সার্জেন্ট মারিও টেরান মদ্যপ অবস্থায় চে’র কোমরের নীচে তাক করে গুলি করে। গুলি করার পর চে আরো ঘন্টাখানেক বেঁচে ছিলেন। পরিকল্পিতভাবে চে’কে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্যই ওঁর মাথায় বা বুকে গুলি না করে কোমরে গুলি করা হয়েছিল। পরে বুকের বাঁদিকে গুলি করে এই মহান বিপ্লবীকে হত্যা করা হয়।

মৃত্যুর পর বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার মৃতদেহ এভাবে প্রদর্শন করা হয়েছিল, ১৯৬৭।

চে’কে ধরা ও হত্যা করার পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। মৃত্যুর পর তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। তাঁকে হত্যার পেছনে লাতিন আমেরিকার একনায়ক শাসক আলফ্রেদো ট্রয়েসনারের হাত ছিল বলে তথ্য দিয়েছেন প্যারাগুয়ের গবেষক মার্টিন আলমাদা। কারণ চে তাঁর বিরুদ্ধেও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারেন বলে তাঁর ভয় ছিল। আসলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চরিত্রটাই এমন। তারা পৃথিবী জুড়ে মানবাধিকার ও শান্তির বার্তা প্রচার করে আর খনিজ তেল ও অস্ত্র বিক্রির স্বার্থে দেশে দেশে যুদ্ধ ও গণহত্যা চালিয়ে যায়।

বিপ্লবী চে, ডাক্তার চে’র পাশাপাশি চে একজন লেখকও ছিলেন। তিনি কিউবান ভাষায় প্রায় ৭০টি নিবন্ধ লেখেন। গেরিলা যুদ্ধের ওপর তিনি একটি ম্যানুয়েল রচনা করেন। লিখেছেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর কাছাকাছি। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে ৭০টির মত সংগৃহীত আছে। তাছাড়া প্রতিদিনের ঘটনাবলী লিখে রাখার অভ্যাস ছিল তাঁর। গেরিলা যুদ্ধকালীন যখন সবাই বিশ্রাম নিত তখন অন্যদের অবাক করে দিয়ে চে তার নোটবই বের করে ডাক্তারদের হস্তাক্ষরের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রায় অস্পষ্ট অক্ষরে লিখে চলতেন ডায়েরী। এই ডায়েরীটি তার বলিভিয়ার ডায়েরী বলে খ্যাত। এই ডায়েরীতে গেরিলা প্রধান হিসেবে তার দৃঢ়চরিত্রের বারংবার প্রমাণ মেলে।

চে’র মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, “একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।” টাইমস পত্রিকা বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির যে তালিকা করেছে সেখানেও তাঁর নাম রয়েছে।

“চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়/ আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা/ আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ/ শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস…/ বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা/ তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর/ তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে/ নেমে গেছে/ শুকনো রক্তের রেখা…।” – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়ঃ  প্যারালাল II Parallel