ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি লোকশ্রুতির এক চরিত্র বনবিবি। সুন্দরবনের বনবিবিকে ঐ অঞ্চলের জনপদের কে না ভক্তি করে- হিন্দু-মুসলমান, সবাই। পুরোনো জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, বনবিবি ছিল মক্কার দরিদ্র এক ব্যক্তি, ব্রাহিমের (ইব্রাহিম?) কন্যা। সুদূর আরব থেকে সুন্দরবনে বনবিবি এসেছিল অলৌকিক ভাবে প্রাপ্ত দু’টো জাদুর টুপির উপর চড়ে, সাথে এনেছিল তার সঙ্গী শাহ জাংগালীকে।

দয়াপুর বনবিবি মন্দির

উদ্দেশ্য, আঠারো ভাটির দেশের সুন্দরবনকে রক্ষা করা। বনবিবিকে তাই ঐ এলাকার সবাই বন-রক্ষক বলেই জানে। বনবিবির অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় “বনবিবির কেরামতি” এবং “বনবিবির জহুরানামা” নামের দু’টো পুরানো গ্রন্থে। বনবিবির প্রতি অগাধ ভক্তিই সুন্দরবনের আশেপাশের জনপদের প্রান্তিক মানুষগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখে লোভ লালসা থেকে। তারা মেনে চলে বনের প্রাকৃতিক সব নিয়ম-নীতি। বিরত থাকে বনকে ধ্বংস করা থেকে। ইন্টারেষ্টিং, তাই না?

সুন্দরবনের আশেপাশের জনপদের মানুষগুলো অত্যন্ত দরিদ্র। এরা এখানে বাস করে আসছে যুগের পর যুগ। এদের জীবিকা আসে মূলত সাগর এবং সাগর-সংলগ্ন বন থেকে। বনবিবির উপর আস্থা রেখে বনের অলিখিত প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে এই প্রান্তিক মানুষগুলো। তাই বনে প্রবেশের সময় তাদের সাথে থাকে না কোন আগ্নেয়াস্ত্র। বনে তাদের প্রবেশ হয় কেবলমাত্র জীবিকার প্রয়োজনে- সেটা হতে পারে মধু, কাঁকড়া, মাছ আরোহনের জন্য, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।

ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন

সুন্দরবন শাসিত হয় ভয়ঙ্কর প্রাণীর নিজস্ব নীতিতে, প্রকৃতির নির্দিষ্ট নিয়মে; সেখানে চলে না মানুষের প্রণীত কোন আইন। বনের জীব-পরিক্রমা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রকৃতির খেয়ালে। এখানকার অধিবাসীরা তাই নিজেদের ভাগ্য শপে দিয়েছে প্রকৃতির কাছেই। জীবিকার জন্য বাঘ-কুমিরের মতো হিংস্র জন্তুর সাথে লড়াই করার সাহস নিয়ে এসব দরিদ্র্য মানুষকে যেতে হয় ম্যানগ্রোভের গভীর অরণ্যে। তাদের বিশ্বাস, অরণ্যে সব রকমের বিপদ থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে পারে বনবিবিই। এই মানুষগুলো স্থানীয় শ্রুতি এবং উপকথা বিশ্বাস করে মনে-প্রাণে। এই বিশ্বাস তাদের মনে যোগান দেয় শক্তি। লোক-শ্রুতির বর্ণনায়, চোরাশিকারী-জলদস্যু বা যারাই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক নিয়ম অমান্য করবে, তাদের মৃত্যু হবে বনের বাঘের হাতে।

আজকের সুন্দরবনে এসব বিশ্বাস ক্রমেই হয়ে যাচ্ছে ফিকে, ম্লান হয়ে পড়ছে জনশ্রুতির শক্তি। বর্তমানে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সুন্দরবনের সব অলিখিত প্রাকৃতিক নিয়ম। বোঝাই যাচ্ছে, বনবিবি আর বোধহয় তার সুন্দরবনকে রক্ষা করতে পারছে না। সম্ভবত বৃদ্ধ হয়ে  গিয়েছে সে। বনদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সুন্দরবন! উধাও হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষরাজি, গড়ে উঠছে চোখ ধাঁধানো রিসোর্ট, কোনঠাসা হয়ে পড়ছে বনের প্রাণীরা। সুন্দরবনের সম্পদ লুন্ঠন করা এবং এ’র সুশান স্বর্গীয় নীরবতাকে বিঘ্ন করার ইতিহাস শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এই ইতিহাস জানতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে ইতিহাসের আরো গভীরে।

সুন্দরবনের বন্য জীবন

সুন্দরবনের উপর বিরামহীন অনাচারের ইতিহাস জানার আগে এ’র পুরো পরিচয় জানা দরকার। শাব্দিক অর্থে, “সুন্দরবন” নামটি শুনলে আমাদের মনে আসে “সুন্দর জঙ্গল” বা “সুন্দর বনভূমি”। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে যে অখণ্ড বনভূমি বিশ্বের সর্ববৃহৎ হিসেবে পরিচিত, তা’ হলো এই সুন্দরবন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তৃত এই দ্বীপ অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে অরক্ষিত ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে একটি। গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকার ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থিত প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষণায় সুন্দরবন বিশ্বে ঐতিহ্যবাহী একটি স্থান হিসেবে স্বীকৃত। কেন এর নাম সুন্দরবন হলো,  এ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক । কারো কারো মতে, এখানে সুন্দরী গাছ বেশী জন্মায় বলে এ’র নাম দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন। আবার অনেকের ধারণা, বহু আগে এই বনের নাম ছিল ‘সমুদ্রবন’ যা’ কালের আবর্তে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে ‘সুন্দরবন’। আবার অনেকে বলে, স্থানীয় আদিবাসীরা বনটিকে ডাকতো ‘চন্দ্র-বান্ধে’ নামে, আর সেই নামটিই হয়ে গিয়েছে ‘সুন্দরবন’।

সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, সুন্দরবনের বর্তমান আয়তনের (দশ হাজার বর্গ কিঃ মিঃ) ষাট ভাগ রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকীটা ভারতে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেও সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ। বনের উপর মানুষের সৃষ্ট অন্যায় চাপ  ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করে ফেলেছে। তথ্যমতে, সুন্দরবন অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৪৫ লক্ষ অধিবাসী। একটি বনের জন্য জনসংখ্যাটি অস্বাভাবিকভাবে বেশী। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কেন এবং কিভাবে এতো মানুষ এরকম একটি দুর্ভেদ্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করলো? এর উত্তর পেতে হলে, আমাদের চলে যেতে হবে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনমলে, এমনকি তারও আগে।

এই বনের দিকে প্রথম নজর পড়েছিল মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়েই। তার রাজত্বকালে বাংলায় কৃষি সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল দ্রুত গতিতে। আর তখন থেকেই এর চারপাশ জুড়ে গড়ে উঠতে থাকে জনবসতি। জীবনধারণের জন্য অনেকেই চলে আসে এ দুর্গম এলাকার আশেপাশে বসতি স্থাপনের জন্য। জীবনযুদ্ধে তারা কতটুকু জয়ী হয়েছিল তা’ জানা না গেলেও, এটুকু বলা যায় যে, হেরেছে সুন্দরবন। মোগল রাজত্বকালেও এই সুন্দরবন ছিল অভেদ্য। তাই মোগলরা সুন্দরবনের তেমন একটা ক্ষতি করতে পারে নি। বরং তারা এ’র আশেপাশে বিকশিত করেছিলো তাঁত শিল্প। এর সাথে সাথে শুরু হলো তাঁতিদের বসবাস। সে সময় বাংলার তাঁত শিল্প ছিল খুবই উন্নত। মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্রের ছিল বিশ্বজুড়ে খ্যাতি। এমনকি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে শুধু দেশেই নয়, বহিঃবাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল এই বাংলার তাঁত। প্রাচীন কাল থেকেই রোম ও গ্রীসের সাথে বাংলার ছিল নৌবাণিজ্য। বাংলার তাঁতের কাপড়ের সুখ্যাতির জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন-

“বাংলার মসলিন বাগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন”।

কিন্তু বাংলায় তাঁতের সেই স্বর্ণযুগ স্থায়ী হলো না বেশী দিন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে অসম কর ব্যবস্থা, তাঁতের ওপর আরোপিত নানা অযৌক্তিক বিধি-নিষেধ এবং ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের তাঁত শিল্প হয় ধ্বংস। ইংরেজরা পরিকল্পনা করেই ত্বরান্বিত করেছে এই ধ্বংসকে।

তাঁত ছাড়াও সে সময় সুন্দরবনের আশেপাশে বাংলার লবন উৎপাদন ছিল একটি অন্যতম শিল্প। বাংলায় এতো পরিমানে লবণ উৎপাদিত হতো যে, দেশীয় চাহিদা পুরণের পর তা’ রপ্তানী করে সমগ্র বিশ্বের লবণের চাহিদা পূরণ হতো। কিন্তু আবারও ব্রিটিশদের অতিরিক্ত কর এবং অন্য দেশের সস্তা লবণ ভারতের বাজারে প্রবেশের ফলে এই লবণ শিল্পেরও হয় ধ্বংস। এভাবে ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনের আশেপাশের বাংলার ছোট ছোট শিল্পগুলোকে ধ্বংস করে এলাকার মানুষগুলোকে করে ফেলে কর্মহীন। যে কারণে জীবিকার তাগিদে ঐ মানুষগুলো কৃষিকে অবলম্বন করতে আরম্ভ করে। ব্রিটিশদের নীল নকশার পরের ধাপ ছিল, ভূমিহীন মানুষগুলোর জন্য কৃষিকাজের জন্য জমি অধিকৃত করা। এ’রই ফলশ্রুতিতে তখন তারা সুন্দরবনকে বৃক্ষশূন্য করে চাষযোগ্য জমিতে রুপান্তরিত করে। কুটিরশিল্প ভিত্তিক এলাকাটিকে রূপান্তর করা হয় কৃষিপ্রধান অঞ্চলে। বাংলার এক সময়ের শিল্পের দক্ষ কারিগররা হয়ে যায় ভূমিহীন কৃষি মুজুর।

ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের বাংলো

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজের অবস্থান শক্তিশালী করতে বিভিন্ন রাজ্যের সাথে তাদের করতে হতো প্রায়ই যুদ্ধ। এর জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থের। অর্থ যোগানের জন্য তাদের দৃষ্টি তখন পড়ে সুন্দরবনের উপর। সুন্দরবন অঞ্চলকে চাষযোগ্য জমিতে রুপান্তরিত করে রাজস্ব আয় বাড়ানো হয়। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস রাজস্ব আয় আরো বৃদ্ধির জন্য বাংলা ও বিহারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার প্রবর্তন করেন। এই প্রথার মাধ্যমে ব্রিটিশ-অনুগত এক জমিদার-গোষ্ঠী তৈরি করা সহজ হয় তাদের। জমিদার-গোষ্ঠীর সমৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষকদের সমৃদ্ধি হয়নি একেবারেই। জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও নানা ধরনের চাঁদার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে কেড়ে নেয় চাষীর উদ্বৃত্ত আয়। এক পর্যায়ে চাষীরা জমিদারের খাজনা পরিশোধ করতে না পেরে হয়ে পড়ে ভূমিহীন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমি হারিয়ে অনেকে হয় নিঃস্ব। ১৭৭৩ সালে যশোরের ম্যাজিস্ট্রেট টিলম্যান হ্যাংকেল সুন্দরবনের একটি বৃহৎ অংশ বৃক্ষশূন্য করার এক নতুন পথ খুঁজে বের করলেন। প্রথম তিন বছর কোন রকম রাজস্ব ছাড়া, পরবর্তী তিন বছর ৫০% রাজস্ব, এবং সপ্তম বছর থেকে পুরো রাজস্ব প্রদান করার শর্তে সাধারণ মানুষকে চাষাবাদ করার অনুমতি দেওয়া হলো। এভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবনকে মোটা রাজস্বের উৎস হিসেবে গড়ে তুলেছিলো। একের পর এক নতুন কূট-কৌশল এবং আইন প্রণয়ন করে ইংরেজরা অতি উৎসাহের সাথে বন উজাড় করে সুন্দরবনের করলো প্রচুর ক্ষতি।

শেষ তো এখানেই নয়। ১৮৩০ সালের দিকে সুন্দরবন কমিশনার উইলিয়াম ড্যাম্পিয়ের বর্ণনায়, মেঘনা নদীর মোহনার বাকেরগঞ্জ এলাকায় প্রায় ৮৫ হাজার একর সুন্দরবনের গাছপালা কেটে ফেললে, এই বিশাল এলাকা হয়ে পড়লো বৃক্ষহীন। বনাঞ্চল ছাড়াও যে সব অঞ্চলে আগে  লবণের চাষ ও তাঁতের কাজ হতো, ব্রিটিশদের ভ্রান্ত নীতিতে সেগুলোও ব্যবহার হওয়া শুরু হলো কৃষি কাজে। তাঁত ও লবন শিল্প ধ্বংস হবার কারণেই এলাকার বিপুল পরিমানের অধিবাসী বাধ্য হয়ে মেঘনার মোহনায় শুরু করে বসতি স্থাপন। এভাবেই শুরু হয় সুন্দরবনের বৃক্ষ নিধন এবং মানুষের ক্রমাগত আবাসন নির্মাণ।

গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহাউসির আমলে কলকাতা বন্দরে হুগলি ও ভাগীরথী নদীর পলি জমার কারনে নব্যতা হ্রাস পায়। ফলে বড় জাহাজ এই বন্দরে আসা-যাওয়া করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। শুরু হয়, কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা। ব্যবসা বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বিকল্প হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের গভর্নর জেনারেল চার্লস ক্যানিং (Charles Canning) মাতলা নদীর সাথে সুন্দরবন অঞ্চলে একটি বন্দর গড়ে তোলে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিলীন করা হয় সুন্দরবনের অগণিত বৃক্ষ। কোন রকম বাধা বিপত্তি ছাড়াই ৮,৬৫০ একর বন উজাড় করে লর্ড ক্যানিং-এর নাম অনুসারে ক্যানিং বন্দর নির্মাণ করা হয়।

ভাটার সময় মাতলা নদী

ব্রিটিশদের সুন্দরবন ধ্বংস করে বন্দর নির্মাণের সময় তৎকালীন শীর্ষ ঘূর্ণিঝড় বিশেষজ্ঞ হেনরী পিডিংটন এই বন্দর নির্মাণের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। পিডিংটন ছিলেন ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন শব্দটির জনক। তিনি তখন একটি চিঠিতে ইংরেজদের জানান যে, প্রতিবছর সুন্দরবনে সাইক্লোন চারপাশের এলাকাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি মাতলা নদীর উপর কোন বন্দর নির্মাণ না করার পরামর্শ দেন গভর্নর-জেনারেল ক্যানিংকে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, সুন্দরবনে একদিকে যেমন ভীষন লোনা পানি, অন্যদিকে তেমনি ভয়ংকর ঝড়।

এখানে বন্দর নির্মাণ কোন ভাবেই উচিৎ হবে না। ইংরেজরা তখন তার পরামর্শে কর্ণপাত করে নি। এর কয়েক বছর পরই হেনরী পিডিংটনের আশঙ্কা ফলে গিয়েছিল বাস্তবে। ১৮৬৭ সালের ১ নভেস্বর আসে এক ভয়ঙ্কর হারিকেন-জলোচ্ছাস, যা সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সাগরের পানি উঠেছিল ১৫ ফুট  উঁচুতে। ভেঙ্গে গিয়েছিল বন্দর, ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সবকিছু । অপচয় হয় অর্থের। এরপর তারা আর সুন্দরবনে বন্দর নির্মাণের কোন আগ্রহ দেখায় নি।

এত বড় বিপর্যয়ের পরেও ইংরেজদের বন উজাড় করার কাজ কিন্তু থেমে থাকেনি। এত কিছুর পরেও ১৯১০ সালে নয় হাজার একর বন উজাড় করে একজন স্কটিশ ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠা করে জামিন্দারি এবং গোসাবা সমবায়। বাংলায় দূর্ভিক্ষের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার হাজার হাজার অসহায় মানুষ চলে আশে সুন্দরবন অঞ্চলে, বসতি স্থাপন করে সেখানে। এভাবে বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে মানুষ সুন্দরবনমুখী হয়েছে সময় সময়, ক্রমাগত বেড়েছে সুন্দরবনে মানব বসতি।

হেনরি পিডিংটন

বিভিন্ন প্রাচীন ইতিহাসে সুন্দরবনের উল্লেখ আছে নানাভাবে। যেমন, বিশিষ্ট চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে অবস্থান করার সময় সুন্দরবনকে তিনি বর্ণনা করেন এভাবে, “সাগর সীমানায় নান্দনিক ফসলি নিম্নভূমি”। সুন্দরবনের কিছু এলাকায় প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো বসতির সন্ধান মিলেছে। বনের নলিয়ান রেঞ্জের আদাচাই নামের বনখণ্ডে ইট, সুরকি এবং চুন দিয়ে বানানো অনেক পুরোনো বসতির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে এখনো। সুন্দরবনে হয়তো এমন আরো অনেক অনাবৃত মূল্যবান ইতিহাস রয়েছে, যা’ খুঁজে বের করার কাজটি জরুরী।

সুন্দরবনে খুঁজে পাওয়া বসত বাড়ির জিনিসপত্র

ব্রিটিশরা তো চলে গিয়েছে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগেই। এখন তো আমরা স্বাধীন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আমাদের বন্ধু সুন্দরবনকে রক্ষা করার বড় রকমের কোন পদক্ষেপ আজও নেই নি, বরং করছি উল্টোটি। মানুষের বসতি বাড়ছে দিন দিন, ট্যুরিস্ট রিসোর্টের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। আইলা, বুলবুল এবং আম্ফানের ধ্বংস থেকে রক্ষাকারী সুন্দরবনকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এর সাথে জড়িত রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষার প্রতিরোধ। ইতিহাস থেকে আমাদের এখনো নেয়া হয় নি শিক্ষা। যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারে না,  তাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরো বড় বিপর্যয়।

পুরোনো বসতির ধ্বংসাবশেষ

সুন্দরবনের সম্পদ লুট করতে করতে ছোট করে ফেলছি আমরা এর আয়তন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বনের প্রতিরোধ ক্ষমতা হয়ে যাচ্ছে দূর্বল। ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসা বনে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে প্রাণীকুল। ভেঙে পড়ছে এ’র শত শত বছরে গড়ে উঠা ইকোসিস্টেম। আমাদের অত্যাচার থেকে লোক-শ্রুতির বনবিবিও মনে হচ্ছে রক্ষা করতে পারছে না আর সুন্দরবনকে। লোভের বশে ধ্বংস করে দিচ্ছি আমাদের প্রাকৃতিক শ্বাসনালী সুন্দরবনকে।

এই লেখাটি যৌথ ভাবে লিখেছেনঃ

Riffat Ahmed

Riffat Ahmed

Dr. Khaled Khan

Dr. Khaled Khan