অনিন্দ্য সুন্দর এই প্রকাণ্ড মার্বেল পাথরের তৈরি মাথাটির নাম জুনো বা হেরা লুডোভিসি (Juno Ludovisi)। এটি কার্ডিনাল লুডোভিসির সংগ্রহশালার একটি অংশ। একসময় মনে করা হতো এই মার্বেল পাথরের মাথাটি রোমান দেবী জুনোর। জুনোর ছিলেন রাষ্ট্রের রক্ষক ও বিশেষ উপদেষ্টা। আবার আরেকটি মত অনুসারে এই মাথাটি গ্রিক দেবী হেরার। এটি মার্বেল, হাতির দাঁত, সোনা দিয়ে একটি বিশাল অ্যাক্রোলিথিক মূর্তির একমাত্র অবশিষ্ট অংশ। এটি ১৫০০-এর দিকে আবিষ্কৃত হয়েছিল।
যাহোক, নানা বিতর্কের মাধ্যমে বের হয়ে আসে এটি কোনো দেবীর মূর্তি নয়। এই মূর্তিটি আসলে অ্যান্টোনিয়া মাইনরের প্রতিকৃতি। তিনি ছিলেন মার্ক অ্যান্টনি এবং তার চতুর্থ স্ত্রী অক্টাভিয়া মাইনরের মেয়ে। অক্টাভিয়া মাইনরকে বিয়ে করার পেছনে মার্ক অ্যান্টনির একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর নিজেকে আরো শক্তিশালী করার জন্য অক্টাভিয়া মাইনরের ভাই অক্টাভিয়ানের সাথে জোট গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। এই অক্টাভিয়ানই পরবর্তীতে অগাস্টাস নামে প্রথম রোমান সম্রাট হবার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
তবে জোটটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি – কারণ মার্ক অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ক্লিওপেট্রার গর্ভে তিন সন্তান হয়েছিল। তার নয় বছর পরে অক্টাভিয়ান ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং মার্ক অ্যান্টনিকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করতে সিনেটকে রাজি করিয়ে ফেলেন।
এর ফলে একটি গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হলো। এই যুদ্ধে মার্ক অ্যান্টনি একটি ভয়াবহ নৌযুদ্ধে পরাজিত হন। ক্লিওপেট্রা সেসময় একটি সমাধিতে লুকিয়ে ছিলেন এবং মার্ক অ্যান্টনিকে এই বলে বার্তা পাঠান যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এই সংবাদ শুনে মার্ক হতাশ হয়ে নিজের পেটে ছুরিকাঘাত করেন। তার অনুচররা তাকে ক্লিওপেট্রার কাছে নিয়ে আসে এবং মার্ক তার প্রিয়তমার কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিঃস্ব ক্লিওপেট্রা নিজেকে এবং তার ধন-সম্পদ পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। মার্কের মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ঘটে। রোমানদের বিজয়ী প্যারেডে অংশ নেয়ার ভয়ে ক্লিওপেট্রা একটি বিষাক্ত সাপের সাহায্যে আত্মহত্যা করেন। ক্লিওপেট্রাকে রাজকীয় সমাধিতে মার্ক এন্টনির পাশে সমাহিত করা হয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো তার এই সমাধি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অ্যান্টোনিয়া মাইনরের সাথে মার্ক অ্যান্টনির কখনোই দেখা হয়নি। এন্টোনিয়া বেড়ে উঠেছিলেন একটি ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে। তার বাবার এই আত্মহত্যা বা অন্য নারীর সাথে প্রেম ইত্যাদি এন্টোনিয়ার ব্যক্তিত্বের প্রতাপের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং তিনি হয়ে উঠেন জুলিও-ক্লডিয়ান রাজবংশের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে। এই রাজবংশই প্রতিষ্ঠা করে ঐতিহাসিক রোমান সাম্রাজ্য এবং এই রাজবংশের পাঁচটি প্রজন্ম রোমান সাম্রাজ্য শাসন করে।
অ্যান্টোনিয়া মাইনর ছিলেন প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাসের ভাগ্নি; দ্বিতীয় সম্রাট টাইবেরিয়াসের ভাইয়ের স্ত্রী ও জার্মানিকাসের মা। এই জার্মানিকাসকে এক পর্যায়ে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। জার্মানিকাসের ছেলে ক্যালিগুলা আবার সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। অ্যান্টোনিয়া মাইনর ছিলেন চতুর্থ সম্রাট ক্লডিয়াসেরও মা। পঞ্চম সম্রাট নিরোকে দত্তক নিয়েছিলেন তিনি। তার লিভিলা নামে একটি কন্যাও ছিল যাকে তিনি টাইবেরিয়াসের এক ছেলেকে বিষ প্রয়োগের অপরাধে অনাহারে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিলেন।
অ্যান্টোনিয়া মাইনর এক পর্যায়ে তার বাবার মার্ক অ্যান্টনির মতোই আত্মহত্যা করেছিলেন। এ সময়টায় তার নাতি ক্যালিগুলার বিশৃঙ্খলা এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যাকাণ্ড তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তার এই আত্মহত্যায় ক্যালিগুলাকে খুব একটা বিচলিত মনে হয়নি। বরং সে তার ভোজনকক্ষে আরামে বসে অ্যান্টোনিয়ার শরীরকে চিতায় পুড়তে দেখেছিল। এর চার বছর পরে ক্যালিগুলা মারা যান। এরপর যখন অ্যান্টোনিয়ার তৃতীয় পুত্র ক্লডিয়াস সম্রাট হন, তখন তিনি তার নাম পালটিয়ে নিজেকে অগাস্টা হিসেবে পরিচয় দেয়া শুরু করেন । তার জন্মদিন একটি সর্বজনীন ছুটিতে পরিণত হয়। এদিন বাৎসরিক খেলার আয়োজন করা হতো । পাশাপাশি আয়োজন থাকতো নরবলি প্রথারও। পুরো সাম্রাজ্যে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস ধারণ করার আগ পর্যন্ত এমন প্রথা চলতে থাকে।