আকবরের স্ত্রীর বাণিজ্য জাহাজ এবং পর্তুগিজদের ভাগ্য ১৬১৩-১৪য় ইওরোপিয়রা জাহাঙ্গিরের মা, আকবরের স্ত্রী মারিয়ুজ্জামানির নাম দিয়েছিল ‘আ গ্রেট এডভেঞ্চারার’। মুঘল রাজধানীর জেনানা মহলে বসেই মারিয়ুজ্জামানি এশিয়া এবং আফ্রিকায় ব্যবসা করতেন। বাহন ছিল জাহাজ ‘রহিমি’। জাহাঙ্গিরের সময় পর্তুগিজ ছাড়া দুটি সনদী কোম্পানি, ব্রিটিশ, ডাচেরা বিশ্বের কারখানা দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবসা জমাতে তীব্র উৎসাহী, সে সময় ৫২ মিটার দীর্ঘ এবং ১৫ মিটার চওড়া ১৭০০ টন মাল বহনক্ষম রহিমি প্রত্যেক ব্যবসায়ীরই তীব্র ঈর্ষা উদ্রেক করে জল কেটে ভারত মহাসাগর এবং লোহিত সাগর জুড়ে ব্যবসা করত। ১৬১৩য় ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী হেনরি মিডলটনের সহকারীর বর্ণনায় পাচ্ছি মাঝসমুদ্রে বহু দূর থেকেই ৪৩-৪৪ গজের মাস্তুল উড়িয়ে সমুদ্রে বিহার করা রহিমিকে এক নজরেই চেনা যেত। রহিমির প্রধান কাজ ছিল সুরাট থেকে তীর্থযাত্রীদের হজ্বে নিয়ে যাওয়া। প্রতিবারে খুব কম করে ১৫০০ যাত্রী নিয়ে যেত সে। রহিমির নোঙর বন্দর ছিল সুরাট। রহিমি লোহিত সাগরে, মক্কার বন্দর জেড্ডা এবং অন্যান্য বন্দরে তীর্থযাত্রী এবং দক্ষিণ এশিয় পণ্য পরিবহন করত। পর্তুগিজদের সমুদ্রের ছাড়পত্র কার্তেজ দেওয়া নিয়ে বহুকাল ধরেই মারিয়ুজ্জামানির সঙ্গে এবং স্বাভাবিকভাবে মুঘলদের সঙ্গে পর্তুগিজদের তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল। তার সঙ্গে জুড়েছিল মগেদের সঙ্গে মিলে চট্টগ্রাম বন্দর দখল করে উপকূল এবং সুন্দরবন এলাকা জুড়ে পর্তুগিজদের জলদস্যুতা, দাস ব্যবসা এবং বিভিন্ন মুঘল বিরোধী জমিদারদের সঙ্গে বাগী পর্তুগিজ বম্বেটেদের হাত মেলানো। ব্রিটিশ ব্যবসায়ী এবং ব্রিটিশ কোম্পানির আমলা উইলিয়াম ফিঞ্চ বলছেন, একবার মোকা বন্দরে বিপুল অর্থ দাবি করে রহিমিকে পর্তুগিজেরা আটকে রেখেছিল। সেই ঝামেলাটা মেটানো হয় খুবই কম অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু ঝামেলাটা থেকে যাচ্ছিল। মিডলটনের সহকারী লিখছেন, The ground that I had to work by was the sum formerly agreed on by general consent and that in the forenoon agreed on for the Remee . . . and according to that rate by my nearest esteem to myself set down rates on other ships . . . [not] out of proportion to the Remee sum. রহিমি যেহেতু রাজমাতার জাহাজ এবং এশিয়া জোড়া ব্যবসায়ী এবং কোম্পানিগুলো জানত জাহাঙ্গির মারিয়ুজ্জামানিকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন, তাই সেই জাহাজকে খুব বেশি কেউ ঘাঁটাত না। জেনানায় বসে পর্দার আড়ালে থেকে ব্যবসা প্রশাসক হিসেবে ইতিহাসে খুব বেশি ঠাঁই না পাওয়া মারিয়ুজ্জামানি ব্যবসা জগতের অসামান্য শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। মারিয়ুজ্জামানির রহিমি কী ধরণের পণ্য বহন করত? ব্রিটিশেরা ইঙ্গিত দিচ্ছে নীল। আমাদের মনে হয় ১৫০০ টনের মারিয়ুজ্জামানি আরব এবং পারস্য বাজারে ভারত থেকে যাওয়া প্রায় অধিকাংশ পণ্যই বহন করত। পর্তুগিজদের সঙ্গে বাংলায় মুঘলদের যত দ্বন্দ্ব তীব্র হতে থাকে, ব্রিটিশেরা মুঘল দরবারে যতটা জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে, ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজেরা ততবেশি যুদ্ধংদেহী মূর্তি ধারণ করে। ততদিনে দক্ষিণ এশিয়ায় পর্তুগিজদের আসার ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। এস্তাও দা ইন্ডিয়া আর সাধারণ পণ্য বাণিজ্য করে না, তার মূল রোজগার জলদস্যুতা, কার্তেজ এবং দাস ব্যবসা। ফলে মুঘল ইংরেজ সম্পর্ক আর বাংলায় মুঘল পর্তুগিজ দ্বন্দ্বের প্রভাব কিছুটা হলেও রহিমির ওপরে পড়েছিল। সে সময়ে ব্রিটিশ কোম্পানি আমলা নিকোলাস উইদিংটনের স্মৃতিকথায় পাচ্ছি The shippe, which arrived at the barre of Suratt the 13th of September, 1613 . . . was taken by the Portungales armado of friggotts, notwithstandinge theire passe which they had of the Portungales. This shoppe was verye richlye laden, beeinge worth a hundred thowsand pounde; yet not contented with the shippe and goods, but tooke allsoe 700 persons of all sorts with them to Goa. উইদিংটন বলছেন জাহাজটিতে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র ছিল এবং সে, তৎকালীন কোনও আন্তর্জাতিক আইনই লঙ্ঘন করে নি। নুর জাহানের জীবনীকার এলিসন ফিন্ডলি বলছেন, ইংরেজদের আগ্রাসী দরবারি চালে, মুঘল দরবারে পর্তুগিজেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় পর্তুগিজেরা রহিমি এবং অন্যান্য ১২৯টি জাহাজ গোয়ায় টেনে নিয়ে ধ্বংস করে দেয়। সে সময় জাহাজে বিপুল পণ্য ছাড়াও ৭০০ যাত্রী ছিল। জাহাঙ্গির ভারতে পর্তুগিজদের সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। রাজমাতার জাহাজ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সব ধরণের মুঘল সুবিধে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অসুস্থ মায়ের অপমানে তিনি সুরাটে মুঘল সুবাদার মুকারব খানকে নির্দেশ দেন দমন থেকে পর্তুগিজদের ঘাঁটি উচ্ছেদ করতে। আগরায় আকবরের সময় থেকে জেসুঈট চার্চ যে মুঘল আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেত সেটাও বন্ধ করা হয়। কোম্পানির দুই আমলা টমাস এল্ডওয়ার্থি এবং উইলিয়াম বিশালফ, ১৬১৪র ১৯ আগস্ট কোম্পানিকে লেখা এক ডেসপ্যাচে জানাচ্ছেন, The king caused a city of the Portingals called Damaen (Damaun) to be besieged, and hath likewise taken order for the seizing of all Portingals and their goods within his kingdoms. He hath likewise sealed up their church doors and hath given order that they shall no more use the exercise of their religion in these parts, and beyond all this he hath caused Xavier the great Jesuit, whom before he loved, to be sent down hither unto Mocrob Chan, who now layeth siege unto Damaen, to do with him as he shall see good. রহিমি দখল করার পর পর্তুগিজেরা বুঝতে পেরেছিল তারা কী ভয়ানক কাণ্ডই না ঘটিয়ে ফেলেছে। পর্তুগিজেরা চেষ্টা করেছিল শেষ পর্যন্ত দরকষাকষি চালানোর। তাদের দাবি ছিল ব্রিটিশদের দেওয়া সমস্ত সুযোগ তুলে নিলে তারা জাহাজ ফেরত দেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিতে লেখা হচ্ছে the Great Mogul’s mother was a great adventurer, which caused the Great Mogul to drive the Portingals out of this place। ১৬১৪র ১৬ ডিসেম্বরে সুরাটের কোম্পানির আমলা টমাস এলকিংটন লিখছেন গোয়াতে পর্তুগিজেরা ১২০টা জাহাজ পুড়িয়ে দিয়েছে। বিশালাকায়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রহিমি। তারা রাজমাতার জাহাজটিকে জেনেশুনেই পুড়িয়েছে। এর পরেও তারা চেষ্টা করেছিল নতুন করে দরকষাকষি করে আরও কিছু কার্তেজের সুবিধে দিয়ে দোষ স্খালন করার। কিন্তু জাহাঙ্গির রাজি হন নি। শেষ পর্যন্ত পর্তুগিজেরা ৩ লক্ষ টাকা দিয়ে কিছুটা মুঘল রোষ থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেওয়া বিষয়টি জাহাঙ্গির ঝুলিয়ে রাখলেন, কারন ততদিনে তিনি ব্রিটিশদের সমুদ্র শাসন ক্ষমতা জেনে গিয়েছেন। রহিমি ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ায় পর্তুগিজ উচ্ছেদ এবং ব্রিটিশ, ডাচ উত্থান নিশ্চিত হল।