তেরো শতক থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতবর্ষে উত্থান ঘটেছিল এক কুখ্যাত ঘাতক সম্প্রদায়ের। নাম তাদের ঠগী। দস্যুবৃত্তি করে জাবিকা নির্বাহ করা এই খুনির দল শতাব্দী থেকে শতাব্দী পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। অভিনব কায়দায় মানুষ হত্যা করে জলে আর স্থলে সাক্ষাত যম হয়ে উঠেছিল মধ্যযুগের আযরাইল বাহিনী। ১৩ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত এদের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে। ১৭৪০ থেকে ১৮৪০ শুধুমাত্র এই একশো বছরেই ঠগীদের হাতে উপমহাদেশের ১০ লক্ষ মানুষ খুনের স্বীকার হয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজ সরকার এদের পুরোপুরি নির্মূল করে। ঠগীদের নিয়ে নানান কাহিনি আজো ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিংবদন্তির মত ছড়িয়ে আছে।

ঠগ একটি সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ প্রতারক, প্রবঞ্চক। এই সংস্কৃত ঠগ থেকে এসেছে ঠগী। ইংরেজি শব্দ Thug এসেছে এই ঠগী শব্দ থেকে।
১৮৩৯ সালে ফিলিপ মেডোউস টেলরের উপন্যাস কনফেসনস অফ অ্য থাগ এর মাধ্যমে ঠগিদের কাহিনী জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই খুনি সম্প্রদায়কে ঠগী বলা হত কারণ এরা পথিকের সাথে ছদ্মবেশে খাতির জমিয়ে অকস্মাৎ হামলা করে তার সর্বস্ব আত্মসাৎ করে তাকে হত্যা করে দিত। ১২৫৬ সালের ঠিক আগে এই ঘাতক দলের উত্থান হয়। ঠগীরা ছিল হিন্দু দেবী কালীর অনুসারী৷  এজন্য তারা রক্তপাতে বিশ্বাসী ছিল না। তবে অনেক মুসলিম ও শিখ সম্প্রাদায়ের লোকও ঠগীদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করাই ছিল তাদের নীতি। ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানীর মাধ্যমে ঠগীদের সম্পর্কে সর্বপ্রথম জানা যায়। তার লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়,

“১২৯০ এর দিকে সুলতানের শাসন আমলে কিছু ঠগ ধরা পড়ে। কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা এক হাজার। তাদের নতুন দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা করেন নি বরং তাদেরকে নৌকায় করে ভাটির দেশে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন যাতে তারা আর কোনদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।”

ঠগীদের ধরেও সুলতান কি কারণে তাদের হত্যা না করে বাংলার দিকে ছেড়ে দিলেন তা স্পষ্ট নয়। আর এই সুযোগে ঠগীরা বাংলার দিকে তাদের অবস্থান সংহত করে। ঘুম হারাম হয় বাংলার নিরপরাধ পথিকদের।

ঠগীরা খুন করে কূয়তে লাস ফেলেদিচ্ছে

একটি কূপে মৃতদেহ ফেলে দেওয়ার আগে খুন যাত্রীদের চোখে ছুরিকাঘাত করছে

ঠগীদের হত্যা পদ্ধতি

ঠগীরা সাধারণত দলবেঁধে ছদ্মবেশে চলাচল করত। কখনো ব্যবসায়ী হিসেবে, কখনো তীর্থযাত্রী কিংবা কখনো সৈন্যের বেশ ধরে রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকত। ঠগীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিত। একটা দল পথিক বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করত। তার কাছে কেমন টাকাপয়সা আছে, মূল্যবান কোন জিনিসপত্র আছে কিনা তার খবর গ্রহণ করত এই দল। আরেকটি দল পথিকের সাথে ছদ্মবেশে ভাল মানুষের মত মন ভুলানো আচরণ করে তাদের সাথে মিশে যেত। পেছন দিকে আরেকটি দল গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করত। আরেকটি দল পুলিশের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করত। হত্যা করার জন্য ঠগী সর্দার তাদের নিজেদের কিছু সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে পথিকের উপর হামলে পড়ত। ‘বাসন মেজে আনো’ এই কথার মানে ছিল কবর তৈরি করা, ঝিরনি কথার অর্থ ছিল হত্যার প্রস্তুতি নেওয়া আর ‘ তামাকু লাও’ এর মাধ্যমে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হতো। ঠগীরা পথিককে হত্যা করতে এক বিশেষ রুমাল ব্যবহার করত। হলুদ রঙ এর রুমাল দিয়ে একজন গলায় পেঁচিয়ে ধরত, আরেকজন পা ধরে রাখত এবং অন্যজন মাথা ধরে রাখত। আর এভাবেই মানুষ হত্যা করে তারা সর্বস্ব লুট করে নিত। তাদের কাছে এসব হত্যা ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়৷ ঠগীরা বংশ পরম্পরায় দস্যুবৃত্তি করত। একজন শিশুকে তারা বাল্যকাল থেকেই মানুষ হত্যার প্রশিক্ষণ দিতো। ১০ বছর বয়স হলেই ঠগী শিশুরা খুন প্রত্যক্ষ করত এবং ১৮ বছর বয়সে নিজেরা পুরোদস্তুর ঘাতক হয়ে যেত। ঠগী সদস্যরা নিজেদের কাজ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। শিকার যে ধরে রাখবে তাকে বলা হত ‘চামোচি’। আর ‘চুমোসিয়া’র দায়িত্ব ছিল শিকারের হাত আটকে রাখা । ‘চুমিয়া’ পথিকের পায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে। আর ‍মৃতদেহ গুলিকে কবরে নেওয়ার দায়িত্ব  ছিল ‘ভোজারা’ দের।মৃতের হাটু ভেঙ্গে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাজ করে কবর দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ‘কুথাওয়া’ র। মৃতদেহের পাহারা দেওয়া  দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ‘ফুরকদেনা’ দের। আর হত্যাকান্ডের জায়গাটা পরিষ্কার করার দায়িত্ব ছিল ‘ফুরজানা’ দের। ঠগীদের উৎপাত এতই বেড়ে গিয়েছিল যে দিনেদুপুরে মানুষ একা বাইরে বের হতে ভয় পেত। একজন ঠগী মাসে ৭-৮ জন মানুষ হত্যা করত। এই হিসেবে তারা শতাব্দীব্যাপী লাখ লাখ মানুষ কে পৃথিবী থেকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়। বাহরাম জমাদার নামের এক ঠগী নেতা একাই ৯৩১ জনকে হত্যা করে। মজার ব্যাপার হলো ঠগীরা সাধারণত ভিক্ষুক, সংগীতশিল্পী নৃত্যশিল্পী,  তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা করত না।

ঠগীদের দমন

প্রথম প্রথম মানুষ নিখোঁজ হলে ভারতের ব্রিটিশ সরকার এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দিত। ১৮১২ সালের দিকে ইংরেজ সরকার নিশ্চিত হয় যে এসব নিখোঁজের পেছনে কোন সংঘবদ্ধ চক্রের হাত থাকতে পারে। সেসময় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বেশকিছু গণকবরের সন্ধান পায় ব্রিটিশ সরকার। তবুও তারা তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কিন্তু যখন ভারতে ঘুরতে আসা ইংরেজ পর্যটকরা ধারাবাহিকভাবে নিখোঁজ হতে থাকে তখন তারা বিষয়টা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে এবং এজন্য লর্ড বেন্টিংক উইলিয়াম হেনরী শ্লীম্যানকে দায়িত্ব দেন। শ্লীম্যান গুপ্তচরদের মাধ্যমে একে একে ঠগীদের ধরতে সক্ষম হোন এবং ফাঁসি দিতে থাকেন। আর এভাবে তার প্রচেষ্টায় ঠগীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ১৯৪০ সালের দিকে ৫০০ ঠগীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ঠগীদের উৎপাত শূন্যর কোঠায় নেমে আসে। উপমহাদেশের এই ভয়ংকর ঘাতক সম্প্রদায় এখন কাহিনি হয়ে বেঁচে আছে মানুষের মুখে মুখে, বইয়ের পাতায় কিংবা সেলুলয়েডের ফিতায়।

ঠগীরা যাকে বেশি ভয় পেত

বেঙ্গল আর্মির তরুণ অফিসার হেনরি স্লিম্যান