এখনো দিল্লির দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা। এখনো এখানে প্রচুর ভক্তের সমাবেশ হয়। নিজামুদ্দিন আউলিয়া সম্পর্কে একটি চমৎকার কাহিনী রয়েছে। দিল্লীর পাঠান সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী দিল্লির এক প্রান্তে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে একদা একজন ফকির সেই মসজিদে আশ্রয় নেন। এই ফকিরের নাম নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। ফকির কালক্রমে পরিণত হলেন মহাপুরুষে। দিকে দিকে প্রচারিত হলো তাঁর পূণ্য খ্যাতি। অনুরাগীর সংখ্যাও বেড়ে চললো-সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়লো। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন পানির। পানের জন্য স্নানের জন্য এবং ওযুর জন্য চাই পানি। তিনি স্থির করলেন পানি কষ্ট মেটাবার জন্য খনন করবেন এক জলাশয় দীঘি। শুরু করলেন খননকাজ। কিন্তু বাধা এলো দিল্লীর বাদশা গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের (১০২৩-২৫ খৃষ্টাব্দ) কাছ থেকে। তিনি স্থির করলেন তার রাজধানী দিল্লিকে বর্হিশত্রু মোঙ্গলদের হাত থেকে সুরক্ষার জন্য চতুর্দিকে প্রাচীর নির্মাণ করবেন। ইতিপূর্বে তিনি একবার মোঙ্গল দস্যুদের পরাজিত করেছেন। পুনরায় মোঙ্গলদের আক্রমণ ব্যর্থ করার জন্যই নগরকে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষা করবেন। প্রাচীর নির্মাণ কাজ শুরু হলো কিন্তু শ্রমিকের অভাবে কাজ মৃদু গতিতেই চলতে লাগল। শ্রমিকের অভাব কারণ শ্রমিকেরা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দীঘি খননে ব্যস্ত। সম্রাট ঘোষণা দিলেন দ্বিগুণ পারিশ্রমিকের কিন্তু শ্রমিকেরা সম্রাটের প্রলোভনে সাড়া দিলো না। সম্রাট জ্বলে উঠলেন ; একজন ফকিরের কি সাহস আমার সাথে প্রতিযোগিতা। ফকিরের জোর হৃদয়ের আর সম্রাটের জোর শক্তিও অর্থে। সম্রাট হুঙ্কার দিলেন দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি। সম্রাট ইতিমধ্যে নিজেকে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্রাটের এই হুঙ্কার ধ্বনি ফকিরের কানে পৌছাবার পূর্বে সম্রাটকে বাংলার বিদ্রোহ দমনে রাজধানী ছেড়ে ছুটতে হলো বাংলা মুল্লুকে। দিল্লী রক্ষণের ভার রইলো তাঁর পুত্র জুনা খাঁন অথবা উলুঘ খানের উপর। এই জুনা খাঁনই পরবর্তীকালে ভারতের ইতিহাসে মুহাম্মদ-বিন-তুঘলক (১৩২৫-৫১ খ্রিষ্টাব্দে) নামে পরিচিত। ইতিহাসে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ বলে একটি হাস্যকর উক্তি রয়েছে যার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে পাগলামী কান্ড। এই জুনা খাঁন বা মুহাম্মদ-বিন-তুঘলক ছিলেন অস্থির ও অপরিণামদর্শী চিত্তের অধিকারী কিন্তু তিনি ছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অনুরাগী।
 
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাংলার বিদ্রোহ দমন করে দিল্লির দিকে প্রত্যাবর্তন করছেন। ফকিরের অনুরাগীরা ভীত সন্ত্রস্ত। অনুরাগীরা ফকিরকে অনুরোধ করলেন এই নিষ্ঠুর সম্রাটের হাত থেকে দিল্লী থেকে পলায়ন করতে। ফকির নিজামউদ্দিন আউলিয়া বললেন, ‘দিল্লী দূর অস্ত’ ‘দিল্লি অনেক দূর’। সম্রাট তাঁর বিজয়ী সৈন্যদল নিয়ে ক্রমশই দিল্লীর দিকে এগুচ্ছেন। অনুরাগীরা ততোই ভীত। ফকিরকে অনুরোধ করলেন ‘পালান’। ফকির বললেন ,’দিল্লী দূর অস্ত’। সম্রাট আরো এগিয়ে আসছেন। অনুরাগীরা ফকির বাবাকে অনুরোধ করলেন, ‘বাবা এখনো সময় আছে পালিয়ে যান। ফকির উত্তর দিলেন একইভাবে ‘দিল্লী দূর অস্ত’। গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নগর প্রান্তে। ‘’ নগরপ্রান্তে পিতার অভ্যর্থনার জন্য মহম্মদ তৈরি করেছেন মহার্ঘ মন্ডপ, কিংখাবের শামিয়ানা-জরিতে-জহরতে ঝলমল। বাদ্যভান্ড, লোকলস্কর , আমির-ওমরাহ মিলে সমারোহের চরমতম আয়োজন। বিশাল ভোজের ব্যবস্থা। ভোজের পরে হস্তীযুথের প্রদর্শনী প্যারেড। মন্ডপের কেন্দ্রস্থলে ঈষৎ উন্নত ভূমিতে বাদশাহের আসন, তার পাশেই তাঁর উত্তরাধিকারীর। পরদিন গোধূলিবেলায় সুলতান প্রবেশ করলেন অভ্যর্থনা মণ্ডপে। প্রবল আনন্দচ্ছাসের মধ্যে আসন গ্রহণ করলেন। সিংহআসনের পাশে বসালেন নিজ প্রিয়তম পুত্রকে। কিন্তু সে মোহাম্মদ নয়, তার অনুজ। ভোজনান্তে অতি বিনয়াবনত কন্ঠে মোহাম্মদ অনুমতি প্রার্থনা করলেন সম্রাটের। ‘জাহাঁপনার হুকুম হলে এবার হাতির কুচকাওয়াজ শুরু হয়’; হস্তীযূথ নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি নিজে। গিয়াসুদ্দিন অনুমোদন করলেন স্মিতহাস্যে।
মোহাম্মদ মণ্ডপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন ধীরে শান্ত পদক্ষেপে। কড়-কড়-কড় ড়- কড়াৎ ।একটি হাতির শিরসঞ্চালনে স্থানচ্যুত হল একটি স্তম্ভ। মুহূর্তমধ্যে সশব্দে ভূপাতিত হল সমগ্র মন্ডপ।
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে অসংখ্য কাঠের থাম। চাপা পড়া মানুষের আর্ত কন্ঠে বিদীর্ণ হল অন্ধকার রাত্রির আকাশ। ধুলোয় আচ্ছন্ন হল দৃষ্টি। ভীত, সচকিত ইতস্তত ধাবমান হস্তীযুথের গুরুভার পদতলে নিস্পিষ্ট হল অগণিত হতভাগ্যের দল। এবং সেই বিভ্রান্তকারী বিশৃংখলার মধ্যে উদ্ধারকর্মীরা ব্যর্থ অনুসন্ধান করল বাদশাহের। পরদিন প্রাতে মন্ডপের ভগ্নাস্তুপ সরিয়ে আবিষ্কৃত হল বৃদ্ধ সুলতানের মৃতদেহ। যে প্রিয়তম পুত্রকে তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন মনে মনে, তার প্রাণহীন দেহের ওপর সুলতানের দুই বাহু প্রসারিত। বোধ করি আপন দেহের বর্মে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তাঁর স্নেহাসম্পদকে।
সমস্ত ঐহিক ঐশ্বর্য, প্রতাপ ও মহিমা নিয়ে সপুত্র গিয়াসউদ্দিনের শোচনীয় জীবনান্ত ঘটল নগরপ্রান্তে। দিল্লী রইল চিরকালের জন্য তাঁর জীবিত পদক্ষেপের অতীত।
দিল্লী দূর অস্ত। দিল্লী অনেক দূর। ‘’ (যাযাবরের দৃষ্টিপাত থেকে )
মুহাম্মদ বিন তুঘলক মারা যাওয়ার পর নাকি লেখা হয়েছিলো। এরই মাধ্যমে তুঘলকের হাত থেকে নিস্তার পেল প্রজারা, আর প্রজাদের হাত থেকেও মুক্তি পেলেন তুঘলক।
For mercy has a human heart
Pity a human face
And love, the human from divine,
And peace, the human dress.
William Blake