অবিশ্বাস্য হলেও সত্য , ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আগ্রার মুসলিম ঐতিহ্য তাজমহল ভাঙার চিন্তা করেছিল ! সত্যি ,অদ্ভুৎ শােনা গেলেও , ১৮৩০ সালে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক তাজমহলকে ভেঙ্গে তার মার্বেল পাথরগুলো ইংল্যান্ডে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল । কিন্তু কে এই লর্ড বেন্টিঙ্ক? হ্যা, তিনি সেই মানুষ যিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সতীদাহ প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা রেখছিলেন। কি আশ্চর্য তাই না ? তবে তাজমহল ভেঙ্গে এর পাথর বিক্রির যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন এ বিষয়টি কিন্তু আবার অনেকেই সমর্থন করেন না। অনেকে মনে করেন, যেহেতু বেন্টিঙ্ক অনেক রকম ভালো কাজ করছিলো তাই হিংসার বশবর্তী হয়ে বেন্টিঙ্ক এর বিরুদ্ধে এটা একটা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। বেন্টিঙ্ককে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এবং নিচু দেখানোর জন্যই তার সম্পর্কে এমন প্রচারণা করা হয়েছে। তাছাড়া তাজমহল ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত যথার্থ প্রমাণাদিও বেন্টিঙ্ক এর বিরুদ্ধে স্থাপন করতে পারে নি । কিন্তু আসলে খুব গভীরভাবে আমরা যদি তাজমহল বিক্রির বিষয়টিকে পর্যালোচনা করি, অনেক দিক থেকেই এ ধরনের পরিকল্পনা বেন্টিঙ্ক যে গ্রহণ করেছিলো তা প্রমাণ করার সম্ভাব্যতা অনেকাংশেই বেড়ে যায়।

আগ্রার দুর্গের শাহী হাম্মামের চিত্র

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট হিস্টরি বিভাগের অধ্যাপক কবিতা সিং ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ব্রিটিশ আর্কাইভ থেকে অনেক উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং এই উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে বিভিন্ন বক্তৃতা এবং লেখা-লেখির দ্বারা তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করন যে, “তাজমহল ভাঙ্গার বিযয়টাকে কেউ গুজব বলে উড়িয়ে দিতে পারবে না, অবশ্যই এর কিছু সত্যতা রয়েছে”। এই সত্যতাগুলো আজও বিভিন্ন লাইব্রেরিতে পুস্তক আকারে বা নথিভুক্তিকরণের মাধ্যমে পরে রয়েছে, এগুলোকে বের করে এর সত্য প্রমাণ অবশ্যই করতে হবে। এখন আসি আসল বিষয়ে lআসলে এই ভাঙাভাঙ্গির ঘটনাটি কিন্তু তাজমহল থেকে শুরু হয় নি, এটা হয়েছিলো আগ্রাফোর্ট থেকে….আগ্রাফোর্টের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলেই দেখতে পাবো দেওয়ান-ই-খাস । ঐ জায়গাটার দিকে খুব ভালো করে তাকালে দেখতে পাবেন, মোঘল স্থাপনা যেভাবে তৈরি করা হয়েছিলো এর আর্কিটেকচারাল সৌন্দর্যটা এখন আর ওরকম নেই। ওখানে ছিলো মোঘল শাহী হাম্মামখানা, হাম্মামখানার ভেতরের অংশের একপাশের দেয়ালে সাদা চুনকাম করা । এটি মােঘল স্থাপত্যের সাথে সম্পূর্ণই বেমানান… এমনকি , সেখানে দুটি দরজা নতুন সংযােজন বলে প্রতীয়মান । এছাড়া শাহী হাম্মামখানাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে ওটা সরাসরি ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো l এটার মাধ্যমে তারা পরীক্ষা করতে চেয়েছিল যে, এগুলো ভেঙে বিক্রি করলে কি পরিমান টাকা তারা অর্জন করতে পারবে। হয়তোবা এরপরই তারা তাজমহলের দিকে হাত বাড়াতেন ! এত কিছুর পরও ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তারা এই ঘটনাগুলোকে পুরােপুরি মিথ্যা অপপ্রচার এবং বা এর কোনো ভিত্তি নেই বলে উল্লেখ করেন । অথচ আজও লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে আগ্রা ফোর্টের অলংকৃত কলাম গুলো প্রদর্শিত হচ্ছে ।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক

লর্ড বেন্টিঙ্ককে যখন ভারতে পাঠানো হয় তখন তার মাথার ওপরে ছিল ভীষণ চাপ l কারণ তখন মাত্রই বার্মার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি যুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পদ অনেকটাই কমে এসেছিলো এবং এই সম্পদ ভান্ডার কমে আসার ফলে তাদের রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে প্রচন্ড বেগ পেতে হচ্ছিল । তাই তার প্রথম কাজই ছিলো ব্যয়-ভার সংকোচন করা… আর ওই মুহূর্তে তিনি গেলেন আগ্রায় এবং আগ্রায় গিয়ে ঐ হাম্মামখানা টা দেখতে পান । তার কথা অনুযায়ী হাম্মামখানাটা একেবারেই ভেঙেচুরে যা-তা অবস্থা হয়েছিলো, তাই তিনি নির্দেশ দেন হাম্মামখানাটা যেনো ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে এই মার্বেল পাথরগুলোই যেন বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাদের ভাগ্য ভাল ছিলনা l নিলামে বিক্রি করার জন্য যে পাথরগুলো নিয়ে এসেছিলো, সেগুলো খুব একটা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো নাল এই কারণে খুব একটা ভালো দামও উঠলো না , সে কারণে লর্ড বেন্টিঙ্ক কিছুটা হতাশাগ্রস্তই হলেন l এ ছাড়া ইংরেজ রাজনীতিবিদ মাকুস বেরেসফোর্ড , তাঁর “ জার্নাল অব মাই লাইফ ইন ইন্ডিয়া ” গ্রন্থে এবং ইংরেজ প্রশাসক স্যার উইলিয়াম স্লেমান তাঁর বিখ্যাত আত্নজীবনীতে তাজমহল ও আগ্রা ফোর্টের মার্বেল বিক্রির উল্লেখ করেছেন । তাদের মধ্যে বেরেসফোর্ড লিখেছেন, ” যে মার্বেলগুলাে তারা লন্ডনে নিয়েছিলো সেগুলাে তাদের আধুনিক ভবনের সাথে কোনো সামঞ্জস্যই হচ্ছিলো না খাপ খাছিলনা l যেহেতু পাথরগুলো সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করতে কোন সাহায্য করতে পারলো না তাই পাথরগুলাের দিকে খুব একটা মনোযোগও দিলো না। পাথরগুলোকে তারা রান্নাঘর, পেপার ওয়েট এবং কোনো ক্ষেত্রে তরকারী কাটার পাথর হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলো l

১৯০৬ সালে তাজমহলের ছবি

বেন্টিঙ্কের পাঠানাে তাজমহল বিক্রির প্রস্তাবনা কমান্ডার স্যার এইচ ফেন এর কাছে ছিলো…ফানি পার্কস তার ‘ ভ্রমনবৃত্তান্তে’ এ বিষয়ে লিখেছেন। এমনকি ১৮৩১ সালের ২৬ জুলাই ‘ জন বুল ‘ বা দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকা নামক সংবাদপত্রে এই সংবাদ প্রকাশিত হয় । এবং ব্রিটিশ অ্যাম্বাসেডর স্যার ভিলেন থিলম্যানও লিখেছেন যে, এই তাজমহলের পাথর বিক্রি নিয়ে বেশ একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো, কেননা যে পরিমাণ দাম তারা আশা করেছিলো তার ধারের কাছেও যায়নি বরং এতেটাই কম দাম হচ্ছিলো যে পাথরগুলো আনতে যে খরচ হয়েছিলো সেটাও তাদের উঠছিলো না। এখন কথা হচ্ছে, তাজমহল বিক্রির কোনো ঘটনা আসলেই ঘটেছিলো কিনা? সেক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত লেখকদের লেখা থেকেই তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এ ধরনের কোনো একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটতে যাচ্ছিলো। আরো আছে.. বিষয়টি দেখার পর তিনি একজন ভদ্র মহিলা ভারতবর্ষে বেড়াতে এসে তাজমহল ভাঙার ব্যাপারে পত্রিকায় একটা লেখা দেখেন…. বিষয়টি দেখার পর তিনি খুব রাগান্বিত হয়েই একটা আর্টিকেল লিখেন যে, ” ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নরের কি অধিকার আছে এই মৃত ব্যক্তিদেরকে ডিস্টার্ব করার ? তার মতে মৃতি ব্যাক্তিরা শান্তভাবে ঘুমিয়ে আছে, সেখানেই তাদের ঘুমিয়ে থাকতে দিক” এবং তিনি আরও লিখেন, ” মাত্র ২ লক্ষ রুপিতে তাজমহলের দাম মোটেই ওঠেনি, এবং সেটা কিনতে চেয়েছিলো মথুরার একজন হিন্দু ভদ্রলোক যার নাম ‘শেঠ লক্ষ্মীচাঁদ জৈন’ ।

শেঠ লক্ষ্মীচাঁদ জৈন ছিলেন নর্থ ইন্ডিয়ার অত্যন্ত বিত্তশালী এক ব্যাংকার…. তিনি ইন্ডিয়ান মহারাজাদের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করতেন। তাজমহলের দাম যেহেতু ২ লক্ষ রুপি হয়, তাই পরবর্তীতে এতো কম মূল্যের কারণে ব্রিটিশরা তাজমহল বিক্রি আশা ছেড়ে দেন। ফলে এখান থেকেও আমরা প্রমাণ পাই যে তাজমহল বিক্রি করতে চেয়েছিলো। পরবর্তীতে আবারও তাজমহল নিলামে তোলা হয় এবং তখনও লক্ষ্মীচাঁদ জৈন ৭ লক্ষ রুপির বিনিময়ে তাজমহল প্রায় নিয়েই নিয়েছিলো নিলামে জয়লাভ করে সে-ই পেয়েছিল তাজমহল ভাঙার দায়িত্বটা। কিন্তু পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলমান এর মধ্যে যাতে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে এই ভয়ে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ভারতীয় সম্ভ্রান্ত মানুষের বিরূপ মনোভাবের তৈরী হতে পারে এসকল কিছু বিবেচনা করে তারা এখান থেকে পিছিয়ে এসেছিলো।

লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এবং অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য আগ্রা ফোর্ট থেকে লাল স্যান্ডস্টোন স্তম্ভগুলি

২০০৫ সালে, লক্ষ্মীচাঁদ জৈন এর বংশধর বিজয় কুমার জৈন তার “ মথুরা শেঠ ” নামক একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি তাজমহল বিক্রির ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন । তাই একমাত্র বিধাতা’ই জানেন এই তাজমহল বিক্রির ব্যাপারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আরও কতো গোপন নথিপত্র ভারত এবং ইংল্যান্ড এর লাইব্রেরিতে লুকিয়ে রয়েছে। সেটা হয়তো বেরিয়ে আসলে আমরা আরও অনেক অজানা তথ্য পাবো। তবে মনে রাখতে হবে, বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য যেটা তৈরি করেছিলেন ভারতের মোঘল সম্রাট শাহজাহান তার অমর প্রেমের নিদর্শন হিসেবে । যাইহােক , নিলামে বেশি মূল্য না উঠায় এবং সাম্প্রদায়িকতার ভয়ে সে যাত্রাই সম্রাট শাহজাহানের অমরকীর্তি তাজমহল রক্ষা পেয়ে যায় যা আজও জাজ্বল্যমান ।

পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বের এই সপ্তাশ্চর্য- তাজমহল দেখতে ভিড় জমায় আগ্রায়। এটা তৈরি হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে যখন মোঘল সাম্রাজ্য ছিলো শান-শওকতে পৃথিবীর সেরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারত শাসন করতে আসে তখন তাদের মধ্যে সেই পরিমান কৃষ্টি-কলা , শিল্প এর কোনো বালাই-ই ছিলো না। অথচ আজকে তারা পৃথিবী দাপিয়ে রাজত্ব করছে কিন্তু তাদেরকে ঠিকই শিখতে হয়েছিলো এসকল কৃষ্টি-কলা , শিল্প, সৌন্দর্য এই ভারতীয় উপমহাদেশের কাছ থেকে….বিশেষ করে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে।