পুরাণের পাতায় ধর্ম-অধর্ম, নৈতিক-অনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের মধ্যে টানাপোড়েন লক্ষণীয়। পুরাণের মূলকথা, মন্দের বা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের অর্থাৎ ন্যায়ের পালন। তবে সেযুগে নারীর কৌমার্য ও সতীত্বকে উঁচু স্তরের মর্যাদা দেওয়া হত। এখনও বিশ্বাস করা হয় পঞ্চসতী বা পঞ্চকন্যার নাম উচ্চারণ করলে সকল পাপ দূর হয়ে যায়। এই পঞ্চকন্যা হলেন – অহল্যা, কুন্তি, দ্রৌপদী, তারা ও মন্দোদরী।
অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তি তারা মন্দোদরীস্তথা
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহা পাতক নাশনম্।
বন্দনা করলেই পাপ মুক্তি ঘটার দাবি জানিয়ে যে শ্লোকটি রচিত হয়েছে, তাতে এই পাঁচজনকে আদতে সেকালে আদর্শ নারী হিসেবে মানা হয় নি। সমাজ অধুনা যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে, তাতে এনাদের স্মরণ কতখানি যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। অহল্যা, মন্দোদরী ও তারা রামায়ণের চরিত্র। অন্যদিকে দ্রৌপদী ও কুন্তি মহাভারতের চরিত্র।
এই লেখাটি দ্রৌপদীকে উৎসর্গীকৃত। দ্রৌপদী মহাভারত মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় নারী তথা পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিণী। দ্রুপদ কন্যা, ধৃষ্টদ্যুম্ন ভগিনী, অযোনিসম্ভবা দ্রৌপদী। কুন্তি ও দ্রৌপদীর বিরুদ্ধে অসতীত্বের অভিযোগ তাঁদের বহুগামিতার জন্য। দ্রৌপদীকে কোনোভাবেই তাঁর দোষ দেওয়া যায়না। তিনি নির্বাচন করেননি পঞ্চপান্ডবকে, তিনি মাল্যদান করেছিলেন অর্জুনকে। মেনে নিয়েছিলেন স্বামী হিসেবে। কুন্তির মুখ নিঃসৃত বাণী সকলের জানা, আবার দ্রৌপদীর প্রতি সকল পাণ্ডবদের আসক্ত হওয়ার কথাও আমাদের জানা। যুধিষ্ঠির আশঙ্কা করেছিলেন ভাই ভাইয়ে সংঘাতের কথা, সেই ভেবে বিধান দেওয়া দ্রৌপদী হবেন সকলের ভার্যা। স্বয়ং মহাভারত রচয়িতা, বেদব্যাস নানান উদাহরণ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, যাতে দ্রুপদ রাজা সন্তুষ্ট হন এহেন বিচারে।
পতিশ্বশুরতা জ্যেষ্ঠে পতিদেবরতানুজে।
মধ্যমেষু চ পাঞ্চাল্যাস্ত্রিতয়ং ত্রিতয়ং ত্রিষু।
যুধিষ্ঠিরকে একাধারে স্বামী ও ভাশুর, সহদেব স্বামী ও দেওর এবং মাঝের তিনজন স্বামী, ভাশুর আবার দেওর করে দেওয়া হল। মেয়েটিকে কি চরম বিপদে ফেলে দেওয়া হল, একসাথে পাঁচ জনের হাতে তুলে দিয়ে। ঠিক হল পরপর পাঁচদিন পাঁচজনের সাথে বিয়ে হবে।
মাথায় রাখবেন, সকলের দ্রৌপদী চাই কিন্তু আবার কৌমার্য নষ্ট হলে চলবে না। বেদব্যাস বললেন, প্রতিটি বিবাহের পর দ্রৌপদীকে আবার কুমারী করবেন। ম্যানিপুলেশন সফল। একবারও জানতে চাওয়া হল না দ্রৌপদীর কি অভিপ্রায়। তিনি যেন খেলনা পুতুল। আজকের প্রজন্ম এরকম অনাচার মেনে নেবে? নাহ্ নেবে না। কোনোদিন তার ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে, সে মুখ বুজে শুনে ধর্মের খাতিরে বা পুরুষতন্ত্রের খাতিরে তা মানবে না। প্রশ্ন করবে। যাচাই করবে ঠিক ভুল।
দ্রৌপদী সম্ভবত পুরাণের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও বিতর্কিত নায়িকা। তিনি বলেছেন কৃষ্ণ পত্নী সত্যভামাকে, পাঁচ স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে তিনি আজীবন মেনে চলেছেন অনেক কঠিন নিয়ম। ওঁর মত বিচক্ষণতা মহাভারতের খুব কম চরিত্রের মধ্যে দেখা যায়। তিনি বিবাহের পর তাঁর প্রতি অন্যায় আচরণের জন্য প্রতিশোধ চাইতেন, মুখ বুজে সহ্য করতেন না অবহেলা অবিচার। বলা যায়, ওঁর পিঠ ঠেকে গিয়েছিল এই সময়। কতখানি অবহেলা সইবেন আর। গর্জে উঠতেই হত। এই যুগে গর্জে ওঠার জন্য পাঁজি মেলাবার দরকার নেই। অন্যায় যে মুহূর্তে হবে, সেই মুহুর্তে গর্জে উঠতে হবে। অপর পক্ষকে জানাতে হবে তাঁরা ভুল করছেন, ভুল বলছেন। হতেও পারে অপর পক্ষ অজ্ঞ, তাই তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো জরুরি। হতেও পারে আগের প্রজন্ম হুঙ্কার করেন নি বলে তাঁরা ধরে নিয়েছেন সেগুলি সঠিক। তাঁদের শুধরে দিতে হবে।
দ্রৌপদী পাঁচ পুত্রকে হারিয়ে যখন শোকাতুর, তখনও তিনি অশ্বত্থামাকে ক্ষমা করে দেন। কেন? কারণ তিনি চান নি আরেক মায়ের কোল খালি হোক। সকলের পরামর্শ ও উপদেশ অগ্রাহ্য করেন তিনি। কতখানি মমতা থাকলে বা তিনি নিজের মাতৃত্বকে কতখানি সম্মান করলে চরম শোক বিদীর্ণ হলেও ক্ষমা করে দেন। নারী মাত্রই মায়ের জাত। তাঁদের মমতা, অনুরাগ কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না।
দ্রৌপদীকে পণ রেখে পাশা খেলায় মত্ত নিজের স্বামী। চরম অধর্ম, ধর্মের নামে রাঙানো হয়েছে। এখানেও নেন নি কোনো মতামত। আবার objectified। ভরা সভায় বস্ত্র খুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে দ্রৌপদী উপস্থিত সবাইকে তিরস্কার করেছেন। বুক কেঁপে ওঠে, যদি কৃষ্ণ সঠিক সময়ে না আসতেন? কিভাবে উলঙ্গ হত নারীজাতি? শাড়িটি অন্তহীন না হলে, কি হত? তখন দ্রৌপদীর জায়গায় যে কোনো মেয়েই বিলাপ ছাড়া আর কি করতে পারে? এখন আমাদের ভাবতে হবে, তলিয়ে ভাবতে হবে আমরা কি নিজেদের এতখানি সহজলভ্য করব? আমরা কি নিজদের বস্ত্রহরণ করতে দেব? না! আবারও একই কথা, প্রতিবাদ করতে হবে। মুখে না হলে, হাতিয়ারে। তিনি পাঞ্চাল কন্যা, তিনি কি পারতেন না পিতা দ্রুপদ কে এই অনর্থ ঘটার আগেই সমাচার দিতে? কিন্তু আমরা তাই করব। দুর্ঘটনার আগেই তৎপর হব। মেরুদণ্ডহীন পুরুষের উপভোগ করার পাত্রী হবো না।
দ্রৌপদীর পদক্ষেপ গুলি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কখনো যথাযথ, কখনো নিয়ম বিরুদ্ধ। তাঁর সব গুণাবলী আমরা অস্বীকার করবো না, আবার সব গুণাবলী মেনে নেবো না। তবুও তিনি সতী। এই সতী-র ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, সৎ যুক্ত ঈ-কার। সৎ অর্থাৎ চেতনা যুক্ত সত্ত্বা। চেতনা জ্ঞান যাঁর আছে বা যিনি ন্যায় পরায়ণ তিনি হলেন সতী। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে সতীত্বের সাথে এক পতি বা কৌমার্যের কোনো যোগ নেই। আর এখানেই দ্রৌপদীর সতী হওয়া স্বার্থক।
©নন্দা