অষ্টাদশ শতকে একদল উপনিবেশিক যখন উত্তর ক্যারোলিনার লাম্বার নদীর তীরভূমি  দিয়ে  স্থলপথ অতিক্রম করছিলেন, তখন একদল ধূসর বর্ণের চক্ষু বিশিষ্ট রেড ইন্ডিয়ানের দেখা পেয়ে তারা রীতিমত অবাক হয়ে গেলেন। তাদের বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেল যখন তারা লক্ষ্য করলেন যে এসব রেড ইন্ডিয়ানদের কথাবার্তায় ইংরেজী ভাষার সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে।

            এই ধূসর চোখের রেডইন্ডিয়ানরা দাবী করে যে তাদের পূর্বপুরুষরা যে বই এর সঙ্গে কথা বলতে পারত। তাদের এ কথায় আবিষ্কারকদের বুঝতে মোটেই অসুবিধা হত না যে তাদের পূর্বপুরুষরা যে বই পড়তে পারতেন তাই বুঝাতে চাইছে।

      এইসব রহস্যময় লোকদের বংশধরেরা আজও রোব্‌সন কান্ট্রীতে বসবাস করছে। এখানে এরা লাম্বার ইন্ডিয়ানন্‌স্‌ নামে পরিচিতি। এদের কারো কারো গায়ের রং অতিরিক্ত ফর্সা আবার কেউ কেউ ঘোর তামাটে। আজকের দিনে অবশ্য নীল চোখ আর চুলের দেখা পৃথিবীর সর্বত্রই পাওয়া যায়।

      এদের সত্যিকারের উদ্ভব কোথায় হয়েছিল, এদের উত্তম পুরুষেরা কোথায় ছিলেন-কিভাবে আসলেন, এর সমাধান আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে কেউ নিতে পারেননি।কিন্তু একটা বিশেষ ঘটনা মানুষের মনে বিভিন্ন কল্পনার জন্ম দেয়-বছরের পর বছর মানুষের মনে ধারণার জাল বুনতে সাহায্য করে।

১৫৯০খ্রিস্টাব্দে স্যার ওয়াল্টার র‍্যাল বসতি স্থাপনের জন্য একদল লোককে রোয়ানোক দ্বীপের ছেড়ে দিয়ে আসেন। আর আশ্চর্য, ওখান থেকে সকল ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা রহস্যজনকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। র‍্যালে জীবনে আর কোনদিন এদের সন্ধান পাননি; র‍্যালে এই লষ্ট কলোনী রোয়ানোক দ্বীপ থেকে লম্বার নদী মাত্র ২০০ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত।

       রানী প্রথম এলিজাবেথ যখন র‍্যালের পক্ষে একটি সনদ অনুমোদন করেন, তখন র‍্যালে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য দুবার উদ্যোগ নেন। ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দে প্রথমবারের উপনিবেশ স্থাপনের প্রচেষ্টা মুহুর্মুহু রেড ইন্ডিয়ানদের আক্রমণের তীব্রতার কারণে পরিত্যাক্ত হয়। তাছাড়া ঔপনিবেশিকদের রসদের ঘাটতি ও এই  প্রচেষ্টার বাঁধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।

            ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জন ওয়াইট একশতকেরও বেশি নারী-পুরুষদের একটি দল নিয়ে উপনিবেশ স্থাপনের আশায় ঐ অঞ্চলে পৌঁছান। তাদের ভাগ্যেও ঐ ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে বলে অনুমান করা হয়। কারো কারো মতে তারা এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন অবশেষে ওয়াইট মাত্র ১৫ জন নাবিক নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার জন্য সাগর পথে পাড়ি জমালেন। আশা পথে কোথাও না কোথাও সাহায্য ও রসদের সন্ধান মিলবে। তিনি যাদের ছেড়ে গেছেন তাদের পরামর্শ দিয়ে গেলেন যে তারা যদি তার অনুপস্থিতিতে ঐ স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তবে যেন তারা তাদের গন্তব্য স্থান সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে খোদাই করে রেখে যায়। তিনি প্রয়োজনে তা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবেন।

দুর্গে লুটতরাজঃ

ইংল্যান্ড ও স্পেনের মধ্যে সেই সময় তুমুল যুদ্ধ চলছিল। এই যুদ্ধের কারণে ওয়াইট ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ফিরে আসতে পারেননি। ছেড়ে যাওয়া ঔপনিবেশিকরা রোয়ানোকে একটি দুর্গ তৈরী করলো। এই দুর্গে বারবার রেড ইন্ডিয়ানদের হামলা ও লুন্ঠন চলতে থাকলো। উপায়ান্তর না দেখে এরা দুর্গ ত্যাগ করতে বাধ্য হল। তাদের পক্ষে কোনো চিহ্ন রেখে যাওয়া সম্ভবপর হলো না। তারা যেন একদম, অদৃশ্যই হয়ে গেল। একটি কাঠের খুঁটিতে কেবল ‘ক্রোটোয়ান’ কথাটিই ওয়াইট আবিষ্কার করতে পারলেন।

        ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও এই  ‘ক্রোটোয়ান’ শব্দটি নিয়ে বিতর্ক চলছে।কেউ কেউ মনে করেন রেড ইন্ডিয়ানদের কোন এক গোত্রের নাম । এরাই হয়তো ঐ ঔপনিবেশিকদের বার বার আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

       কিন্তু রোয়ানোকের উত্তর অঞ্চলে ‘ক্রোটোয়ান’  নামে একটি দ্বীপের অস্তিত্ব রয়েছে। এই দ্বীপ সম্বন্ধে তৎকালীন ঔপনিবেশিকরা হয়ত জ্ঞাত ছিলেন। এই দ্বীপের অধিবাসীরা ছিল হ্যাটেরাস গোত্রের। এরা কিছুটা বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। ঐ ঔপনিবেশিকরা যদি কোনক্রমে ঐ দ্বীপে পৌঁছাতে পেরে থাকে তবে হয়তো তাদের সঙ্গে দ্বীপবাসীদের মিশ্র বিবাহ জনিত কারণে নতুন যে গোত্রের সৃষ্টি হয় তারাই আজকের লাম্বার ইন্ডিয়ানস নামে পরিচিত হয়ে থাকবে।

         গভর্নর ওয়াইটের ধারণা এসব ঔপনিবেশিকরা স্বেচ্ছায় ক্রোটোয়ান ন্দ্বীপে চলে যায়। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করতে না পেরে ওয়াইট ইংল্যান্ডে ফিরে যান।

ওয়াইটের মতামত এর পেছনে যে জোরালো যুক্তি রয়েছে তারও কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বহু হ্যাটেরাস ইন্ডিয়ান দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডের দিকে চলে আসে এবং সেখানে বসবাস শুরু করে। বিশেষ করে লাম্বার নদীর অববাহিকার উপত্যকায় তারা বসতি গড়ে তোলে। হারিয়ে যাওয়া উপনিবেশ রোয়ানোকে যে ১৫ জন ইংরেজ বসতি স্থাপন করতে যান তাদের গোত্রনাম- যেমন স্যামসন ,কুপার,  ডিয়ার-ইত্যাদি প্রায় ৪১ টি  গোত্র নামের উল্লেখ লাম্বী  ইন্ডিয়ানদের মধ্যে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ইংরেজ রক্তধারা মিশে যাবার স্বাক্ষর এই নামগুলিই বহন করে চলেছে।