ইজিপ্টোলজি বা প্রাচীন মিশরীয়বিদ্যা পৃথিবীর ইতিহাসের এক বিশাল অংশ দখল করে আছে। শুধু তা-ই নয়, মিশরীয় আবিষ্কার আজও পর্যন্ত ইতিহাসবিদদের কৌতূহলের শীর্ষে অবস্থান করে থাকে। কিন্তু এই বিশাল অর্জন ইজিপ্টোলজির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কে রেখে গেছেন, তা কি আমরা জানি? মিশরের ইতিহাসকে নতুন মাত্রা প্রদানকারী এই সফল ব্যক্তির নাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। হ্যাঁ, সেই পরাজিত নেপোলিয়নের কথাই বলছি, মিশরীয় ভূমধ্যসাগরের ওপর যার নৌবহরকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো ব্রিটিশরা এবং যিনি ১৮১৫ সালে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছিলেন যৌথ শক্তি ব্রিটিশ ও পার্সিয়ানদের কাছে ইতিহাসখ্যাত ওয়াটারলু এর যুদ্ধে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হলেও মিশরীয় ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণে তিনি একজন সর্বোচ্চ সফল ব্যক্তি হিসেবে সম্মান পাবার দাবি রাখেন।
ইউরোপীয়দের সাথে ফ্রান্সের বিরোধ বহু দিন আগের। নেপোলিয়ন যখন কর্সিকার জেনারেল, তখন তিনি ভূমধ্যসাগরে ইউরোপীয়দের আধিপত্য খর্ব করবার একটি পরিকল্পনা করেন। সে সময় তো ভারতবর্ষই ছিলো পৃথিবীর সকল শক্তির ভিত্তি তৈরীর কারখানা। সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের সাথে ইউরোপের বাণিজ্যপথ বন্ধ করবার একটাই উপায়- মিশরের ওপর স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ। যা ভাবা, সে-ই কাজ। ১৭৯৮ সালে আরবীয় সালতানাত মামলুকদেরকে পিরামিডের যুদ্ধে পরাজিত করে মিশরের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিলেন নেপোলিয়ন। যদিও তাদের এই বিজয়ানন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। ভূমধ্যসাগরে ঘাঁপটি মেরে থাকা ব্রিটিশরা খুব সহজেই ধ্বংস করে দিয়েছিলো নোঙর করে রাখা ফ্রান্সের বিশাল জাহাজগুলোকে।
মরুভূমির কঠিন পথ ধরে আসার সময় নেপোলিয়ন আগেই তার বহু সৈন্য হারিয়েছেন। আর বিজয়ের সন্ধিঃক্ষণে এমন পরাজয় নেপোলিয়নের অনেক পরিকল্পনাই ওলট-পালট করে দিয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও দৃঢ়চেতা নেপোলিয়ন ভেঙে পড়েন নি। কারণ তার মিশর অভিযানের আরও একটি গৌণ উদ্দেশ্য ছিলো এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণের পথটি তখনও বাধাগ্রস্ত হয় নি।
নেপোলিয়ন অনেক আগে থেকেই ছিলেন কৌতূহলী স্বভাবের। আর মিশরকে জানার ইচ্ছা তো তার বহু দিনের। মিশরের অনেক রহস্যময় ঘটনার কূল-কিনারা করবার জন্য মরিয়া ছিলেন তিনি। পিরামিডের কিংস চেম্বারে একা এক রাত অবস্থান করার মতো সাহসী কাজটিও করেছিলেন নেপোলিয়ন। মিশর আক্রমণের এই অভিযানে আসার সময় ৩৫ হাজার সৈন্যের সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তিনি ১৬০ জনেরও বেশি জ্ঞানী-গুণী শিল্পী ও পন্ডিত ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এই দলটির নাম দেয়া হয় ‘কমিশন অফ দ্য সায়েন্সেস অ্যান্ড আর্টস অফ ইজিপ্ট’। রহস্যময় মিশরকে আবিষ্কারের নেশায় তাদেরকে নিয়ে সুযোগ বুঝে কাজে নেমে পড়লেন নেপোলিয়ন।
নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর চেয়েও ইতিহাসে বড় অবদান রেখেছিলেন এই ছোট দলটি। বহু বছর ধরে পরিচালিত তাদের যত্নশীল কাজ ইউরোপে মিশরবিদ্যার এক অসামান্য ক্ষেত্রের জন্মদাতা। হাজার বছর ধরে নীল নদের ধারে শাসন করা বিশাল মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস প্রকাশের গুরুদায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববাসীকে ধন্য করেছিলেন তারা।
সামরিক মিশনের ব্যর্থতার সম্পূর্ণ বিপরীতে নেপোলিয়নের দলের বৈজ্ঞানিক অভিযানটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলো। দুই প্রবীণ পণ্ডিত- গণিতবিদ গ্যাস্পার্ড মঙ্গে এবং রসায়নবিদ ক্লড লুইস বার্থোলেটের নেতৃত্বে এই বৈজ্ঞানিক অভিযানটি শুরু হয়েছিলো। তারা উভয়েই ইতালিতে নেপোলিয়নের সাথে কাজ করেছিলেন।
১৭৯৮ সালের আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে কায়রোতে সংগঠিত হয় তাদের মিশরীয় ইনস্টিটিউট, যার প্রেসিডেন্ট ছিলেন মঙ্গে এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেপোলিয়ন। গণিত, সাহিত্য ও চারুকলা, প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং পদার্থবিদ্যা ও রাজনৈতিক অর্থনীতি –এই চার ভাগে বিভক্ত ইনস্টিটিউটটির প্রতিষ্ঠাতা আইনে বলা হয়েছে যে, এর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মিশরের প্রকৃতি, অর্থনীতি ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করাই নয়; বরং মিশর আলোকিতকরণের নীতিগুলোকে অগ্রসর করা ও এর সরকারকে সহায়তা করার ক্ষেত্রেও অবদান রাখা এর লক্ষ্য।
নেপোলিয়ন তার এই মিশর অভিযানে যোগদানের জন্য ডমিনিক ভিভান্ট ডেনন নামের একজন অভিজাত কূটনীতিবিদকে রাজি করিয়েছিলেন, যিনি একই সাথে একজন স্বাধীনতাভিত্তিক উপন্যাসের লেখক ও একজন দক্ষ শিল্পীও ছিলেন। ডেনন জেনারেল ডেসাইক্সের সাথে মিশরের উচ্চতর জায়গাগুলোতে গিয়েছিলেন, যেখান থেকে তিনি অসংখ্য ফারাও-স্মৃতিস্তম্ভের স্কেচ ও তথ্য সংগ্রহ করেন। ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন প্যারিসে ফিরে গেলে ডেননও তার সাথে ফিরে যান এবং তার মিশরীয় অ্যাডভেঞ্চারের উপর একটি বই লিখতে শুরু করেন।
১৮০২ সালে ডেননের লেখা বই ‘ট্র্যাভেলস ইন লোয়ার অ্যান্ড আপার ইজিপ্ট’ প্রকাশিত হয়, যা এক অভাবনীয় সাফল্যের দেখা পেয়েছিলো। ডেননের আঁকা চিত্রগুলো সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অসাধারণ ছিলো। এর আগের যে কোনো বইয়ের চেয়ে ডেননের বইটিতে মিশরের অনেক বেশি দৃষ্টান্ত উল্লিখিত হয়েছে। তিনি যে মিশরীয় স্মৃতিস্তম্ভগুলি এঁকেছিলেন- বিশেষ করে ‘দ্য কলোসি অফ মেমনোন, ‘দ্য টেম্পল অফ হাথোর’, ‘দ্য স্ফিঙ্কস অফ গিযা’ ইত্যাদির চিত্রায়ণ এতো বিস্তারিতভাবে আর কখনোই দেখা যায় নি। তাদের সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য ফ্রান্সকে মোহিত করেছিলো।
ডেনন তার বইটি নেপোলিয়নকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং এই বইটি নেপোলিয়নের সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছিলো। একজন পরাজিত সামরিক নেতা থেকে তিনি রাতারাতি একজন হিরোতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, যিনি গ্রীক ও রোমের মতোই প্রভাবশালী আরও একটি সভ্যতার শক্তি ও মহিমাকে প্রকাশ্য রূপ দিয়েছিলেন।
ডেনন ফিরে যাওয়ার পর নেপোলিয়ন মিশরীয় পুরাকীর্তিগুলো আরও ভালোভাবে তদন্তের জন্য এই অঞ্চলে আরও জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিতদেরকে পাঠিয়েছিলেন। যদিও সেখানে সামরিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিলো, তবুও ইতিহাস গড়ার স্বার্থে তাদেরকে পাহারা দিয়ে গবেষণাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। গবেষকরা সে সময়ও অসংখ্য তথ্য ও নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন এবং সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের মাধ্যমে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। নেপোলিয়নের আদেশমতো, এই নতুন কাজগুলো নিয়ে তারা যখনই ফ্রান্সে ফিরে যেতে উদ্যত হলেন, তখন বাধা হয়ে দাঁড়ালো ইউরোপীয়রা। ব্রিটিশদের কাছে ফরাসিদের আত্মসমর্পণে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলো। ব্রিটিশ কমান্ডাররা ফরাসিদের কাছে কমিশনের সংগ্রহ করা সমস্ত পুরাকীর্তি হস্তান্তরের দাবি করেছিলো, যার মধ্যে ১৭৯৯ সালের জুন মাসে রশিদ বা পশ্চিমাদের ভাষায় রোজেটা শহরে পাওয়া একটি খোদাই করা কালো পাথরের স্টেলাও ছিলো। শহরের নামেই পাথরটির নামকরণ করা হয়েছিলো ‘রোজেটা’। প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল অসামান্য এই পাথরখন্ডটিকেও ফরাসিরা অন্য সবকিছুর সাথে ব্রিটিশদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। কমিশন অবশ্য তাদের নথিপত্র নিজেদের কাছে রাখার জন্য অনেক লড়াই করেছে। ফরাসি প্রকৃতিবিদ ইতিয়েন জফরয় সেইন্ট-হিলাইর তো ব্রিটিশদের কাছে এসব হস্তান্তর না করে সবকিছু পুড়িয়ে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন। তার এই হুমকিতে কাজ হয়েছিলো। ব্রিটিশরা তাদেরকে সংগৃহীত তথ্যগুলো রাখার অনুমতি দিয়েছিলো।
ফ্রান্সে অভিযাত্রীদের ফিরে আসার কয়েক মাস পর নেপোলিয়ন ঘোষণা দেন যে, মিশরে পণ্ডিতদের কমিশনের তদন্ত একটি বড় মুদ্রিত রচনায় প্রকাশিত হবে। এটি একটি বিশাল উদ্যোগ ছিলো। ১৮০৯ সাল নাগাদ ৩৬ জন লোক এই লেখার সাথে এবং প্রায় ১০০ জন কপার প্লেটে খোদাইকাজের সাথে জড়িত ছিলো। প্রায় ৯০০টি কপার প্লেটে তিন হাজারেরও বেশি ফিগার খোদাই করা হয়েছিলো। ভূগোলবিদ এদমি ফ্রান্সিস জোমার্দ ছিলেন এই বিশাল উদ্যোগের প্রজেক্ট ম্যানেজারদের একজন।
নেপোলিয়ন ইতিহাসে একজন পরাজিত ফরাসি সম্রাট বলেই পরিচিত। কিন্তু এটি কতোটুকু সত্য? শুধুমাত্র সামরিক সফলতা বা বিফলতা দিয়ে জয়-পরাজয়ের মাপকাঠি নির্ধারণ কতোটুকু যৌক্তিক? আমার কাছে নেপোলিয়ন একজন সফল ব্যক্তি, যিনি অপরাজিত রয়েছেন নিজের আগ্রহ ও কৌতূহলকে সুনির্দিষ্ট কাঠামো প্রদানে। সফলভাবে মিশরবিদ্যার ভিত্তি গড়ে তোলা এই নায়ককে একজন বিজয়ী হিসেবেই আমাদের স্মরণ করা উচিৎ।
রেফারেন্সঃ