ভারতীয় উপমহাদেশে পারস্যের প্রভাবের হাজারটা উদাহরণ দেয়া কঠিন কিছু নয়। কেননা পারস্য এতোটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো এখানকার মানুষের জীবনধারার সাথে যে, ভারতবর্ষের জীবনাচারে পারস্যের বস্তুগত কিংবা অবস্তুগত উপাদানের সংযুক্তি এখানকার মানুষকে পারস্যের কাছে চিরঋণী করে রেখেছে আজও। আর এই ঋণের ভার কিন্তু সবচেয়ে বেশি বর্তায় বাঙালির ওপরই। হ্যাঁ, বাঙালির জীবনেই পারস্য ছিলো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।

বাংলার অপসংস্কৃতিগুলোকে প্রথম প্রশ্নবিদ্ধ করা ব্যক্তি রাজা রামমোহন রায়ের রচনা করা বইগুলো ছিলো ফারসি ভাষায় লেখা। আঠারো শতকের সেই সময়টাতে বাংলার পাশাপাশি ফারসি ভাষাটা শুধু জানা থাকলেই নির্দ্বিধায় জীবন কাটিয়ে দেয়া যেতো। এ থেকেই বোঝা যায়, ফারসির গুরুত্ব কতোটা বেশি ছিলো বাঙালির কাছে।

ভাষার কথা কি-ই আর বলবো! হয়তো আমার ও আপনার মাঝে এই মাত্র হওয়া কথোপকথনের আশি ভাগই ফারসি শব্দ ব্যবহার করে বলা। হ্যাঁ, ফারসি শব্দগুলো বাংলা ভাষার সাথে এমনভাবেই মিশে গেছে যে, কথা বলার সময় হয়তো জানবেনও না কতোগুলো ফারসি শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছেন। বেতার, পেস্তা, কিশমিশ, গোশত, কাবাব, খরগোশ, কবুতর, মসজিদ, রমজান, রোজা, দরগাহ, ঈদগাহ, কারখানা, হিন্দু, ফিরিঙ্গি, মা, বাবা, খালা –কতো কতো ফারসি শব্দ! অবাক হচ্ছেন নাকি নিত্যদিনের ব্যবহার করা খুব সাধারণ কিছু শব্দ দেখে? হ্যাঁ, এগুলো সবই ফারসি শব্দ, যা বাংলা ভাষার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

ভারতবর্ষে ফারসির অনুবাদ করা রামমোহন রায়ের রচনা

রামমোহন রায়ের রচনা

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে বাংলার অসংখ্য গণ্যমান্য সাহিত্যিকরা বাংলায় প্রচুর ফারসি শব্দের ব্যবহারে সাহিত্য রচনা করেছেন। বাংলা গদ্যের প্রথম যুগে তো এক ধরনের বিশেষ নামই ছিলো সাহিত্যের শব্দচয়নকে ঘিরে, আর তা হলো ‘মুসলমানী বাংলা’। এই মুসলমানী বাংলা কিন্তু বাংলা, উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষার সংমিশ্রণকেই নির্দেশ করতো।

ষোলো শতকের শেষ দিকে যখন থেকে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন থেকে বাংলার ওপর ইরানের এই প্রভাব আরো দৃঢ় হয়। ইরানের সমস্ত সংস্কৃতি ও শিল্প মুঘল সম্রাটদেরকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করতো। মুঘল যুগে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন সম্রাটকে বলা হতো ‘বাদশাহ’, যা মূলত ইরানের সংস্কৃতি। বাদশাহ ছাড়াও অন্য যতো পদবী ব্যবহার করা হতো, তার সবগুলোই ছিলো বাংলা বহির্ভূত মুসলমানি শব্দ। সে সময় প্রশাসন, রাজস্ব ও আদালতের ভাষা ছিলো আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কির ওপর নির্ভরশীল।

ফারসির জনপ্রিয়তা এতোটাই ছাড়িয়ে গিয়েছিলো যে, হিন্দু ব্যক্তিরাও দৈনন্দিন কথাবার্তা বলা ও লেখার ক্ষেত্রে ফারসির ব্যবহার শুরু করেছিলো। মুর্শিদাবাদ, রাজমহল, শ্রীরামপুর, হুগলি, কোলকাতা –সমস্তই পরিণত হয়েছিলো ফারসি চর্চার প্রধান কেন্দ্রে।

প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফারসি বাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিরাজ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফারসি বিভাগ চালু হয় এখানে। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে ফারসি পড়তে হতো ছাত্রদেরকে। আঠারো-উনিশ শতকের দিকে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়া পাঁচটি দৈনিক পত্রিকা বাংলায় ফারসি ভাষার জনপ্রিয়তাকেই নির্দেশ করে।

ভারতবর্ষে পারস্যে সংস্কৃতি

পারস্যে সংস্কৃতি

সর্বোপরি শুধু ভাষার দিক দিয়েই নয়, পারস্য বা ইরান বাংলার পুরোটা জুড়েই আসন পেতে বসেছিলো। পোশাকের ধরন, খাওয়া-দাওয়া, সংগীতচর্চা, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, চিত্রকলা, নাট্যকলা –বাংলার এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে ইরানের বিচরণ ছিলো না। আর এই প্রভাব আজও আমাদের মাঝে বিরাজমান। সুতরাং পারস্যের কাছে আমরা আজীবনই চিরঋণী হয়ে থাকবো।

রেফারেন্সঃ