প্যারীসুন্দরী দেবীঃ নীল বিদ্রোহের অন্যতম জননেত্রী, Stay Curioussis

আঠারো শতক। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলা। কুষ্টিয়া তখনও স্বতন্ত্র কোনো জেলা নয়। কুমারখালির ইংরেজ রেশম কুঠির নায়েব রামানন্দ সিংহের ঘর আলো করে জন্ম নিলো ফুটফুটে এক মেয়ে শিশু, রামানন্দের ছোট মেয়ে প্যারীসুন্দরী দেবী।

দিন গড়াতে লাগলো। পলাশীর যুদ্ধের পর কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলার আমলা সদরপুরে জমিদারি গড়ে তুললেন রামানন্দ সিংহ। প্যারীসুন্দরী দেবী বড় হলেন। তার বিয়ে হলো কৃষ্ণনাথ সিংহের সাথে। কিন্তু বেশি দিন সংসার করবার সৌভাগ্য হয় নি তার। খুব অল্প বয়সেই নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হলেন প্যারীসুন্দরী।

ছেলে সন্তানবিহীন বাবার সমস্ত জমিদারির অর্ধেক দেওয়া হলো প্যারীসুন্দরীকে, বাকি অর্ধেক পেলেন আরেক বোন শ্যামাসুন্দরী (মতান্তরে ব্রজসুন্দরী)। প্যারীসুন্দরী ছিলেন মেধাবী ও বুদ্ধিমতি। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ দক্ষতার সাথে দেখাশোনা করে আসছেন বাবার বিষয়সম্পত্তি। সন্তানবিহীন প্যারীসুন্দরী দেবী প্রজাদের মাঝেই নিজের সন্তান খুঁজে পেতেন। হয়তো তার কাছে মাতৃত্বের আরেক রূপ ছিলো প্রজাবাৎসল্য।

প্যারীসুন্দরী দেবীঃ নীল বিদ্রোহের অন্যতম জননেত্রী, Stay Curioussis

বাংলার নীল বিদ্রোহের একটি চিত্র, ১৮৬৭

আমলা সদরপুরের আশেপাশের অঞ্চলে নীলের ফলন বেশ ভালো হতো। এই বিষয়টি ব্রিটিশদের নজর এড়ায় নি। তাই ব্রিটিশ এম. জেড. কোম্পানির নীল চাষের প্রধান এলাকায় পরিণত হয় আমলা সদরপুর। আর কুষ্টিয়া শহরের বেকি দালানে ছিলো এম. জেড. কোম্পানির কর্মকর্তা টমাস আইভান কেনীর অফিস। আমলা সদরে নীল চাষ আরম্ভের মাধ্যমেই প্যারীসুন্দরী দেবীর জীবনে অনুপ্রবেশ ঘটে কেনী নামের এই খলনায়কের।

নীল চাষের উপযোগী এই মাটিই যেনো কাল হয়ে দাঁড়ালো আমলার চাষীদের জীবনে। নীল চাষের জন্য চাষীদের উপর নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারের ইতিহাস কারো অজানা নয়। আমলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। অন্যায়ভাবে জুলুম করে চাষীদের দিয়ে নীল চাষ করিয়ে নিতে লাগলেন টমাস আইভান কেনী। মানুষ হিসেবেও কেনী ছিলেন ভীষণ নিষ্ঠুর। তার নির্দয় আচরণ কৃষকদের জীবনে বিষ ঢেলে দিয়েছিলো। তবে তখনও কেনী জানতেন না যে, এই এলাকার জমিদারী একজন বীরাঙ্গনা ও বুদ্ধিমতি নারীর হাতে, যিনি এই চাষীদেরকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন।

প্যারীসুন্দরী দেবীঃ নীল বিদ্রোহের অন্যতম জননেত্রী, Stay Curioussis

বাংলাদেশের মেহেরপুরে অবস্থিত ভাটপাড়া নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ

চাষীদের একের পর এক নালিশে ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা প্যারীসুন্দরী নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে কেনী সাহেবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। চাষী-মজুর, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী তৈরী করলেন তিনি এবং তাদের মাধ্যমে আক্রমণ করলেন কেনীর শালঘর মধুয়ার কুঠিতে। বাঙালি মেয়ে হয়ে একজন লাট সাহেবের কুঠি লুট করার গৌরব ইচ্ছে করেই প্রচার করে বেড়ালেন প্যারীসুন্দরী। কেনী এমন অপমান নিতে পারলেন না। তিনিও আদেশ দিলেন যে, প্যারীসুন্দরী দেবীকে যেনো জীবিত অবস্থায় তার কাছে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু কেনী তখনও বুঝতে পারেন নি যে, এই নারী তার ভয়ে দমে যাবার পাত্রী নন। প্যারীসুন্দরী উল্টো ঘোষণা করে বসলেন, কেনীর মাথা কেটে এনে দিতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে সেই ব্যক্তিকে। তাই দ্বিতীয় বারের মতো সাধারণ জনতা আক্রমণ করলো কেনীর কুঠি। এবারও কেনী সেখান থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কিন্তু দারোগা মোহাম্মদ বক্স পারলেন না, খুন হলেন কৃষকদের হাতে। তার লাশকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলা হলো। এ যেনো প্রজাদের এক অপ্রতিরোধ্য আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ।

প্যারীসুন্দরী দেবীঃ নীল বিদ্রোহের অন্যতম জননেত্রী, Stay Curioussis

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় মঙ্গলগঞ্জ নীলকুঠি

মামলা হয়ে গেলো প্যারীসুন্দরীর নামে। মামলার বিচারে রায় হলো তার বিরুদ্ধে। জমিদারির সমস্ত সম্পত্তি ব্রিটিশ সরকারের অধিকারে চলে গেলে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। এতে জমিদারি ফেরত পেলেও ঋণগ্রস্ততা ঘিরে ধরে তাকে। তাই জমিদারির এক বিরাট অংশ পত্তনি বন্দোবস্ত করে দিতে হয় তাকে। এরই মাঝে একজন ছেলে সন্তানকে দত্তক নিয়েছিলেন প্যারীসুন্দরী। তার নাম রাখা হয় তারিণীচরণ সিংহ। নিজের জমিদারী পরবর্তীতে তিনি এই ছেলেকেই দিয়ে দিয়েছিলেন।

এই উপমহাদেশের অসংখ্য রত্নকে আমরা মনে রাখি তাদের অবদান ও আত্মত্যাগের জন্য। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এই স্মরণীয় মানুষগুলোর ভিড়ে নারীর সংখ্যা খুবই কম। তবে বাস্তবতা কিন্তু প্যারীসুন্দরী দেবীর মতোই প্রজ্জ্বল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা, যে বিদ্রোহের কারণে ব্রিটিশ সরকার নীলচাষকে আইনের আওতায় আনতে বাধ্য হয়েছিলো। আর সেই নীল বিদ্রোহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একজন প্রজাবাৎসল, দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক ও অসম সাহসী নারী। প্যারীসুন্দরী দেবীর মতোন আরো বহু নারী নিজ নিজ অঞ্চল থেকে এভাবেই অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের এই আত্মত্যাগের ইতিহাস ফিরিয়ে আনা আমাদের কর্তব্য।

রেফারেন্সঃ