প্রাচীন জনপদ গৌড়, Stay Curioussis

প্রাচীন বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ গৌড়পাল শাসনের অবসানের পর সেন রাজাদের আমলে গৌড়ের গোড়াপত্তন। গৌড় নগরী পাল, সেন, সুলতানী, মুঘল আমলের পাঁচশ বছরের বেশী শাসনামলের বিলীয়মান স্মৃতিকে ধারণ করে আছে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের দিকে গৌড় নামের এক ব্যক্তির কথা জানা যায়, যিনি মালদহ এলাকায় একটি ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এখানে এককালে প্রচুর গুড় উৎপাদিত হতো বলে জায়গাটির নাম হয়েছে গৌড়। কোকা আন্তোনভা নামের একজন রুশ ঐতিহাসিকের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি বৃহত্তম রাষ্ট্রের একটি ছিল গৌড়।

প্রাচীন জনপদ গৌড়, Stay Curioussis

সেন আমলের বুদ্ধ মুর্তি

সুলতানী আমলে গৌড় আবার উঠে আসে খ্যাতির শীর্ষে। পাঁচশো বছরের বেশী সময়ের শাসনামলে হিন্দু ও মুসলিম রাজা বাদশাহরা গৌড়ে তাদের রাজধানী গড়ে তোলেন এবং নির্মাণ করেন মসজিদ, মন্দির, মিনার, তোরণ, পুকুর ইত্যাদি। বিজয় সেন –লক্ষণ সেনের পর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দর শাহ, জালালইদ্দিন মুহাম্মদ শাহ, গিয়াস উদ্দিন শাহ, শিহাবউদ্দিন বায়েজিদ শাহ, শামসুদ্দিন আহমদ শাহ, নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ, রোকনুদ্দিন বরবক শাহ, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ, সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ, হুমায়ুন, শেরশাহ, সুলায়মানের শাসনামলের কয়েক শতক ধরে গৌড় নগরীর স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে।

প্রাচীন জনপদ গৌড়, Stay Curioussis

গৌড়ের শিলালিপি

গৌড় নগরীর নিকটবর্তী এলাকাসমূহেও গড়ে উঠেছিল কয়েকটি বড় শহর। সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেন (১১৭৯-১২০৬) গৌড়ের কাছে নির্মাণ করেন লক্ষণাবর্তী শহর। গৌড়ের প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দূরে নির্মিত হয়েছিল পান্ডুয়া নগরী। দেশ বিভাগের আগে (১৯৪৭ খৃ.) গৌড় নগরী সম্পূর্ণভাবে মালদহ জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বর্তমানেও গ্যেড় নগরীর অধিকাংশ এলাকা ভারতের মালদহ জেলার অন্তর্ভূক্ত হলেও এর কিছু অংশ চাপাই নওয়াবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানায় বিদ্যমান। চাপাইনওয়াবগঞ্জ জেলার ২০ কি.মি. উত্তরে গৌড় নগরীর প্রান্তসীমা অবস্থিত। প্রাচীন অনেক পর্যটক গৌড় নগরী পরিভ্রমণ করে তৎকালীন গৌড় নগরী সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বিখ্যাত চীনা পন্ডিত ও পরিব্রাজক ফা হিয়েন (৩৫৮-৪৩৫ খ্রি.) গৌড়  পরিদর্শন করে গেছে ৪০০ খ্রি. পরবর্তিকালে।

প্রাচীন জনপদ গৌড়, Stay Curioussis

গৌড়ের ধ্বংসপ্রাপ্ত মুসলমানী স্থাপত্য দাখিল দরওয়াজার লিথোগ্রাফ, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্ব।

এছাড়া হোসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮ খ্রি.) এর রাজত্বকালে পর্তুগীজ পন্ডিত জো আঁ দে বারাস এবং রাজা গনেশের মুসলিম পুত্র জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহ এর আমলে চীন সম্রাটের দূত ফেই সিন গৌড় ভ্রমণ করেন। তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সেকালে গৌড় ছিল একটি সমৃদ্ধশালী নগরী। সেকালে এই নগরীর একটি বড় অংশ সুনির্মিত ও সুরম্য প্রাসাদে পূর্ণ ছিল। পরবর্তিকালে এই সব ইমারত ভেঙ্গেছে, গড়েছে। পুরাতন ইমারতের ইট-পাথর ব্যবহৃত হয়েছে নতুন ইমারতে।

প্রাচীন জনপদ গৌড়, Stay Curioussis

গৌড়ের ঐতিহাসিক প্রবেশদ্বার, লুকোচুরি দরওয়াজা

ষোল শতকে দিল্লীর মোঘল সম্রাট হুমায়ন গৌড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এর নামকরণ করেন জান্নাতাবাদ। উইলিয়াম হেজেস (১৮৮৯-৯৮) নামে একজন পশ্চিমা ভ্রমণকারী তাঁর বর্ণনায় বলেছেন, ইউরোপের বহু বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের বহু বিখ্যাত অন্তঃপুর হতেও গৌড় নগরী অনেক বেশী সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছিল।

১৮৯৬ সালে পরিত্যক্ত শহরটিতে এক ভয়াবহ বন্যা এমনভাবে বিধ্বস্ত করে দেয় যে, গোটা শহরের কোথাও আর বসবাসের উপযোগী ঘরবাড়ি অবশিষ্ট ছিল না। এছাড়াও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে গৌড়ের স্থাপনাগুলোর নানা অংশ ব্যাপকভাবে লুন্ঠিত হয়। তাই গৌড়ের বেশীরভাগ পুরাতন স্থাপনাগুলোর সন্ধান আজ আর পাওয়া যায় না। গৌড় নগরীতে মোঘল শাসনের বিস্তার পর্ব পর্যন্ত বেশ কিছু স্থাপনা নির্মিত হয়েছিলো। এসবের মধ্যে খানিয়াদীঘি মসজিদ, ধুনিচক মসজিদ, দারাসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা, ছোট সোনা মসজিদ, শাহ নেয়ামত উল্লাহ ইমারতগুচ্ছ, বালিয়াদীঘি, জাহাজঘাটা, সওদাগর বাদশাহর ভিটা, ঘোষপুর ঢিবি, দুধপুকুর ভিটা, যোগীর পুকুর ঢিবি, নীলকোঠি ভিটা, চন্ডীপীরের দরগাহ, পুরাতন পুল, তষ্কতলা দীঘি মসজিদ, খওজখিলা দীঘি, রহমত মোল্লার ঢিবি, বানিয়াবড়ি কামালপুর ঈদগাহ ঢিবি। এগুলোর প্রায় অধিকাংশই পনের-ষোল শতকের স্থাপনা। এসব ছাড়াও রয়েছে গিয়াসপুকুর ঢিবি, ছত্রপুকুর ঢিবি, পঞ্চায়েতের দীঘি ঢিবি, মসলতখানের দীঘি, নাজিরখানের দীঘি, সাতঘরিয়া গড়, কোতোয়াল দীঘি টাকশাল দীঘি। তবে এসবের অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা সময়কাল নিরূপণের মতো কোনো তথ্য এ যাবৎ পাওয়া যায় নি।

প্রাচীন জনপদ গৌড়, Stay Curioussis

ছোট সোনা মসজিদের সম্মুখ প্রান্ত

তবে গৌড়ের গুরুত্বপূর্ণ কীর্তিসমূহ সম্বন্ধে সামান্য আলোচনা না করলেই নয়। গৌড় নগরীর বাংলাদেশ অংশে ফিরোজাবাদে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে নির্মিত ‘ছোট সোনা মসজিদ’ গৌড়ের এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি। ছোট সোনা মসজিদের দেড় কি.মি. উত্তরে দরসবাড়ি মাদ্রাসা ও মসজিদ। এছাড়া গৌড়ে এখনও নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ নির্মিত ১৫২৬ সালের বড় সোনা মসজিদ, ১৪২৫ সালে বারবক শাহ নির্মিত গৌড়ের গেটওয়ে বা দাখিল দরজা, সুলতান সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ নির্মিত ফিােজ মিনার, শাহসুজা নির্মিত লুকোচুরি দরজা, ১৫৩১ সালে সুলতান নসরত শাহ নির্মিত মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর পদচিহ্ন সম্বলিত কদম-ই-রসুল মসজিদ ইত্যাদি রয়েছে।  তত্বাবধানের অভাবে প্রাচীন মুসলমান শাসকদের রাজধানী গৌড়ের পুরাকীর্তিগুলো ধ্বংস হতে বসেছে। বহু নিদর্শন কালের বিবর্তনে ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।

প্রাচীন জনপদ গৌড়, Stay Curioussis

বড় সোনা মসজিদ