১৮৩০ এর দশকের কথা। কলকাতার জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের তখন ব্যবসায়িক অবস্থা একদম রমরমা। পৈত্রিক সূত্রে বিরাহিমপুর পরগনার জমিদারি তো আগেই ছিল। এরপর বিভিন্ন কোম্পানিতে অংশিদারিত্ব আর দেওয়ানির সুযোগে নিজ ব্যাংক, কার এন্ড টেগোর কোম্পানি আর স্টিমার কোম্পানিও চালু করলেন। লাভের টাকায় তখন কিনতে থাকলেন রাজশাহীর কালিগ্রাম, পাবনার শাহজাদপুরের মত একের পর একের জমিদারি। মুশকিল হল, নতুন এই সবগুলো জমিদারিই পড়েছে নদীনালা, খালবিলে ঘেরা পূর্ববঙ্গে! রেল, মটরগাড়ি তখনও এদেশে এসে পৌঁছায়নি, তাই নৌকা ছাড়া সেসব তদারকির উপায় নেই। তবে শুধু নৌকা হলেই তো চলবে না। তাঁর দরকার বজরা, যাকে ইংরেজিতে বলে হাউজবোট। দূরের যাত্রায় এর চেয়ে আরামদায়ক আর কিছু হতে পারে না। এর খোল হয় চওড়া, ভেতরে থাকে প্রশস্ত জায়গা। ভারী, কিন্তু অগভীর জলে এদেরকে ধীরে ধীরে চালিয়ে নেয়া যায়। এধরনের বজরা তৈরির জন্য তখন ঢাকা সবার প্রথম পছন্দ। দ্বারকানাথ ঠাকুরও তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে এবার ঢাকাই কারিগর দিয়েই তৈরি করবেন তাঁর বজরা।

ঢাকার নৌশিল্পের খ্যাতি বহু পুরাতন। মুঘল আমলেও ঢাকার নৌশিল্পের উন্নতি দেখে ফরাসী পর্যটক তাভের্নিয়ের মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবে কালের স্রোতে ইংরেজদের হাতে দেশ চলে যাওয়ায় নৌশিল্পের ধরনে পরিবর্তন আসে। দ্বারকানাথ যে সময়ে নৌকা বানাবার উদ্যোগ নেন, সেসময়ে ঢাকায় কারিগররা রণতরীর পরিবর্তে মালবাহী নৌকা আর বিলাসবহুল বজরা তৈরিতে হাত পাকিয়েছেন। নব্য ধনী আর জমিদারেরা তখন বিলাসব্যসনে মত্ত। কে কার থেকে বড় আর আয়েসী বজরা তৈরি করাতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। বাহারি এসব বজরা নিয়ে তাঁরা রীতিমত গর্ববোধ করতেন। দ্বারকানাথও পিছিয়ে থাকতে রাজী নন। তিনিও নিজের বজরাকে চাহিদা মোতাবেক সাজিয়ে নিলেন। বজরার ভেতরেই দু’টি বড় বড় কক্ষ, তাছাড়া খাবার ঘর, আরও দু’টা ছোট ছোট কক্ষ। ঢাকা থেকে তৈরি হয়ে বজরা চলল কলকাতার পথে। হুগলি নদীর ধারে বাঁধা থাকল সেই ঢাকাই বজরা। তবে দ্বারকানাথ ঠাকুর এই বজরা বেশিদিন ব্যবহার করতে পারলেন না। ১৮৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিলাতে পরলোকগমন করলেন দ্বারকানাথ। পিতার মৃত্যসংবাদ যখন পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এসে পৌঁছুলো তখন তিনি পিতার নির্মিত সেই বজরায়, তিন পুত্র নিয়ে গঙ্গায় বেড়াতে বেরিয়েছেন। এই বজরা ছিল মহর্ষির অতিপ্রিয়। এতে চেপে একবার বেনারসও চলে গিয়েছিলেন। উনিশ শতকের শেষভাগে পূর্ববঙ্গের এসব জমিদারির দায়িত্ব বর্তালো মহর্ষির ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই নদীময় বাংলার পরগনাগুলোয় ভ্রমণের জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে বজরাটির মালিক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া সব উপহারের মধ্যে এই বজরা হয়ে উঠল সবচেয়ে মূল্যবান, কবির মনে দখল করে নিল এক বিশেষ জায়গা। শিলাইদহের পদ্মায় ভাসিয়ে দিয়ে কবি এ বজরার নাম দিলেন ‘পদ্মা’।

আলোকচিত্রঃ পদ্মা নদীতে ‘পদ্মা’ বোট, উৎস – স্মৃতিকথা, মীরা দেবী, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ।

জন্মের কয়েক দশক আগে তৈরি ‘পদ্মা’ বোটটি রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দিল আবহমান বাংলার গভীরে। বছরের পর বছর ‘পদ্মা’য় চেপে তিনি দেখে ফিরলেন বাংলার রূপ, পল্লীজীবন। খালি চোখে যা দেখলেন তার সাথে মিশে গেল তাঁর কল্পনা। কবি রচিত ছিন্নপত্রের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে স্থায়িত্ব পেল ঢাকাই বজরা ‘পদ্মা’ বোট। জমিদারি দেখাশোনা তো ছিলই; কিন্তু যৌবনে লেখালেখির জন্য কাঙ্ক্ষিত নির্জনতার সুযোগ তৈরি করে দিল ‘পদ্মা’। কখনো কখনো পরিবার নিয়েও বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। কবির পুত্র-কন্যার স্মৃতিকথায় তাই বার বার এসেছে এই বজরার কথা। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন- “ হাউজবোটে ঢুকে গেলেই সবকিছু বাড়ির মত। এর ভিতরকার চমৎকার কারুকাজ আর পারিবারিক পরিবেশে আমি স্বস্তি বোধ করতাম……………হাউজবোট পদ্মা বাবার যথেষ্ট কাজে লেগেছে। পৃথিবী যখন তাঁর শান্তি কেড়ে নিয়েছে তখন তাঁকে আশ্রয় ও শান্তি দিয়েছে।“ ছোট মেয়ে মীরার চোখে- “একসময় বাবা শিলাইদহে পদ্মার চরে আমাদের নিয়ে ‘পদ্মা’ নামে বজরায় ছিলেন। তখন আচার্য জগদীশচন্দ্র ও নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায় প্রায়ই শিলাইদহ যেতেন। তাঁরা পদ্মার উপর বোটে থাকতে খুব ভালবাসতেন। আমাদের দু’টি বজরা ছিল, তাই তাঁরা গেলে কোনো অসুবিধা হত না। একটি বোটের নাম আগেই উল্লেখ করেছি, অপরটির নাম ছিল ‘আত্রাই’। আমাদের আর একটি পরগনাতে আত্রাই নদী ছিল, তার থেকে ‘আত্রাই’ নামকরণ হয়েছিল। মা তখন নতুন নতুন রান্নায় ব্যস্ত।“

সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলত লেখালেখি, দু’কূল ছাপিয়ে এগিয়ে যেত পদ্মা, জেগে উঠত চর, কচি সবুজ রবিশস্য উঁকি দিত, সেই শস্যক্ষেতে খেলে যেত মেঘ, রৌদ্র-ছায়া, আসতো বর্ষা, বছর ঘুরে বসন্ত। এসবকিছু জুগিয়ে যেত তাঁর লেখার রসদ। সন্ধ্যা নেমে এলে গিয়ে বসতেন ডেকের উপর। পদ্মার উপরের অবারিত আকাশে তখন একটি একটি করে তারা ফুটে উঠছে, আর কবিকণ্ঠে মিলিয়ে যাচ্ছে- “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা……।” উনিশ শতকের শেষভাগে ‘পদ্মা’ রবীন্দ্রনাথকে যে তৃপ্তি দিয়েছিল তা তিনি কখনো ভুলেননি। বহু বছর পর ১৯২৬ সালে ঢাকা এসেও অল্প ক’দিনের অবস্থানের জন্য তাই বেছে নিয়েছিলেন ঢাকার নবাবদের হাউজবোট ‘তুরাগ’কে। সে’টা ভিন্ন গল্প।

#আমার_শহর #রবীন্দ্রনাথ১৬০