“প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স,
এবার হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না। তাই তেমনভাবে লেখালেখিও আর করা হয়ে উঠছে না। তাই তোমার কাছে লেখা চিঠিতে আমার লেখাগুলোর ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলো হয়তো কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে। জোর করে এর নতুন সংস্করণ বের করার দরকার নেই। যদি হারিয়ে না যায় হয়তো তাতে আমার করার কিছুই থাকবে না। আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলোর ব্যাপারে বলছি, সবগুলো পাণ্ডুলিপি আর নোটবুক তুমি পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলোও সংগ্রহ করে পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ সেগুলো যেন পড়ে না দ্যাখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইলো। তবে তুমি সে অনুরোধের বাইরে। চিঠি পাওয়ার সাথে সাথেই হাতের কাছে থাকা আমার লেখার সবকয়টি পাতা পুড়িয়ে দিও। এই ব্যাপারে এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ।
– ফ্রান্‌ৎস”
 
ফ্রান্‌ৎস কাফকা, একজন জার্মান ভাষার ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্প লেখক। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে শেক্সপিয়ারের পরে সবচেয়ে বেশি চর্চিত ব্যক্তিত্ব বলে তাঁকে গণ্য করা হয়। সমালোচকরা বলেন কাফকার লেখা “বুঝছি কিন্তু বোঝাতে পারছি না গোছের একটা যন্ত্রণা জাগায় মনে।” খানিক স্বপ্ন (বলা ভাল, দুঃস্বপ্ন) ঘেঁষা একটা set up-এর মধ্যে দিয়ে কাফকা প্রায় প্রতিটি লেখায় আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের ক্ষতগুলিকে উস্কে দেন। বিষয়গুলি এতটাই দৈনন্দিন, যে আমরা মোটা দাগে ‘এই তো জীবন’ বলে পাশ কাটিয়ে চলি। সাধারণত আপনি আমি যে বিষয়গুলিকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রেখে মুখ ফিরিয়ে থাকি কাফকা প্রতিনিয়ত তাঁর টেক্সটে সেই স্পর্শকাতর জায়গাতেই ‘প্রশ্নাঘাত’ করছেন। কাফকার নিজস্বতা সাহিত্যে এক নতুন ধারার জন্ম দেয়, তাঁর অনুরাগীরা যাকে Kafkaesque (কাফকায়েস্ক) বা ‘কাফকার মত’ বলেন। শোনা যায় তিনি তাঁর লেখার নব্বই শতাংশই পুড়িয়ে ফেলেছেন, বাকিটা বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে পুড়িয়ে ফেলতে অনুরোধ করেন। ভেবে দেখুন, ব্রড বন্ধুর কথা রাখলে বিশ্বসাহিত্যের কি অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারত!
এবার আসি কাফকা হয়ে ওঠার গল্পে। ১৮৮৩-র অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির প্রাগ শহরে (বর্তমানে যা চেক রিপাবলিকের অন্তর্গত), এক মধ্যবিত্ত জার্মান-ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শুরু থেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি কারণ দুজনেই ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। ছোট থেকেই বিষাদ আর একাকীত্ব তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী করে তোলে। বাবার প্রভাব তাঁর উপর সারাজীবন ছিল। পরবর্তীকালে এক চিঠিতে তিনি লেখেন “বাবা আমার পৃথিবীর পুরো মানচিত্রের উপর শুয়ে ছিলেন। তিনি আমার জন্য খুব কম জায়গাই রেখেছিলেন।”
তাঁর প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় ১৮৮৯ নাগাদ, জার্মান বয়েস এলিমেন্টারি স্কুলে। তারপর জার্মান মাধ্যমিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে ১৯০১-এ কার্ল ফার্দিনান্দ ইউনিভার্সিটিতে রসায়ন নিয়ে ভর্তি হন। লেখক হওয়ার তাঁর শখ সেসময় থেকেই। তবে বাবার চোখে সেই স্বপ্ন দেখা যেন কোন কঠিন পাপ কাজ করার মত। ফলে স্ট্রিম চেঞ্জ করার অনুমতি পেলেও বাবার কথায় আইন নিয়ে পড়া চালু হয়। এর দুটো কারণ ছিল। বাবার চোখে, আইনে ডিগ্রি থাকলে সেই সময় ভালো চাকরি জোটানো সহজ ব্যাপার; আর কাফকার কাছে সেটা শুধুই একটা দীর্ঘমেয়াদি কোর্স যেটা নিলে সে অনেকটা সময় বাবার কবলের বাইরে থাকতে সুযোগ পাবে এবং নিজের পছন্দের বিষয়গুলিতে নিজের মত করে সময় দিতে পারবে। এখানেই তাঁর নিয়মিত লেখালিখির শুরু। এখানেই আবার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের সঙ্গে পরিচয়।

Hermann and Julie Kafka Source: Wikipedia

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পড় প্রথমে ইটালিয়ান বীমা কোম্পানি ‘Association General’-তে চাকরি নেন। অল্প সময় পরে সেটা ছেড়ে দেন, কারণ সেখানে কাজের সময় একটু বেশি ছিল আর তিনি বাড়ি ফিরে নিজের জন্য সময় বের করতে পারছিলেন না। এর পর ‘Workers Accident insurance Institute for the Kingdom of Bohemia’-তে দৈনিক ৬ ঘন্টার কাজ নেন। ফলে লেখালিখির সময় ও বেরিয়ে যেত। ১৯০৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Betrachtung’ (contemplation বা মনোনিবেশ) নামক আটটি ছোট গল্পের কালেকশন।
এরপর ১৯১২-তে প্রকাশ পায় ‘Das Vrteil’ (রায়), এটি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলির একটি। কাফকার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখাগুলির একটি হল ‘মেটামরফোসিস’ যা প্রকাশ পায় ১৯১৫-তে। কাফকা জীবনে বহু নারীর সংস্পর্শে এলেও তিনি বিয়ে করেননি। প্রথম প্রেমিকা ফেলিস (Felice Bower) এর সঙ্গে দুবার এনগেজমেন্ট হয়, তবে তা অসফল রয়ে যায়। কাফকার মৃত্যুর পর তাঁদের মধ্যেকার অন্তত পাঁচশ চিঠি পাওয়া যায়, যা বই আকারে প্রকাশ হয় (Letters to Fellie)। ১৯১৭-তে তাঁর যক্ষা ধরা পড়ে। সেসময় ‘The Trial’ লেখা চলছে। চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কাফকার লেখা আধুনিক জীবনযাত্রার যন্ত্রণা তুলে ধরে। তাঁর নায়কেরা সামাজিক ও আমলাতান্ত্রিক শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরাজিত। তাঁর চরিত্ররা প্রতিনিয়ত ব্যর্থতা, অপূর্ণতার শিকার হয়। তাদের এমন এক পৃথিবীতে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় যেখানে না আছে অনুভূতি, না আছে আত্মীয়তা। তাঁর দোষারোপ শুধুমাত্র হাস্যকর, জটিল, আমলাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ও যারা নিজের সারাটা জীবন কোন এক বড় যন্ত্রের ছোট্ট একটা নাটবল্টু হয়ে অসারে অতিবাহিত করে চলেছে।
১৯১৯-এ, অর্থাৎ মৃত্যুর ঠিক ৫ বছর আগে বাবার বিরুদ্ধে প্রথমবার কথা বলার সাহস যোগান এবং ৪৭ পাতার একটা লম্বা চিঠি লিখে ফ্যালেন (যা ‘Brief an den Vater’ বা বাবাকে লেখা চিঠি নামে পরে প্রকাশিত হয়) যেখানে বাবার লোভী স্বৈরাচারী দিকটাই বাবাকে দেখানোর চেষ্টা করেন যেটার নিচে তিনি সারাজীবন চাপা পড়ে ছিলেন। তবে সে চিঠি আর বাবাকে পড়ানো হয়ে ওঠেনি, কারণ তাঁর মা চাননি সেই চিঠি বাবার কাছে যাক।
কাফকার বহুল চর্চিত নাম মূলত তিনটি নভেল এর উপর ভিত্তি করে― ‘The trial’, ‘The castle’ এবং ‘America’ যার প্রত্যেকটিই অসম্পূর্ণ এবং তিনটিই প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। কারণ? “ব্রড কথা রাখেনি।”
১৯২৪ সালের ৩রা জুন তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর কাজের স্বীকৃতি পাওয়া শুরু। মোটামুটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কালের মধ্যেই ফ্রান্‌ৎস কাফকা জার্মান সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। যাইহোক, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেকার হেরে যাওয়া অংশটুকুতে কাফকা এখনো বেঁচে আছেন।
লেখা – Sahil
ডিজাইন – Ramesh
লেখাটি প্যারালাল ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া