৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পতন হয় ইতিহাস বিখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যের। তবে রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ থেকেই জন্ম নেয় নতুন এক রোমান সভ্যতা যা পরবর্তী এক হাজার বছর ব্যাপী ইউরোপের ইতিহাস দখল করে বসেছিল। গল্পটি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই নয়া রোমান অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রথম বাইজান্টাইন সম্রাট কনস্টাইন্ট ৩৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। প্রাচীন গ্রিক কলোনী বাইজান্টিয়ামে নতুন রোম নামক বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন তিনি যা ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত শিল্প, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি এবং ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাফার অঞ্চল হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল। ১৪৫৩ সালে অটোমান তার্কের হাতে বাইজান্টাইন রাজধানী কন্সটান্টিনোপলের পতন ঘটলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তি ঘটে ভুবনবিখ্যাত এই সাম্রাজ্যের।
বাইজান্টাইন শব্দটি এসেছে বাইজান্টিয়াম থেকে। বাইজান্টিয়ান ছিল একটি প্রাচীন গ্রিক কলোনি। যেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাইজোস নামের এক লোক। বাইজান্টিয়াম ভৌগোলিকভাবে বসফরাস প্রণালির ইউরোপীয় অংশে পড়েছিল। ফলে ব্যবসার রুট হিসেবে এই জায়গাটির গুরুত্ব ছিল বেশি। এছাড়া ভূকৌশলগত দিক থেকেও অঞ্চলটির তাৎপর্য ছিল ব্যাপক।
১৮০ থেকে ১৯২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অবিভক্ত রোমান সম্রাট ছিলেন লুসিয়াস অরেলিয়াস কমোডাস। বিখ্যাত হলিউড সিনেমা দ্য গ্ল্যাডিয়েটরের সেই কমোডাস। তার অযোগ্য শাসনে রোম (রোমান রাজধানী) পতনের দিকে ধাবিত হয়। ১৯২ খ্রিষ্টাব্দে কমোডাসকে হত্যা করা হয় । রোমের সিংহাসন দাবির প্রশ্নে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পার্টিনাক্স, ডিডিয়াস জুলিয়ানাস, পেসেনিয়াস নাইজার, ক্লডিয়াস আলবিনাস ও সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস ছিলেন এই গৃহযুদ্ধের মূল চরিত্র। যুদ্ধে জয়ী হন সেপ্টিমিয়াস। ইতিহাসে এই গৃহযুদ্ধকে বলা হয় ‘Year of the Five Emperors’।
২২২ থেকে ২৩৫ সাল পর্যন্ত রোমের শাসক ছিলেন সেভেরাস আলেকজান্ডার। তার মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্য নতুন করে অস্থিরতার স্বীকার হয়। প্লেগ মহামারীর প্রকোপ, ভিনদেশীদের আক্রমণ ও নাজুক অর্থনীতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল রোমান সাম্রাজ্য। পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রোমান আর্মির জেনারেলরাও জড়িয়ে পড়েছিলেন ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে।
২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমের মসনদে আসীন হন ডায়োক্লেটিয়ান। তিনি সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসেন। তিনি রোমকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করেন এবং প্রতিটি ভাগে পৃথক শাসকের নিয়ম প্রবর্তন করেন। কিন্তু গৃহযুদ্ধই ছিল যেন রোমান সাম্রাজ্যের নিয়তি। ফের শুরু হয় ক্ষমতার প্রশ্নে যুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন নতুন এক সম্রাট। ম্যাক্সেন্টিয়াস ও লাইসিনিয়াসকে পরাজিত করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান কনস্টাইন্ট, সম্রাট কনস্টাইন্ট দ্য গ্রেট।
সম্রাট প্রথম কনস্টাইন রোমান সাম্রাজ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করতে চাইলেন। আর এজন্য তিনি একটি জায়গা খুঁজছিলেন যেটি প্রতিরক্ষার দিক থেকে সংবেদনশীল হবে না। তিনি পছন্দ করলেন বাইজান্টিয়ামকে। ৩৩০ সালের দিকে গড়লেন নতুন এক শহর। শহরটির নাম দেয়া হলো সম্রাটের নামানুসারে,কনস্টান্টিনোপল। এই শহরকে কেন্দ্র করেই উদ্বোধন হয় পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস। পশ্চিমাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য নামে গড়ে উঠে রোমান সভ্যতার নতুন ভৌগোলিক সীমারেখা। পূর্বাঞ্চলীয় সাম্রাজ্য পরিচিতি পায় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য নামে। পশ্চিমের সাম্রাজ্য জার্মান সাম্রাজ্যবাদী ভিসিগথ এবং সর্বশেষ ইতালির রাজা অডোসারের হাতে শেষ রোমান সম্রাট রোমিউলাস অগাস্টিয়াসের পতন হয়। ফলে ৪৭৬ সালে পশ্চিমাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত ঘটে। কিন্তু এই শেষের গল্প থেকেই শুরুর ইতিহাস রচিত হয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের।
প্রথম জাস্টিনিয়ন:
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রথম মহান শাসক ছিলেন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ন। ৫২৭ সালে তিনি সিংহাসনে আরোহন করেন এবং ৫৬৫ সালে মৃত্যু পর্যন্ত শাসনে অধিষ্ঠান থাকেন। তার আমলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমার সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ ঘটে। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বেশিরভাগ ভূমি, উত্তর আফ্রিকা এমনকি পতন হওয়া পশ্চিমের রোমান সাম্রাজ্যের কিছু এলাকাও তিনি অধিকারে নিয়ে এসেছিলেন। জাস্টিনিয়নের সময় রোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত সব স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল হাজিয়া সোফা গির্জা যা বর্তমানে তুরস্কে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্রাট জাস্টিনিয়ন রোমান আইনেরও সংস্কার করেন এবং নতুন ধারার বাইজান্টাইন আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের উপর ভর করেই আধুনিক ‘রাষ্ট্র’ ধারণাটি রূপ লাভ করে। জাস্টিনিয়নের মৃত্যুর পর দেখা গেল ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে বাইজান্টাইন।
পূর্বাঞ্চলীয় রোমান প্রদেশ ভৌগোলিকভাবে ছিল বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে। বহিরাগত হুমকির সম্ভাবনা একেবারে ছিল না বললেই চলে। রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বসফরাস প্রণালির তীরে হওয়ায় রাজধানী শহরটির প্রতিরক্ষা বূহ্য ভেদ করা ছিল দুঃসাধ্য। বাইরের হুমকি না থাকায় নতুন সাম্রাজ্যটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। ফলে একটি উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি সেখানে চালু হয়। এছাড়া সম্পদের দিক থেকেও অঞ্চলটি ছিল প্রাচুর্যপূর্ণ। মধ্যযুগের প্রাথমিক সময়কালের অন্যান্য সাম্রাজ্যের তুলনায় তাই বাইজান্টাইন হয়ে উঠেছিল অদ্বিতীয়। সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সম্পদের উপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ থাকায় সেই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে এক সুসংগঠিত সেনাদল গঠন করতে পেরেছিল বাইজান্টাইন। যারা সবসময় ভিনদেশী আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে মুখিয়ে থাকত।
বাইজান্টাইন সংস্কৃতি:
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য চালিত হতো রোমান আইন দ্বারা। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানও ছিল রোমান ঘরানার। সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষাও ছিল ল্যাটিন। তবে গ্রিক ভাষাই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সাধারণ জনগণ গ্রিক ভাষায়ই কথা বলত। ছাত্ররা গ্রিক ইতিহাস, সাহিত্যের উপরই শিক্ষা নিতো। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের জনগণ নিজেদের রোমান মনে করলেও শতাব্দীব্যাপী সাংস্কৃতিক উপাদানের গ্রহণ ও বর্জনে অন্যান্য সংস্কৃতির প্রভাব তৈরি হয়। গ্রিক ও খ্রিস্টান সংস্কৃতির সম্মীলনে এক স্বতন্ত্র বাইজান্টাইন সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এছাড়া আর্মেনিয়ান, পারস্য, ল্যাটিন, কপ্টিক এমনকি পরবর্তীতে ইসলামী সংস্কৃতিও বাইজান্টাইন সংস্কৃতির উপর প্রভাব কায়েম করেছিল। রাজধানী কনস্টান্টিনোপল ছিল বৈচিত্র্যময় এক শহর৷ নানান জাতিসত্ত্বার বাস ছিল এই শহরে। ভিনদেশী ব্যবসায়ীদের উপর বাড়তি কর আরোপ করা হতো না। যা ঐসময়ে অনন্য এক ব্যবস্থা ছিল। বাইজান্টাইন বণিকরা ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর, লোহিত সাগর, ভারত মহাসাগর জুড়ে নিজেদের ব্যবসা বিস্তৃত করেছিল। ৮৬৭ থেকে ১০৫৬ সময়কাল বাইজান্টাইন নবজাগরণ নামে পরিচিত। এ সময় শিল্প ও স্থাপত্যে এক নতুন ধারার সূচনা হয়। মিশর থেকে রাশিয়া পর্যন্ত নির্মিত ধর্মীয় স্থাপনায় বাইজান্টাইন রীতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। বাইজান্টাইন শিল্পীরা প্রাচীন গ্রিক শিল্পের প্রাকৃতিক ঘরানা ও জটিল টেকনিক এবং রোমান চিত্রকলার সাথে খ্রিস্টান বিষয়বস্তু থেকে উপাদান গ্রহণ করেছিলেন। এই সময়ে অংকিত বাইজান্টাইন চিত্র পরবর্তীতে ইতালির রেঁনেসায় প্রভাব রেখেছিল। ১৪৫৩ সালে মুসলিমদের হাতে কনস্টান্টিনোপল পতনের পরে বাইজান্টাইন শিল্পী, সাহিত্যিক, স্থপতি, বিজ্ঞানী, দার্শনিকরা দেশান্তরী হয়ে পশ্চিম ইউরোপে গমন করলে ইউরোপ প্রত্যক্ষ করে আজকের এনলাইটমেন্ট।
বাইজান্টাইন মূর্তিভঙ্গ আন্দোলন:
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। দ্বন্দ্বটি ছিল ভাস্কর্য নিয়ে। ভাস্কর্য থাকবে কি থাকবে না এই প্রশ্নে এক আন্দোলনের জন্ম দেয়। ইতিহাসে যা পরিচিত বাইজান্টাইন আইকোনক্লাজম বা মূর্তিভঙ্গ আন্দোলন।
সপ্তম শতকে শুরু হয় এই দ্বন্দ্ব। ভাস্কর্য নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি তুলে ইস্টার্ন চার্চ (ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ, অরিয়েন্টাল অর্থোডক্স চার্চ, অ্যাসাইরিয়ান চার্চ অব দ্য ইস্ট ও ইস্টার্ন ক্যাথলিক চার্চগুলো)। ৭২৬-৭৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলো প্রথম পর্যায়ে পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ৮১৪-৮৪২ সাল পর্যন্ত মূর্তিভঙ্গ আন্দোলনের নেতৃত্বে দেন তৎকালীন বাইজান্টাইন সম্রাট তৃতীয় লিও। সেই সময় অনেক ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়। ভাস্করদেরও নির্যাতন করা হয়। কিন্তু ওয়েস্টার্ন চার্চ বা রোমান ক্যাথলিক চার্চ ভাস্কর্যের ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়া শুরু করে। অবশেষে ৮৪৩ সালে সম্রাট তৃতীয় মাইকেলের নেতৃত্বাধীন এক চার্চ কাউন্সিল ভাস্কর্যের পক্ষে রায় দেয়। ফলে মূর্তিভঙ্গ আন্দোলনের সমাপ্তি হয়।
পতন:
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের ঘন্টা বাজে ক্রুসেডের সময়ে। এসময় বাইজান্টাইন ও পশ্চিমা খ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১২০৪ সালের চতুর্থ ক্রুসেডে কনস্টান্টিনোপল লুট করা হয়। সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। রাজধানী কনস্টান্টিনোপল থেকে মানুষ পালিয়ে নিকিয়ায় অভিবাসী হয়। ১৪৫৩ সালে এমন এক সময় অটোমান তুর্কিদের হাতে পদানত হয় গর্বিত বাইজান্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল। ফলে এখানেই যবনিকাপাত হয় ইতিহাসের গল্প বলে বেড়ানো এই আলোচিত সমালোচিত বাইজান্টিয়াম। তবে পতনের পরও বাইজান্টাইন সংস্কৃতি ও ধর্ম ইউরোপে আলো জ্বেলেছিল যুগের পর যুগ৷ এই বাইজান্টাইন শিল্পী, সাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবীদের হাতেই বর্ণিল হয়েছিল ইতালির রেঁনেসা। ইতিহাস তাই কোন দ্বিধা ছাড়াই বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্যসূত্র:
1. Byzantine Empire
2. Byzantine Empire: Map, history and facts
3. Byzantine Empire