এ পৃথিবীতে কত কিছুই ঘটে-বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। প্রখর রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক মধ্যাহ্ন। মার্তণ্ডদেব প্রচণ্ড তেজে তাপ বিকিরণ করে চলেছেন। রোদের তেজে সেদিন চারদিক যেন ঝলসে যাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ফল্স্ উপসাগরের তীরবর্তী এক অন্তরীপ-প্রতিম দেশ। সমুদ্রের পানির উপর প্রতিফলিত তির্যক রোদের জন্য যেন চারদিক ঝলসে উঠছে। দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করতে রীতিমত কষ্টই হচ্ছিল।সনটা ছিল ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাস। অগ্নিক্ষরা রৌদ্র তাপে তীরের বালুকারাশি উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হয়ে উঠছে। আর গরমে অস্থির হয়ে গোটা ষাটেক লোক সামান্য একটু আরামের আশায় আলস্য ভরে পানিতে শরীর ডুবিয়ে দিয়ে বসে আছে।
হঠাৎ তারা কেমন যেন সচকিত হয়ে উঠলো। তারা সহসা লক্ষ্য করলো-ঝলসানো রোদের মধ্যদিয়ে পূর্ণ সাজ সজ্জায় সজ্জিত হয়ে ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া ম্যান ’ নামে একটি জাহাজ যেন পাল তুলে দিয়ে তীর বেগে তীরভূমির দিকে এগিয়ে আসছে, এ ধরনের অভিনব সাজে সজ্জিত জাহাজ বহু শতাব্দী ধরে এই অন্তরীপের আশপাশ দিয়ে, ভেসে যেতে পূর্বে তো কেউ দেখেনি। যাদের নজরেই এই জাহাজটি এলো তারা একে অন্যকে ডেকে ডেকে জাহাজটি দেখাতে লাগলো। উত্তেজিত জনতা জাহাজটির বিস্ময়কর আঙ্গিকের আলোচনায় রীতিমত মূখর হয়ে উঠলো। সকলেরই জিজ্ঞাসা — কোথা থেকে — কোথা থেকে – এলো এই অভিনব জাহাজটি? এমন জাহাজতো এ যুগে কেউ দেখেনি!! সবাইকে আরো অবাক করে দিয়ে জাহাজটি ভোজবাজীর মত যেন সহসাই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, কোন রকম চিহ্নই যেন তার পেছনে ফেলে রেখে গেল না। পরদিনের সংবাদপত্রে নিম্ন প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হ’ল : “তার সবগুলো বিচিত্র পাল উড়িয়ে দিয়ে জাহাজটি স্বচ্ছন্দ গতিতে এগিয়ে আসছিল। যদিও লেশমাত্র বাতাসও তখন বইছিল না। মনে হচ্ছিল — জাহাজটি যেন মুইজেন বার্গের দিকেই এগিয়ে আসছিল।”
১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে বৃটিশ সাউথ আফ্রিকা অ্যানুয়েল পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হল,”ভৌতিক গতিসম্পন্ন সেই জাহাজটি দৃঢ়তার সঙ্গেই গ্লেন – কেয়ার্ণের তীর ভুমির দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো। তীর ভূমির লোকেরা আলস্য ত্যাগ করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। ঔৎসুক্য নিরশনের জন্য পরস্পরের মধ্যে আলোচনা চললো – কোথায়- কোথায় থেকে এই জাহাজের আগমন ঘটলো? এত বেগে চলারই বা কি কারণ ছিল? তার তীব্র গতিবেগ দেখে মনে হয় ষ্ট্র্যাণ্ড ফষ্টিনের বালুকারাশির মধ্যে নিজের ধ্বংস সাধনই যেন তার উদ্দেশ্য ছিল। লোকের উত্তেজনা যখন চরম পর্যায়ে পৌছালো – রহস্যময় জাহাজটি সকলকে রহস্যের আবর্তে ফেলে রেখে, সকলকে নির্বাক করেই যেন অর্ন্তহিত হল।”

আলবার্ট পিংকহাম রেডামের অঙ্কিত দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান সি. ১৮৮৭ (স্মিথসোনিয়াম আমেরিকান আর্ট মিউজিয়াম)

ভুতুরে জাহাজটির আবির্ভাবের ও তিরোভাবের পর দিন কতক জাহাজটিকে নিয়ে জোর আলোচনা চললো। জল্পনা-কল্পনার যেন আদি অন্ত নেই। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করলেন যে গ্রেনকোয়ার্ণের সমুদ্র তীরের লোকেরা নিশ্চয়ই কোন মরিচীকা দেখে থাকবে। হয়তো বা রহস্যময় জাহাজটি হাজার হাজার মাইল দূর দিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল – যার প্রতিচ্ছায়া রৌদ্র কিরণে প্রতিবিম্বিত হয়ে তাদের চোখের সামনে বাস্তব বলে প্রতিভাত হয়ে থাকবে।
যারা স্বচক্ষে এই জাহাজটিকে প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের যুক্তি হল – জাহাজের পাটাতন, হাল, জাহাজের পশ্চাৎভাগের উচ্চাংশ এমন কি জাহাজের দড়িদড়া-যা কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে—তার কোন কিছুই আজকালকার আধুনিক জাহাজের মত নয়। জাহাজটি নির্ভুল ভাবেই যেন সপ্তদশ শতাব্দীর আঙ্গিকে তাদের চোখের সামনে ভেসে এসেছিলো। এতগুলি লোক একই সঙ্গে এই যে একই জিনিস দেখলো সকলেই কি ভুল দেখতে পারে? দৃষ্টি বিভ্রমই কি সকলের একসঙ্গে হওয়া সম্ভব? তাদের দৃঢ় বিশ্বাস-এটি অবশ্যই সপ্তদশ শতাব্দীর কোন বাণিজ্য জাহাজ হবে!
ঐদিন যারা ঐ জাহাজটি দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন হেলেনী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সংশয়বাদী ও সন্দিগ্ধ চিত্ত লোকদের কথায় প্রতিবাদ করেন। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন “এদের যা খুশী বলতে দাও-এই জাহাজটি ফ্লাইং ডাচম্যান ছাড়া অন্য কিছুই নয়।”

বিখ্যাত কিংবদন্তী:
ওয়াগনার তার বিখ্যাত অপেরা, ‘ডার ফ্লাইজ্যাণ্ডি, হল্যাণ্ডার’ লিখবার বহু আগে ‘দি ফ্লাইং ডাচম্যান’ কিংবদন্তীটি বহু প্রজন্ম ধরে জগতের সকল নাবিকদের কাছেই পরিচিত ছিল। প্রাচীন নথিপত্র ঘেটে জানা যায় যে, ১৬৮০ খৃষ্টাব্দে ‘ডাচ ইষ্টইণ্ডিয়া ম্যান’ নামে একটি ডাচ জাহাজ এ্যামষ্টারড্যাম থেকে পূর্ব ভারতীয় ডাচ দ্বীপপুঞ্জের বাটাভিয়ার দিকে যাত্রা করেছিল।ভ্যাণ্ডারডেকেন ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। তিনি অত্যন্ত নির্ভীক চরিত্রের ছিলেন। নিত্য নতুন এ্যাডভেঞ্চার তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে চলতো। তার চরিত্রের এই গুণের জন্য তিনি সকলের কাছে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।
তার মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোন স্থানই ছিল না। সীমাহীন খ্যাতি যেন তাকে আরো মরীয়া করে তুলেছিল। তাছাড়া তিনি সত্যিই একজন দক্ষ নাবিক ছিলেন। সে যুগে জাহাজ মালিকেরা তাঁর তত্ত্বাবধানে জাহাজ ছেড়ে দিতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না। ভ্যাণ্ডারডেকেনও নিজেকে সমুদ্রে অভিজ্ঞ বলেই মনে করতেন। তার জন্য তিনি সম্ভবতঃ বেশ গর্বিতও ছিলেন। জাহাজের মাধ্যমে বাণিজ্য শেষে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন ঠিকই কিন্তু ফিরতি পথে সমুদ্র তীরবর্তী বন্দর সমূহের শুড়িথানায় তা অকাতরে ব্যয় করেও আসতেন।
ভ্যাণ্ডারডেকেন জাহাজ নিয়ে সমদ্রে ভাসলেন। দক্ষিণ দিকে ক্রান্তীয় সমুদ্রের উপর দিকে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। জাহাজের ক্রুগণ যথাযথ ভাবে নিজ নিজ কাজে নিয়োজিত। সবকিছুই সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হচ্ছে। চলতে চলতে জাহাজ যখন উত্তমাশা অন্তরীপের প্রায় কাছাকাছি এল-অকস্মাৎ একটি ক্রান্তীয় বলয়ে ঝড়ের সুত্রপাত হল। প্রচন্ড ঝড়ের বেগে জাহাজটির পাল গেল ছিঁড়ে। কেউ কিছু বুঝবার আগেই দমকা বাতাস এসে দড়িদড়াসহ পালগুলোকে কোথায় যে উড়িয়ে নিয়ে গেল! জাহাজের হাল গেল ভেঙ্গে-এভাবে ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে জাহাজটি খোলাম কুচির মতই যেন নিক্ষিপ্ত হতে থাকলো। দিনের পর দিন অতীত হতে থাকলো-এভাবে সপ্তাহও পার হয়ে গেল-সর্বনাশা ঝড় আর থামে না। অন্তরীপের দিকে জাহাজটিকে চালিত করার জন্য ক্যাপ্টেন প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। সকলে মিলে চেষ্টা করেও জাহাজের মাঝিমাল্লারা জাহাজটিকে তীরের দিকে নিয়ে যেতে পারলো না। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে তারা হাল ছেড়ে দিল। দক্ষিণ পূর্বের প্রচণ্ড ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিছু কি করা সম্ভব? নিয়তির হাতছানিতে তীর ভূমি পেছনে ফেলে জাহাজটি সেই কোথায় যে নিরুদিষ্ট হয়ে গেল!
কিংবদন্তী বলে –ভ্যাণ্ডারডেকেন নাকি রাগে ফুসতে লাগলেন। রাগ ক্রমাগত চড়তে লাগলো। তার নৌবিদ্যার সব রকমের কৌশল ও দক্ষতার প্রয়োগ করেও জাহাজটিকে তিনি তীরের দিকে নিতে না পারাই তার রাগের এই কারণ।
ভ্যাণ্ডারডেকেনের এই মানসিক উন্মত্ততার সুযোগ নিয়ে শয়তান নাকি তাকে স্বপ্নে দেখা দেয়। শত চেষ্টা সত্ত্বেও যেহেতু ঈশ্বর তাকে আন্তরীপে পৌছাবার সুযোগ দিলেন না সেহেতু শয়তান ভ্যাণ্ডারডেকেনকে প্ররোচিত করতে লাগলো ঈশ্বরকে অমান্য করতে। নিম্নক্তো কয়েকটি পংক্তিতে আমরা দেখতে পাই শয়তানের প্ররোচনায় সে ঈশ্বরের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে যাচ্ছে। পাগলের মত মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলো-ঝড়ের প্রচণ্ড হঙ্কারের চেয়েও জোরে চেচিয়ে উঠে তার অঙ্গিকার সে ঘোষণা করলো—”আমার গন্তব্য পথ ও আমার জীবন; ঈশ্বরের ক্ষমতাকে অস্বীকার করে—নরকাগ্নির ভয়ে সে ভীত নয়; শেষ বিচারের দিন অবধি তার বিদ্রোহ অবিচল থাকবে।’ ক্যাপ্টেনের কথাগুলো কে সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছিলেন জানা যায় না। কিন্তু তার মনে অচিরেই শান্তি ফিরে আসে। এর কারণ ঈশ্বরপ্রেরিত দূত তাকে আশ্বস্ত করলেন যে ভ্যাণ্ডারডেকেন অনন্তকাল ধরে সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াবে। ঈশ্বরের মহাপ্রলয় শিঙ্গা যে পর্যন্ত বেজে না উঠবে, যে পর্যন্ত না ঐ শিঙ্গার শব্দ আকাশকে বিদীর্ণ করবে,—সে পর্যন্ত তার ঐ ভেসে বেড়ানো চলতেই থাকবে।
অবশেষে জাহাজ ধ্বংস হয়ে যাবে, নাবিকেরা মৃত্যুমুখে পতিত হবে, ভ্যাণ্ডারডেকেন কেয়ামত পর্যন্ত প্রহরায় থেকে তার দৃষ্টি প্রসারিত রাখবে।
ভ্যাণ্ডারডেকেন ও তার জাহাজ এ জীবনে আর বাটাভিয়ায় পৌছাতে পারেনি। ১৬৮০ খৃষ্টাব্দের পর থেকে অনেকবার ঐ জাহাজটিকে বিভিন্ন সময়ে ঐ এলাকায় দেখা গেছে বলে সংবাদ পাওয়া যায়। চলার পথে কোন জাহাজ থেকে ঐ ভুতুরে জাহাজটি যদি দৃষ্টিগোচর হত—তবে তারা তাকে দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত বলে আশঙ্কা করতো। আর এই আশঙ্কা তাদের মনে বদ্ধমূল হয়েই বসেছিল।
১৮৮০ খৃষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের হবুরাজা পঞ্চম জর্জ যখন এইচ. এম. এইচ ব্যাকান্টি জাহাজের মিডশিপম্যান হিসাবে কাজ করছিলেন তখন ঐ ভুতুরে জাহাজটি তিনিও দেখতে পান। জাহাজের পশ্চাৎভাগের উচ্চ স্থানে প্রাচীন আমলের পোষাক পরিহিত একজন লোককে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তাদের জাহাজটি তখন উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে পঞ্চাশ মাইল দুর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। ঠিক তার পরদিনই ব্যাকান্টি জাহাজের দড়িদড়ার সুউচ্চ স্থান থেকে একজন নাবিক পড়ে গিয়ে মৃত্যু বরণ করে।
১৯৪২ খৃষ্টাব্দে শেষবারের মত জাহাজটিকে দেখা যাওয়ার সংবাদও নথিভুক্ত আছে। কেপটাউনে নিজেদের বাড়ীর বারান্দায় চারজন লোক বসেছিলেন। হঠাৎ তারা ভুতুরে ইষ্ট ইণ্ডিয়া ম্যানকে টেবিল উপসাগর দিয়ে ভেসে যেতে দেখলেন। তারা আরো দেখলেন জাহাজটি দ্রুত গতিতে রোবেন দ্বীপের আড়ালে চলে গেল।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে:
বৈজ্ঞানিকগণ জোরের সঙ্গেই বলেন যে পঞ্চম জর্জ ও গ্লেনকেয়ার্নের তীর ভূমির লোকেরা মরিচীকা ছাড়া আর কিছুই দেখেননি। নতুবা তারা অন্য কোন জাহাজ হয়তো দেখে থাকবেন। যাকে তারা ঐ ভুতুরে জাহাজ বলে ভুল করেছেন। গ্রেট বৃটেনের প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল লাইনের ডাক পরিবহনের জাহাজ ভারতবর্ষের দিকে যাবার পথে এডেন বন্দরে নোঙ্গর করে। পরবর্তী সময়ে ঐ ডাক পরিবহনের জাহাজটির লগ উল্লেখে দেখা যায় যে ভূতুরে জাহাজটি তাদের জাহাজের ২০০ মাইল দূর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। বৈজ্ঞানিক মতে এটাই বা কি করে সম্ভব?
যারা ক্রমাগত ইষ্ট ইণ্ডিয়া ম্যানকে দেখেছেন বলে দাবী করেন সকলেই একই জিনিস কেন দেখেন তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত কোন বৈজ্ঞানিক কিন্তু দিতে সক্ষম হননি। ২০০ বছর আগেকার আঙ্গিকে শোভিত জাহাজ কেন বারবার লোকের দৃষ্টিগোচর হয় তারই বা ব্যাখ্যা কি?
শুধুই দৃষ্টি বিভ্রম বলে যারা একে উড়িয়ে দিতে চান কেন একাধিক লোক একই দৃশ্য দেখেন, তার কারণ সম্বন্ধে তারা কোন আলোকপাত করতে পেরেছেন কি?

তথ্যসূত্র: লৌকিক অলৌকিক, সাঈদা সিদ্দিকী