বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি, Stay Curioussis

আজ আমার মূল্য শুধুই ত্রিমাত্রিক আলো: বিশাল বুদ্ধকে ধারন করে আমি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম ১ নীরবে আফগানিস্তানের পাহাড়ে ছিলাম আমি শত শত বছর ধরে! তোমরা তো সবাই আমাকে চেনো ১ আমি হচ্ছি সেই বামিয়ান উপত্যকার বুদ্ধ মূর্তিদ্বয়। বামিয়ান , বর্তমান আফগানিস্তানের ৩৪ টি প্রদেশের একটি এবং পাহাড়ের উপর অবস্থিত একটি আলোকনগরি। বর্তমানে এই অঞ্চলে হাজার উপজাতির বাস। এই অঞ্চলের ইতিহাস কিন্তু অত্যন্ত সমৃদ্ধ। চীন থেকে রোমান সাম্রাজ্য, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃত ঐতিহাসিক রেশম পথের একেবারে উপরে অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চল বহু সংস্কৃতির মিলনস্থল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ফলে ইতিহাসের এক সুদীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ব্যাকট্রিয় গ্রিক ও কুষাণ আমলে এবং তারপরেও প্রায় ১০০০ বছর ব্যাপী এই অঞ্চল বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির একত্র মেলবন্ধন সবসময়েই শিল্পের বিকাশের পক্ষে অনুকূল। তার উপর এই অঞ্চলের সাথে বিখ্যাত রেশম পথের নৈকট্যর ফলে শিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জোগানও ছিল যথেষ্ট।

বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি, Stay Curioussis

ধ্বংসের আগে ও পরে বামিয়ানের বড় বুদ্ধমূর্তি।

এই সব কিছু মিলিয়েই এই অঞ্চলে গ্রিক, পারসিক ও বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত ভারতীয় শিল্পকলার মিশ্রণে এক বিশেষ ধরনের শিল্পকলার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ইতিহাসে এই শিল্পকলা গান্ধার শিল্প নামে বিখ্যাত। সমগ্র মধ্য এশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় উপমহাদেশে এই শিল্পরীতি প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে। বামিয়ানে এই শিল্পরীতির অনুকরণেই পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে বিভিন্ন মুদ্রার অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি খোদাই করা হয়। এদের মধ্যে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি বিশালাকার মূর্তি দুটি অন্যতম। ঐ দুটির মধ্যে এক আমি”সালসাল” অর্থাৎ সমস্ত জগতের আমি আলো বিচ্ছুরণ কারি।পাশে ছিল আমার থেকে সামান্য ছোট “সমামা”। তাকে বলল হতো সমস্ত জগতের মা । আমাকে তৈরি করা হয়েছিল ষষ্ঠ শতকের দিকে। পাহাড়ের গায়ে খোদিত অবস্থায় আমরা ছিলাম প্রায় ১৮০ ফুট উঁচু ‌। আমাদের ভিতরে বুদ্ধ শিল্পরীতি, গুপ্ত শিল্পরীতি,সাসানিয় সাম্রাজ্য, এমন কি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল। অর্থাৎ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্প রীতির মিলন হয়েছিল আমাদের ভিতর। তাই তো ইউনেস্কো আমাদের বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা দিয়েছিলো।

বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি, Stay Curioussis

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তোলা বামিয়ান উপত্যকার ছবি। ছবিতে পাহাড়ের গায়ে তালিবানদের হাতে ধ্বংস হওয়া বড় বুদ্ধমূর্তিটির ফাঁকা কুলুঙ্গিটি দৃশ্যমান।

আফগানিস্তানে আমি আসলাম কি করে? আরে বাবা প্রথম আববাসিয় খলিফা আক্রমণ করে এখানে সপ্তম শতকের পরে। আমাকে তো বানানো হয়েছিলো তার ও আগে। তোমাদের আমার এখানে হওয়ার রাজনৈতিক কারণ বলি;খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ, পঞ্চম ও চতুর্থ শতকে এই অঞ্চল হাখমানেশি সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের অভিযানে হাখমানেশি সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে এই অঞ্চলেও গ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতি সেলুকাসের নেতৃত্বে এখানে ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসন শুরু হয়। কিন্তু হিন্দুকুশের দক্ষিণের এই অংশটি পরবর্তী কালে ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সাথে সেলুকাসের কন্যার বিবাহের যৌতুক হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্যের হাতে হস্তান্তরিত হয়। গ্রিক ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক স্ত্রাবোর (৬৪ খ্রিঃ পূঃ – ২৪ খ্রিস্টাব্দ) ভাষায় আলেকজাণ্ডার এই অঞ্চল আর্যদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সেখানে নিজস্ব উপনিবেশ গড়ে তোলেন, কিন্তু সেলুকাস নিকাটর তা ৫০০ হাতির বিনিময়ে বিয়ের যৌতুক হিসেবে স্যান্ড্রোকোটাসকে (চন্দ্রগুপ্তকে) দান করে দেন। মৌর্য শাসনকালেই এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির এই চর্চা পরবর্তী কুষাণ যুগে ও তারপরেও ভালোভাবেই জারি থাকে। বাস্তবিক, বিভিন্ন ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায় যে সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের প্রবেশের আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব ছিল।

বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি, Stay Curioussis

বামিয়ানের বড় বুদ্ধমূর্তি

হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে বর্তমান বামিয়ান অঞ্চলে আরও আগেই বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হলেও, মূলত কুষাণ আমলেই এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। যার ফলস্বরূপ আমার আবির্ভাব। মুসলিম আক্রমণ এর পর এ অঞ্চলে বুদ্ধ ধর্ম বিলুপ্তির শত শত বছর পর ও আমি ছিলাম,সারা পৃথিবীর মানুষকে আমার দুই কূলের মিশ্রিত শীল্পরীতি দিয়ে বিস্মিত করতাম।কিন্তু কখনো কারো ক্ষতি করিনি।

বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি, Stay Curioussis

১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে বামিয়ানের অপেক্ষাকৃত ছোট বুদ্ধমূর্তি

তবুও ২০০১ সালে গ্রানাইট দিয়ে আমাকে ধ্বংস করলো, ধ্বংস করলো আমার পাশের জনকেও।এখন বামিয়ান উপত্যকাই আসলে দেখতে পাবে পাহাড়ের পাশে দুটো ফাঁকা কুলঙ্গি। শূণ্য সবকিছু! এখন তবুও শুনতে পাই, দেশ-বিদেশে থেকে আসে দর্শনার্থী আমাদের কখনো অস্থিত্বময় এই ফাঁকা কুলঙ্গি গুলো দেখার জন্য। আমার অস্তিত্ব হীন চোখ এখন দেখে আফগান সরকার দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করার জন্য ত্রিমাত্রিক প্রজেক্টরের মাধ্যমে আমার আলোকচিত্র দেখায়। আমি তো চুপচাপ এক পাহাড়ের কোণে পড়ে ছিলাম, হাজার মানুষেব় শ্রমে ফোটানোর সৌন্দর্যের নিশ্চুপ গর্ব নিয়ে।কেনোই বা ধ্বংস করলে,কেনোই বা আজ এই রসিকতা! আমি পাথর, আমার হৃদয় নেই। কিন্তু যে হাজার হাজার মানুষ প্রায় দেড় হাজার বছর আগে প্রাণান্তিক পরিশ্রম করে পাহাড়ের গায়ে আমায় ফুটিয়ে তুলেছিল তাদের তো হৃদয় ছিল, কষ্টের মূল্য ছিল!

বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি, Stay Curioussis

১৮৭৮-৭৯ সালে আঁকা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তিদ্বয়ের ছবি।