আফ্রিকার আদিম অধিবাসীর জীবনে, বৈজ্ঞানিক চরম উৎকর্ষের যুগেও-যাদুটোনা, ডাইনীবিদ্যা ইত্যাদি বিশেষ প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এমনকি যারা আজকাল পল্লীসমাজে বসবাস করে তারাও এই অন্ধবিশ্বাস বা সংস্কারের হাত থেকে রেহাই পায় না।

তারা এ যুগেও বিশ্বাস করে কোন অভিশাপ,-বিশেষ করে মৃত্যুর অভিশাপ কাটানো তখনই সম্ভব যখন কোন শক্তিশালী আত্মার কাছে পূজা দিয়ে বা প্রার্থনা করে সেই বিশেষ আত্মার সন্তুষ্টি বিধান করা যায়। তারা মনে করে যদি কোন শক্তিশালী যাদুকরের শরণ নেওয়া যায় তাহলেও এ সব ব্যাপারে সুফল পাওয়া যেতে পারে।

নৃতত্ত্ববিদদের মতে সকল অভিশাপপ্রাপ্তদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। অভিশাপদাতার অভিশাপ কার্যকরী হতে বাধ্য। যাই হোক দেখা গেছে ভাগ্যান্বেষী শ্বেতাঙ্গ লকেরা-যারা মানসিক ভাবে এই সব যাদুটোনায় প্রভাবিত হয়না, তারাই এই ধরণের অভিশাপের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে বেশী।

রোডেশিয়ার তেত্রিশ বছরে এই ধরণের দুটি দৃশ্যমান ঘটনার কথা জানা যায়। ভাগ্যান্বে

যাদুর ডাক্তারের ওষুধঃ

১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে এক যাদুকরকে স্যালিসবেরী উচ্চ আদালতে আনা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে , বেআইনিভাবে তিনি যাদু বিদ্যা প্রয়োগ করে তার চিকিৎসা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিচারে আনীত অভিযোগের সত্যতা প্রমানিত হলে তাকে দুবৎসরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।

যাদুকর ডাক্তার উচ্চ বাচ্য না করে ঘার নেড়ে তার শাস্তি মাথা পেতে নিলো। কিন্তু বিচারক যখন তার যাদুটোনার সামগ্রী সহ অষুধ গুলো ধ্বংস করার আদেশ দিলেন তখন তার আর সহ্য হল না। বিচার সভাতেই রাগে সে ফেটে পড়লো। চিৎকার করে সে বার বার অভিশাপ দিতে থাকলো-রাস্তায় সিংহরা বেরিয়ে আসুক-আমার যাদুটোনার জিনিসগুলো ধ্বংস করার প্রতিফল তুমি লাভ কর।

১৯৪৯ সালের মধ্যে স্যালিসবেরী শহরটি বেশ আধুনিক রুচিসম্পন্ন ও চৌকশ শহরে পরিণত হয়েছে। বন কেটে বসতের জন্য আধুনিক শহরে পরিণত করার আগে এসব আঞ্চল সিংহের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র ছিল ঠিকই। কিন্ত বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে শহরের সমূহ উন্নতির কারণে আশে পাশে কোথাও কিন্তু সিংহের দেখা মেলেনি।

যাই হোক উপরি উক্ত যাদুকরের অভিশাপ দেবার সপ্তাহ তিনেক পরে দেখা গেল সিংহের একটি দল শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাইল দুই দূরে নির্ভয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দলে একটি স্ত্রী , একটি পুরুষ সিংহ সহ তাদের রীতিমত বেড়ে ওঠা নাদুস নুদুস তিনটা ছানা হয়েছে। কিছু দিন পর ঐ সিংহের দল একটি বাড়ীর বাগানে বিচরণশীল ছাগলকে আক্রমণ করে হত্যা করলো। বাড়ীর ভীতসন্ত্রস্ত লোকেরা বারান্দার আড়াল থেকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষও করলো।

এর পর এভাবে ঘটনার পর ঘটনা ঘটেই চললো। কুকুর থেকে শুরু করে গরুর পাল ইত্যাদি তারা নির্বিচারে হত্যা করতে লাগলো। অবশেষে একটি শিকারী দল তৈরি হল, সিংহ মারার জন্য। বিষ মিশিয়ে খাবার ছড়িয়ে রাখা হলো। কিন্তু কোন কাজ হলনা।সিংহ বাহিনী সে-সব খাবারের ধারকাছ দিয়ে ও গেল না। শিকারী দল বাধ্য হয়ে ভিন্ন পথ ধরলো। এক সপ্তাহ ধরে তারা সিংহদলটিকে চতুর্দিক থেকে অবরোধ করে রাখলো। ফলে সিংহ গুলো ঐ অঞ্চল থেকে সরে পড়লো।

তারপর বেশ কিছুদিন ঐ সিংহ বাহিনীর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেলনা। হঠাৎ আবার এই বাহিনীর উদয় হল ষোল মাইল দুরবর্তী ম্যাজো নামে একটি অঞ্চলে। ঐ অঞ্চলের সোনার খনির আশে পাশে তারা রীতিমত ত্রাসের সঞ্চার করে চললো । দুজন শিকারী সারা রাত ধরে তাদের প্রতীক্ষায় নিদ্রাহীন ভাবে মাচার উপর বসে কাটালেন।এত চেষ্টা সত্ত্বেও সিংহগুলোকে মারা গেল না। কড়া প্রহরা সত্ত্বেও অতর্কিতে কখন যে তারা নিকটবর্তী একটা খামার বাড়ীতে ঢুকে দুটি হত্যাকান্ড সংঘটিত করলো কেউ বুঝতেই পারলোনা। সিংহের জন্য মড়ি হিসাবে একটি ছাগল শিকারীরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বেঁধে রেখেছিলেন। তার স্বরে প্রাণভয়ে ছাগলটি চিৎকার করে চলেছে। সেই স্বর অস্পষ্ট ভাবে রাতের আঁধার ভেদ করে শিকারীদের কানে এসে পৌছাচ্ছে। মড়ি হিসাবে ছাগল ছাড়া শিকারীরা একটি তাজা বড় সড়ো ষাঁড় ও ছেড়ে দিয়েছেন, সিংহ গুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য। কিন্তু সিংহ গুলো এসবে যেন মোটেই প্রলোভিত হলনা। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কিছু দিন পর এরা কোথায় যে অন্তর্হিত হল কউই টেরও পেল না। এ যেন কোন এক অদৃশ্য হাতের কারসাজি –যেমন অতর্কিতে এদের আগমন- ঠিক সেভাবেই প্রস্থান।!!

বছর সাতেক আগে  এড্রিয়ান ব্রুকস্‌ নামে এক ব্যক্তি ঠিক এ ধরণের এক যাদুবিদ্যার সম্মুখীন হন। তিনি ছিলেন কর্মঠ ও অনুসন্ধিৎসু নবীন যুবক। উত্তর রোডেশিয়ার (বর্তমান জাম্বিয়া ) কাসামা নামক স্থানে তিনি সরকারী শাসন বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

স্থানটি ছিল কাসামা অঞ্চলের ছোট খাটো একটি শাসনকেন্দ্র।  আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলো। এখানকার মোম্বা আদিবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্যের ওপর ছিল বেশী পরিমানে আস্থাশীল । তারা বিশ্বাস করত যে প্রতিটি গাছেরও আত্মা রয়েছে। প্রতিটি দৈনন্দিন ঘটনাবলীর পেছনে একটি করে গুঢ় কারণ রয়েছে বলেও তারা বিশ্বাস করতো।

ব্রকস্‌ এই কাসামার জেলা অফিসার হিসাবে কাজে যোগ দেন এবং অচিরেই তার সব কাজ একটি নিয়ম ও শৃঙ্খলার ভিতর নিয়ে আসেন। তিনি একজন সৌখিন ও দক্ষ আলোকচিত্রশিল্পীও ছিলেন। অবসর সময়ে তিনি অসাধারণ কিছু দেখলে তার ছবি তুলে বেড়াতেন। উদ্দেশ্য –এগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় চড়াদামে বিক্রি করে দুপয়সা কমানো।

কাজে যোগদানের মাস তিনেক পরে একজন ওয়েম্বা আদিবাসী তাকে একজন গণ্যমান্য ওয়েম্বা প্রধানের পবিত্র সমাধিস্থলের সংবাদ দিলো। সমাধিস্থলটি ছিল বিশেষ একটি গোপন স্থানে। আর ওয়েম্বা আদিবাসীদের শ্বেতাঙ্গ লোকদের প্রতি  বিরুপ মনোভাব থাকার দরুন এ স্থানে ইতিপূর্বে কোন শ্বেতাঙ্গের পদধূলিও পড়েনি।

শতবর্ষ ধরে এই সমাধিস্থলের ধর্মীয় আচার আচরণগুলি গোপনেই সমাধা করা হত। ওয়েম্বা প্রধানের মৃত দেহটি একটি রাজকীয় কুড়ে ঘরে রাখা হয়েছিল। দেহের মাংস গুলো পচে, গলে হাড় থেকে আলাদা না হওয়া পর্যন্ত এই মৃত দেহটিকে রীতিমত পাহারা দেওয়া হত। তারপর সম্পূর্ণ  কঙ্কালটিকে বসা অবস্থায় কবরস্থ করা হয়। কঙ্কালের একটি হাত থাকে মাটির বাইরে আর সেই হাতে দেওয়া হয় কাটা চামচার কাটার মত একটি গাছের ডাল। হাত বাইরে রেখে এ ভাবে কবর দেওয়ার উদ্দেশ্য হল এ পথে চলার সময় পথিকেরা তার সঙ্গে করমর্দন করতে পারবে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ওয়েম্বাদের বদ্ধমূল ধারনা  যে এই করমর্দন পথিকের বিপদ দূর করে মঙ্গল ডেকে আনবে।

ওয়েম্বাদের এই পবিত্র সমাধিটির পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন দুজন জাদুকর ডাক্তার। এই ওয়েম্বা যাদুকরেরা ব্রক্‌সকে ছবি তুলতে বারবার নিষেধ করলেন। কিন্তু ব্রক্‌স তাদের কথা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলেন। নানা কোন থেকে বিভিন্ন আঙ্গিকে তিনি আলোকচিত্র গ্রহণ করতে থাকলেন। তাদের নিষেধ অমান্য করে এ ভাবে আলোকচিত্র গ্রহণের ফলে যাদুকর ডাক্তারগণ অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলো এবং ভীষণ ভাবে রেগে গেলো। ব্রক্‌স এর ঐ স্থান ছেড়ে আসবার সময় ডাক্তার দুজন তাকে জানালো, যেহেতু তিনি তাদের প্রধানের সমাধির পবিত্রতা নষ্ট করে ছবি তুলেছেন সেহেতু তিনি তাদের প্রধানের উষ্মার কারণ হয়ে উঠেছেন। আর তাদের প্রধানের উম্মার কারণেই তাকে অচিরেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।

এ কথায় ব্রক্‌স কিন্তু একটুও ভয় পেলেন না। তাকে এতটুকুও উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেলোনা। কাসামাতে ফিরে এসে এই অভিশাপ নিয়ে অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তিনি রীতিমত হাসি তামাশা শুরু করলেন।

কিন্তু কি আশ্চর্য ! তিনদিন পরই তিনি যখন তার অফিসের দালানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন,-তার অফিসের পতাকা উত্তোলনের খুঁটিটি তার ওপর ভেঙে পড়ে তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটায়। অভিশাপটির সত্যতা যেন হাতে হাতেই প্রমানিত হয়ে গেলো।

সরকারী প্রতিবেদনে জানা যায় উঁই পোকার আক্রমণে খুঁটিটির গোঁড়া নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায়  ব্রক্‌স এর উপর তা ভেঙে পড়ে এবং তাতেই তার মৃত্যু ঘটে। উইতে আক্রান্ত খুঁটি চাপা পড়ে মৃত্যু অবশ্যই তার ললাটের লিখন ছিল কিন্তু অভিশাপের ব্যাপারটি কি একেবারেই উড়িয়ে দেবার মত ?