খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক। গোধূলিবেলার অর্ধঅস্তমিত সূর্যের আলোটুকু জানান দেয় ব্যস্তময় দিনের পরিসমাপ্তির। এবার বিশ্রাম নেবার পালা। আবছা আলোকিত আকাশের নিচে প্রশান্ত মন নিয়ে ঘরে ফেরে পাখিরা। আর মথুরাবাসীরা ব্যস্ত দিনের শেষে সেই গোধূলিতে অস্থির, ক্লান্ত মন নিয়ে প্রশান্তির খোঁজে রওয়ানা হয় আমোদে পূর্ণ নাচ-গানের আসরের দিকে। হ্যাঁ, সেই নাচ-গানের আসরই ছিলো তখন ক্লান্ত-শ্রান্ত পুরুষের বিশ্রাম নেবার উৎকৃষ্ট জায়গা। নর্তকীদের শৈল্পিক অঙ্গভঙ্গি তাদের জন্য ছিলো ভীষণ উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক ব্যাপার। এমনই একজন জনপ্রিয় নর্তকী ছিলেন বাসবদত্তা।
সে সময় নৃত্যশিল্প ছিলো রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে কৃষ্টির এক অসাধারণ নিদর্শন। মেয়েরা শুধু নর্তকী হিসেবেই নয়, বরং আরো অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের গুণাবলি প্রকাশের সুযোগ পেতো। যাত্রা, নাট্যচর্চা, ঝুমুর, পাঁচালি বা গান, কবির লড়াই, কি করতো না মেয়েরা! তখন মেয়েদের এসব পেশার মর্যাদাও ছিলো ঢের। নর্তকী মানেই যৌনকর্মী ছিলো না তখন। কিছু কিছু নর্তকীদের দুই-একজন নির্দিষ্ট খদ্দের থাকলেও নিজেদের পেশায় বিচরণই ছিলো তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এসব নারীরা রাষ্ট্রের জন্য ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তারা ধনী ছিলো, শিক্ষিত এবং বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্নও ছিলো। শুধু একটিমাত্র গুণাবলিই যথেষ্ট হতো না নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পক্ষে। তাদেরকে অর্জন করতে হতো বিভিন্ন ধরনের পারদর্শিতা। কোনো কোনো নারী শিল্পীর তো শিকার ও মিলিটারী ট্রেনিং-এ দক্ষতা থাকাও বাধ্যতামূলক ছিলো। রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ট্যাক্স পেতো এই কর্মজীবী নারীদের কাছ থেকে। বিনিময়ে রাষ্ট্র তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতো।
যাই হোক, বলছিলাম বাসবদত্তার কথা। একজন অনন্য নৃত্যশিল্পী বাসবদত্তা। তার চোখের চাহনি পুরুষের হৃদয়ে মধুর এক ব্যথার সৃষ্টি করে, শিহরণ তৈরী করে তার ক্লান্ত শরীরে। তার চোখের পলক ফেলবার সাথে সাথে যেনো বজ্রপাত ঘটে যায়। তার ঠোঁটের মৃদু কম্পন দর্শকদের মনকেও কাঁপিয়ে তুলতো। তার সৌন্দর্য ও অপরূপ নৃত্য পরিবেশনা এক আবেশী ছন্দ তৈরী করতো। মনে হতো যেনো, নৃত্যরত অবস্থায় শরীরের প্রতিটি অঙ্গে তার ঝরে পড়ছে প্রেম এবং ভক্তির প্রশস্তিমালা। বাসবদত্তার সুন্দর মুখখানিই যেনো দর্শকের সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই ভুলিয়ে দিতো। কিন্তু বাসবদত্তার মন কি চাইতো? তিনি তো খুঁজে বেড়াতেন অন্য কিছু। যেই মনের মানুষকে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তার দেখা আজও পান নি তিনি। এতো এতো মানুষ এসে ভিড় করে তার আঙ্গিনায়, তবু তাদের কারো মাঝে মেলে নি বাসবদত্তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের গুণাবলি।
দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। স্নান সেরে পূজায় মগ্ন হন বাসবদত্তা, পূজা শেষে বিশেষ এক সুগন্ধি তেল ব্যবহার করে প্রদীপ জ্বালান তিনি। সুগন্ধে মৌ মৌ করতে থাকে তার আঙিনা। ক্লান্ত পুরুষেরা আসবেন একটু পরই। তাদের বিনোদনের সমস্ত তদারকি নিজ দায়িত্বেই পালন করেন বাসবদত্তা। এটাই তার নিত্যদিনের রোজনামচা।
সন্ধ্যার আসরের প্রস্তুতি শেষে এমনই এক দিন নিজের ঘরের কোণায় জানালার পাশে বসে কি এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছিলেন বাসবদত্তা। মনটা তার আজ ভীষণ অস্থির। তিনি নিজেও এর কারণ জানেন না। বাইরে শ্রাবণের ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের সাথে ভেসে আসছে বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধ। হঠাৎ এক অদ্ভূত অনুভূতি হলো তার। বাসবদত্তা বুঝতে পারলেন না কি হচ্ছে। কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি অবচেতন মনে। বিশেষ কিছু একটা না পাওয়ার অপূর্ণতা থেকে হৃদস্পন্দন বেড়েই যাচ্ছে তার। ঠিক তখনই জানালার পাশ দিয়ে একজন গৌর কান্তি সুদর্শন যুবক সন্ন্যাসী তার ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। থমকে গেলেন বাসবদত্তা। উপলব্ধি করলেন, এ তো সে-ই, যাকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে তার মন। হ্যাঁ, ইনিই বাসবদত্তার চিরকাঙ্ক্ষিত মনের মানুষ।
এবার শিহরণ বয়ে যায় বাসবদত্তার অন্তরে। শরীর ও মনে জৈবিক পরিবর্তন আসে তার। তবে দ্রুতই সম্বিৎ ফিরে পান তিনি। এতো দিন ধরে যার পথ চেয়ে দিন পার করেছেন, তাকে তো কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। সচকিত হয়ে নিজের দাসীকে ডেকে আনেন বাসবদত্তা। দাসী তো তার প্রিয় বন্ধু। আকুল হয়ে মনের কথা বলে ফেলেন তাকে বাসবদত্তা। বাসবদত্তার সেই পরিচারিকা ভালো করেই বুঝতে পারে তার মনের অবস্থা। দেরী না করে ছুটে যায় সে তরুণ সন্ন্যাসীর কাছে, জানায় বাসবদত্তার মনের আকুতি। কিন্তু সন্ন্যাসী বলেন যে, বাসবদত্তার সাথে সাক্ষাতের উপযুক্ত সময় এখনো আসে নি এবং সময় হলে তিনি নিজেই আসবেন।
কি আশ্চর্য! অবাক হয় বাসবদত্তা ও পরিচারিকা উভয়েই। ভেবে পান না বাসবদত্তা, কেনো প্রত্যাখ্যাত হলো তার অনুরোধ। এই ধরনের প্রত্যাখ্যানে তো অভ্যস্ত নন তিনি। তাকে এক পলক দেখবার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে সব পুরুষ। তবে এই যুবক কেনো নয়, যাকে বাসবদত্তা নিজেই এতো আকুল হয়ে চাইছেন?
বাসবদত্তার হঠাৎ মনে হলো, হয়তো তার জন্য উপহার আনার সামর্থ্য যুবকের নেই বলেই দ্বিধাগ্রস্ত তিনি। বাসবদত্তার কাছে তো সবসময় ধনী ও অভিজাতরাই আসেন, যাদের হাতে থাকে তার জন্য সোনা, রূপা ও বহুমূল্য রত্নের উপহার। কিন্তু এই যুবককে তো বাসবদত্তা কোনো উপহারের বিনিময়ে চান না, চান সম্পূর্ণ নিজের করে পেতে। বাসবদত্তার নারী-হৃদয় সেই যুবকের হাত ধরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে চায়।
বাসবদত্তা আবারো তার পরিচারিকাকে পাঠালেন সেই যুবকের কাছে। পরিচারিকা ছূটে গিয়ে যুবককে বললো, দারিদ্র্যের কারণে তিনি যেনো সংকোচ না করেন, বাসবদত্তা তার কাছ থেকে কোনো উপহারের আশা করছেন না, তিনি কেবল তাকে বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে চান। এ কথা শুনে যুবকের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। অদ্ভূত প্রশান্ত সেই হাসি। আরও এক বার দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, উপযুক্ত সময় এখনো আসে নি। চেহারায় তার দৈবভাব স্পষ্ট দেখতে পেলো পরিচারিকা। বিনয়ে অবনত হলো তার মাথা যুবকের সামনে। চলে গেলেন যুবক। আর তার চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাসবদত্তা ও তার পরিচারিকা।
কে এই দৈব যুবক? কেনোই বা নগরের সবচেয়ে সুন্দরী নর্তকীর আহ্বান তাকে দুর্বল করতে পারলো না? ‘অশোকাবদান’ বইটি থেকে জানা যায়, মৌর্য সম্রাট অশোকের আধ্যাত্মিক শিক্ষক ছিলেন এক জন বৌদ্ধ ভিক্ষু। প্রথম জীবনে অশোক ছিলেন একজন প্রচন্ড নিষ্ঠুর সম্রাট। তিনি যে যুদ্ধে যেতেন, সেখানে লাশের জন্য মাটিতে পা ফেলে চলার জায়গা থাকতো না। কিন্তু এক দিন অশোক পুরোপুরি বদলে গেলেন। তার জীবনের নিষ্ঠুরতম যুদ্ধ ছিলো কলিঙ্গের যুদ্ধ। কলিঙ্গের সেই ভয়াবহ যুদ্ধের পর অশোকের জীবনে এলেন সেই আধ্যাত্মিক শিক্ষক। তিনি আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন অশোককে তার কৃতকর্ম, উপলব্ধি করালেন মানবজীবনের সত্যিকার অর্থ। সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর মুখের কথাগুলো পাষন্ড অশোকের হৃদয়কে গলিয়ে দিলো। প্রচন্ড অপরাধবোধ ও আত্মগ্লানিতে ভুগতে শুরু করলেন সম্রাট অশোক। আর এর পর থেকেই চন্ডাশোক বদলে গেলেন ধর্মাশোকে। গৌতম বুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত হলেন তিনি। নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন ধর্মস্রোতে। সেই গেরুয়া বসন, সৌম্য দৃষ্টি বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাহচর্যে আসবার পর থেকে অশোক আর একটিও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হতে দেন নি। একজন শান্তিকামী অশোককে গড়ে তুলে গোটা ভারতবর্ষে সম্রাটের সংজ্ঞাকে যিনি উল্টা-পাল্টা করে দিলেন, তিনি আর কেউ নন, বাসবদত্তার প্রাসাদের বাইরে দিয়ে হেঁটে যাওয়া সেই যুবক। তার নাম উপগুপ্ত।
নিঃসন্দেহে উপগুপ্ত ছিলেন একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যে কারণে সাহিত্যের অঙ্গনেও উঠে এসেছে তার কাহিনী। দশম-একাদশ শতাব্দীর কাশ্মীরি কবি ক্ষেমেন্দ্র তার ‘বোধিসত্ত্বাবদানকল্পলতা’ বইতে তুলে ধরেছিলেন উপগুপ্ত ও বাসবদত্তার কাহিনী। আর সেই কাহিনীর ভিত্তিতেই পরবর্তীতে বাংলা ১৩০৬ সালের ১৯ আশ্বিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অভিসার’ নামের একটি কবিতা রচনা করেন।
যা-ই হোক, বাসবদত্তা কিন্তু ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন সেই দিনের পর থেকে। কোনোভাবেই তিনি বুঝতে পারছিলেন না উপগুপ্তের এভাবে চলে যাবার কারণ। বিমর্ষ বাসবদত্তার কোনো কাজেই আর মন বসে না। এমনকি যে নৃত্যের গুণে এতো প্রসিদ্ধ তিনি, সেই নৃত্যও অসহ্য লাগতে শুরু করলো তার কাছে। বন্ধ হয়ে গেলো নাচের আসর। তার এই অদ্ভূত আচরণে নগরের সম্ভ্রান্তরা অবাক এবং একই সাথে ভীষণ বিরক্তও হলো। রাষ্ট্রও ক্ষিপ্ত হলো বাসবদত্তার ওপর।
গৃহপরিচারিকা বাসবদত্তার মনের এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছিলো। এমন বিমর্ষ অবস্থায় বাসবদত্তাকে এর আগে কখনোই সে দেখে নি। তাই বিরহিনী বাসবদত্তাকে কষ্ট থেকে দূরে রাখবার জন্য মথুরার একজন তরুণ ভাস্করের প্রদর্শনীতে নিয়ে গেলো সে। প্রদর্শনীর ভাস্কর্যগুলো যতোই দেখেন ততোই মুগ্ধ হন বাসবদত্তা, নিজের অজান্তেই বার বার হয়ে ওঠেন শিল্পীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
এদিকে সেই তরুণ ভাস্করও রূপবতী বাসবদত্তাকে দেখতে লাগলো বার বার। তার মুগ্ধতা যেনো কাটতেই চায় না। টিকোলো নাক, উন্নত গ্রীবা, বুদ্ধিদীপ্ত টানা টানা চোখ, মুখে লেগে থাকা ক্ষুদ্র ঘামের বিন্দু। চোখ ফেরানো যায় না। প্রেমে পড়ে যায় সে বাসবদত্তার। হঠাৎ একটি বিশেষ ভাস্কর্যে চোখ আটকে গেলো বাসবদত্তার। সেটিকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছা জাগলো তার মনে। তাই ভাস্কর্যটির দাম সম্পর্কে জানতে চাইলেন তিনি শিল্পীর কাছে। বাসবদত্তার প্রশ্ন শুনে হাসি ফুটে উঠলো ভাস্করের মনে। এই তো সুযোগ রূপবতীকে তার আনন্দ ফিরিয়ে দেয়ার। সামান্য কৌতুক করলো ভাস্কর। বাসবদত্তাকে সে জানালো, এই বিশেষ ভাস্কর্যের দাম এতো বেশি যে তা কেনার সামর্থ্য বাসবদত্তার নেই। এই কথা শুনে আত্মসম্মানে আঘাত লাগলো ধনী নর্তকীর। সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি ভাস্করকে, যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে তার এটা চাই। এবার ভাস্কর বললো আসল কথা, জানালো নৃত্যকলায় ফিরে গেলেই বাসবদত্তা অর্জন করবেন ভাস্কর্যটি। দ্বিধায় পড়ে গেলেন বাসবদত্তা। কিন্তু কথা তো তিনি দিয়ে ফেলেছেন। সুতরাং আবারো নিজের পেশায় ফিরে গেলেন তিনি। নগরের পুরুষেরা তো মহা খুশি। কিন্তু আনন্দ নেই শুধু বাসবদত্তার মনে। তার মন তো পড়ে রয়েছে অন্য কোনো প্রান্তে সাধু উপগুপ্তের কাছে, যার ব্যক্তিত্বের কাছে সমস্ত নগরবাসীকে তুচ্ছ মনে হয় বাসবদত্তার।
এদিকে সেই তরুণ ভাস্করের কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারদিকে। কিন্তু তার মন তো আবদ্ধ বাসবদত্তার কাছে। নর্তকীর গুণমুগ্ধ ভাস্কর ইচ্ছা প্রকাশ করলো বাসবদত্তার একটি ভাস্কর্য তৈরীর। হাসি মুখে রাজি হলেন বাসবদত্তা। ততো দিনে একটি স্নিগ্ধ নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছে ভাস্কর ও বাসবদত্তার মাঝে।
এক সময় মূর্তি বানানো শেষ হলো। নিজের মূর্তি দেখে বিস্মিত, অভিভূত ও আবেগাপ্লুত হলেন বাসবদত্তা। কি চমৎকার শিল্পকর্ম! এক অদ্ভূত উপলব্ধি ঘিরে ধরলো তাকে। ভাস্করকে বললেন তিনি, তার নিজের শিল্পকর্ম নৃত্য যেটি তার মৃত্যুর সাথে সাথেই হারিয়ে যাবে, কিন্তু ভাস্করের শিল্পকর্ম অমর, মৃত্যুর পরও ভাস্কর বেঁচে থাকবে হাজার হাজার বছর। আনন্দে ও আবেগে চোখে পানি চলে এলো বাসবদত্তার। আর ভাস্কর তো তার মনে আনন্দের সঞ্চার করতে পেরেই হলো খুশিতে আত্মহারা।
সময় গড়িয়ে চললো। বাসবদত্তা ও ভাস্করের বন্ধুত্বও গাঢ় হলো। তবে তাদের এই মধুর বন্ধুত্ব মথুরাবাসী সুনজরে দেখলো না। ঈর্ষান্বিত হলো তারা। কেননা বাসবদত্তা তো সবার, কোনো একজন নির্দিষ্ট পুরুষের সাথে তার এতো ঘনিষ্ঠতা রাষ্ট্রও মেনে নিতে পারলো না। আর তাই দানা বেঁধে উঠতে লাগলো এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র।
বেশ ক’দিন হলো, ভাস্করের কোনো খোঁজ নেই। প্রথমে বাসবদত্তা ভাবলেন, হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ভাস্কর। তবে আরো কিছু দিন পার হতেই ভাবনায় পড়ে গেলেন বাসবদত্তা। ভাস্কর যেনো একদম কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেছে। নতুন বন্ধুর এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়াতে ভীষণ চিন্তিত হলেন বাসবদত্তা এবং তার পরিচারিকা। তারা তখনও জানেন না যে বাসবদত্তা ও ভাস্করের বন্ধুত্বে ঈর্ষাকাতর হয়ে নগরের সম্ভ্রান্তরা ভাস্করকে হত্যা করে গোপনে তার বাড়ির পেছনে মাটিতে পুঁতে রেখেছিলো এবং সব জায়গায় রটিয়ে দিয়েছিলো যে, শিল্পীকে তিন দিন আগে বাসবদত্তার বাড়িতেই শেষ দেখা গিয়েছিলো। তাই ভাস্করের হত্যার মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো বাসবদত্তাকে।
রাষ্ট্রের নিয়ামকদের বিচারে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় নির্দোষ বাসবদত্তার এবং মথুরা থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। এ যেনো নির্মল এক বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িত হবার দুর্বোধ্য শাস্তি। হিংস্র নগরবাসী তাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগলো, আঘাতে সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হলো সুন্দরী বাসবদত্তার। প্রাসাদের প্রাচীরের বাইরে আহত অবস্থায় আশ্রয় নেয় সে। বাসবদত্তার এই দুঃসময়ে একমাত্র তার পরিচারিকাই থেকে গিয়েছিলো তার পাশে।
পরিচারিকার সহানুভূতি ও চিকিৎসায় বাসবদত্তার দেহে প্রাণ ছিলো ঠিকই, কিন্তু পাথরের আঘাত থেকে সৃষ্টি হলো মারাত্মক ঘা। একটু একটু করে সেই ঘা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত শরীরে। এমন মুমূর্ষু অবস্থায়ও নির্দয় পথচারীরা তাকে দেখলেই পাথর ছুঁড়ে মারতো। সব মিলিয়ে বাসবদত্তার জীবন হয়ে পড়েছিলো নরকের মতো।
বাসবদত্তা যখন এমন দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিন পার করছেন, তখন এক দিন তার সামনে এসে দাঁড়ালেন সেই সুদর্শন বৌদ্ধ ভিক্ষু, উপগুপ্ত। বাসবদত্তার সামনে এসে মায়াভরা চাহনি নিয়ে উপগুপ্ত বললেন, “দেখো বাসবদত্তা, তুমি সব সময় আমাকে তোমার পাশে চেয়েছো, এবার আমি এসেছি”। কিন্তু এই অসময়ে কেনো এলেন উপগুপ্ত তার কাছে, অভিমানের সুরে জানতে চাইলেন বাসবদত্তা। আঘাতের ফলে সৃষ্ট ক্ষত তাকে করে তুলেছে বীভৎস। তার রূপ-গুণের কিছুই তো আর অবশিষ্ট নেই। এখন তো তিনি তার এই কদর্য মুখটি নিজের কাঙ্ক্ষিত প্রিয় পুরুষকে দেখাতে নারাজ।
মমতাভরা কণ্ঠে উপগুপ্ত হেসে জানান, তার প্রয়োজন সে সময় ছিলো না বলেই চলে গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু এখন তাকে বাসবের প্রয়োজন। বিনয়ী সন্ন্যাসী অনুমতি চাইলেন বাসবদত্তার কাছে, মঠে নিয়ে সেবা করবার জন্য। বাসবদত্তাকে সুস্থ করে তুলবার গুরুদায়িত্ব এবার পালন করতে চান উপগুপ্ত।
ধীরে ধীরে উপগুপ্তের পরিচর্যায় এক সময় সেরে উঠলেন বাসবদত্তা। শরীর তো সুস্থ হলো, কিন্তু মন? মনের দিক থেকে ব্যথায় আক্রান্ত বাসবদত্তা। তার রূপ-সৌন্দর্য-সম্মান সবই তো হারিয়ে গিয়েছে। মনের এই দুর্দশাকে সারিয়ে তুলবার জন্য তাকে ভগবান বুদ্ধের কাছে আশ্রয় নেবার পরামর্শ দেন উপগুপ্ত। উপগুপ্তের পরামর্শে বৌদ্ধ সংঘে যোগ দেন বাসবদত্তা। এর পর থেকেই আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসে তার মধ্যে। তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেন যে, নিজের ভেতরের আলোকে প্রজ্জ্বলিত করলেই মিলবে মনের শান্তি।
মানুষের বাহ্যিক রূপ চিরস্থায়ী নয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা এমনিতেই এক দিন হারিয়ে যায়। এমনকি মানুষের শরীরও মৃত্যুর পর মাটির সাথে মিশে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তা পোকা-মাকড়ের খাদ্যে পরিণত হয়। এই বাস্তবতাকে মনে রেখেই খোঁজ করতে হবে বৃহৎ সৌন্দর্যের, আত্মার সৌন্দর্যের। যা হারিয়ে গিয়েছে তা কেবল ক্ষণস্থায়ী, চিরস্থায়ী হলো আত্মার সৌন্দর্য।
মনের দুঃখ-যাতনার অবসানের জন্য অন্তরের প্রদীপকে প্রজ্জ্বলিত করতে হবে –এটাই তো বুদ্ধের নির্দেশনা। আর হয়তো প্রকৃত ভালোবাসার অর্থ অন্তরের সৌন্দর্যে আলোকিত হওয়া এবং কঠিন দূর্যোগে শক্ত করে হাত ধরে রাখা, যা উপগুপ্ত করেছিলেন। ভোগবিলাসী মথুরার সর্বশ্রেষ্ঠ নর্তকী এক সময় হয়ে উঠলেন সন্ন্যাসিনী। দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ানো সত্যিকার ভালোবাসার শক্তিই বাসবদত্তাকে দিয়েছিলো একটি নতুন জীবনের অনুপ্রেরণা, করেছিলো পরিপূর্ণ।