বোস্টন টি পার্টি: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের চা বিদ্রোহ, Stay Curioussis

১৬ ডিসেম্বর, ১৭৭৩ সাল। কলোনিয়াল আমেরিকার বোস্টন শহরের বন্দরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুইটি বড় বাণিজ্যিক জাহাজ চায়ের চালান নিয়ে জেটিতে ভিড়ে।  এর আগে ক্ষুব্ধ আমেরিকান ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভের মুখে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু জাহাজ নোঙ্গর গাড়তে না পারলেও এই জাহাজ দুটো সফলভাবে পোতাশ্রয়ে ভিড়তে সক্ষম হয়। কলোনিয়াল আমেরিকায় তখন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাঁধছিল। বিতর্কিত কর আরোপ নীতির কারণে আমেরিকানদের অসন্তোষ স্পষ্ট হয়ে উঠে ব্রিটিশ জাহাজ ঠেকিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। ব্রিটিশরা যদি আমেরিকায় চা নিয়ে আসতে পারে তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে এমন বাস্তবতায় কিছু ব্যবসায়ী রেন্ড ইন্ডিয়ানদের ছদ্মবেশ নিয়ে রাতের আঁধারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঐ জাহাজ দুটিতে উঠে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীর এ দলটি ৩৪২ টি চা ভর্তি সিন্দুক সমুদ্রে ফেলে দেয়। ইতিহাসে এ ঘটনা পরিচিত বোস্টন টি পার্টি নামে।

বোস্টন টি পার্টি: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের চা বিদ্রোহ, Stay Curioussis

বোস্টন টি পার্টি

ক্ষোভ বাড়ছিল আগে থেকেই

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর ১৭৭৩ তারিখের এই ঘটনা ছিল আমেরিকানদের প্রথম কোন বড় ধরণের প্রকাশ্য অবাধ্যতা যা আমেরিকার ১৩ টি উপনিবেশে স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিল। ১৭৬০ সালের দিকে ব্রিটেন সরকার মারাত্মক ঋণের জালে পড়ে যায়। আর তাদের এই ঋণ পরিশোধ করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকান উপনিবেশে বেশ কয়েকটা জবরদস্তমূলক কর নীতি প্রণয়ন করা হয়। ১৭৬৫ সালে আরোপ করা হয় স্ট্যাম্প এক্ট নামের একটি বিতর্কিত করনীতি। এই নীতির আওতায় প্রত্যেক আমেরিকানদের ব্যবহার্য প্রিন্টেড  কাগজের উপর অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হয়।  এই তালিকায় তাস থেকে শুরু করে সংবাদপত্রও ছিল। ১৭৬৭ সালে প্রণয়ন করা হয় টাউনশেন্ড এক্ট। এই নীতির আওতায় কাগজ, রঙ, গ্লাস, সীসা এবং চা এর উপর কর আরোপ করা হয়। ব্রিটিশ সরকার মনে করত এই করব্যবস্থা সঠিক ছিল কেননা এই কলোনিগুলোকে রক্ষা করতে তারা নিজেদের গাটের টাকা খরচ করছে। সুতরাং সরকার যখন ঋণে আবদ্ধ তখন সেই উপনিবেশের নাগরিকদেরই এই ঋণ পরিশোধ করা উচিত। কিন্তু আমেরিকানরা এই ব্যবস্থার ওপর নাখোশ হয়।  তারা দাবি করে সংসদে নিজেদের কোন প্রতিনিধি ছাড়া তারা কোন কর সরকারকে দিবে না। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তেজনায় মোড় নেয়। আমেরিকানদের ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে তুলেছিল ১৭৭০ সালের ৫ মার্চ ঘটা বোস্টন হত্যাকাণ্ড।  সেদিন নিজেদের রাস্তায় ব্রিটিশ সৈন্যদের উপস্থিতির প্রতিবাদে আমেরিকানরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। ছোট একটি দাঙ্গা পরে হত্যাকাণ্ডে রূপ নেয়। ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলির আঘাতে মারা যায় ৫ আমেরিকান এবং আহত হয় আরো প্রায় ৬ জনের মত।

বোস্টন টি পার্টি: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের চা বিদ্রোহ, Stay Curioussis

১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্ট্যাম্প আইন পাশ করা হয়

চা আইন এবং আমেরিকান  বিদ্রোহ

আমেরিকানদের অব্যাহত ক্ষোভের মুখে অবশেষে চা ছাড়া বাকিসব পণ্যের ওপর আরোপিত কর রহিত করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু চা থেকে তারা কর সরায়নি কেননা এই চা থেকেই আমেরিকায় বার্ষিক ১.২ মিলিয়ন পাউন্ড অর্জিত  হতো। কিন্তু আমেরিকানরা আবারো বিক্ষোভ দেখায় এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা বর্জন করতে থাকে। তারা গোপনে ডাচ কোম্পানি এবং অন্যান্য চোরা কারবারিদের কাছ থেকে  চা ক্রয় করে ব্রিটিশ চা ত্যাগ করে। এর ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায় ব্রিটিশ এই বণিক গোষ্ঠী। ১৭৭৩ সালের মে মাসে, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্রিটেন সরকার সংসদে একটি বিল পাশ করে। নতুন প্রণীত এই আইনে আমেরিকান কলোনিতে ভ্যাট ছাড়া এবং অন্যান্য কোম্পানি থেকে অধিকতর কম মূল্যে চা ক্রয়ের সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় বন্দরে ভিড়ার পরেই সে চা এর মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। তদুপরি চোরাই চা এর কারবার বেড়ে যায়। বিখ্যাত  চা চোরাকারবারি জন হ্যানকক এবং স্যামুয়েল এডামস এর সাহায্যেও আমেরিকানদের এই আন্দোলন বেগ পায়। যদিও এই চা চোরাকারবারিরা নিজেদের ব্যবসা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য চোরাকারবার নিয়ে কোন কথা বলেনি। যাহোক, ব্রিটিশদের আন্দোলন চলতে থাকে।

সনস অফ লিবার্টির ব্রিটিশ জাহাজ আক্রমণ

ব্রিটিশদের করব্যবস্থা এবং অন্যান্য বৈষয়িক বৈষম্যের প্রতিবাদে আমেরিকান ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে একটি দল গঠিত হয়।  এর নাম দেয়া হয় সনস অফ লিবার্টি। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক বেনেডিক্ট আর্নল্ড( পরবর্তীতে কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক),  প্যাট্রিক হেনরি, পল রিভার, এডামস, হ্যানককের নেতৃত্বে গড়া এই  বিপ্লবী দলটি এডামসের নেতৃত্বে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট অভিমুখে বিক্ষোভের আয়োজন করে। একই সময়ে তারা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা বহনকারী জাহাজ ডার্টমাউথ, বেভার, ইলেনর কে বন্দরে আটকে দেয়ার পরিকল্পনা করে। ডিসেম্বর ১৬, ১৭৭৩ তারিখে চীন থেকে চা বহনকারী জাহাজ তিনটি বন্দরে এসে নোঙ্গর করে। ঐদিন সকালে প্রায় হাজারখানেক আমেরিকান বন্দর সংলগ্ন সড়কে এসে জড়ো হয়। একই সময়ে ঐ সড়কের একটি সম্মেলন কক্ষে চায়ের উপর কর আরোপ বিষয়ে ভোটের আয়োজন চলছিল। এই সম্মেলনে জাহাজ থেকে চায়ের চালান নামিয়ে ফেলার পক্ষেও নানা আলোচনা সমালোচনা চলছিল। কাকতালীয়ভাবে, ঐ জাহাজগুলো আমেরিকায় তৈরি হওয়া আমেরিকানদের সম্পত্তিই ছিল। গভর্ণর থমাস হাচিসন জাহাজ তিনটিকে ব্রিটেনে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালে বিদ্রোহীদের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। আর এরই সাথে মঞ্চায়নের অপেক্ষা করে আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ঘটনা বোস্টন টি পার্টি।

বোস্টন টি পার্টি: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের চা বিদ্রোহ, Stay Curioussis

সন্স অফ লিবার্টির বৈঠক

সেদিন রাতে সনস অফ লিবার্টির সদস্যরা আরো সাধারণ আমেরিকানদের সাথে নিয়ে ব্রিটিশ তিন জাহাজে ঢুকে পড়ে।  সেদিনের অভিযানে অংশ নেয়া জেমস হকস এর ভাষ্যমতে, ” আমরা আমাদের কমান্ডারের আদেশে জাহাজে ঢুকে দরজা খুলে ফেলি। সেখান থেকে চায়ের স্তূপগুলো বাঁধন থেকে খুলে ফেলি এবং আস্তে করে পানিতে ফেলে দেই”। 

আরেক অংশগ্রহণকারী জর্জ হিউস বলেন, ” আমরা ব্রিটিশ অস্ত্রবাহী জাহাজ দ্বারা আবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু সেদিন কোন শক্তিই আমাদের রুখতে পারেনি”। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বোস্টনের এই জাহাজ আক্রমণ যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করে। ব্রিটিশরাও বুঝতে পারে আর আমেরিকানদের দাবায়া রাখা সম্ভব হবে না। এই ঘটনার তিন বছর পর আমেরিকা তার ১৩ টি প্রদেশ নিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যা ১৭৮৩ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে পূর্নাঙ্গ রূপ লাভ করে। অর্জিত হয় আমেরিকার স্বাধীনতা।