দেবদাসী ঈশ্বরের নামে দাসত্ব ছিল যাদের ভাগ্য

মন্দিরের প্রস্তরের দেবতা বলে কি মানুষ নন? খানিক এমনটা ধারণা করেই দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এক বিশেষ শ্রেণীর মেয়েদের নিযুক্ত করার রীতি চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। এঁদের কে বলা হত দেবদাসী অর্থাৎ দেবতার দাসী। আরাধ্য দেবতাকে প্রসন্ন করা হয় এক নৃত্য পরিবেশন করে, দেবদাসী নৃত্য। ৬৪ কলায় তাঁরা পারদর্শী। ভরতনাট্যম, ওড়িশি, কুচিপুড়ি এসবের কঠোর শিক্ষা পেতেন তাঁরা। ২০১৩ সালে কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গ মালা দুর্গা মন্দিরে নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ’ করার অনুষ্ঠান করা হয়। দেবীর মন্দিরে মর্ত্যের দেবীরাই ব্রাত্য। এইসব উৎসর্গীকৃত মেয়েরা দেবতার মনোরঞ্জনের বদলে হয়ে উঠত মন্দিরের পুরোহিত ও পরিষদ বর্গের বিকৃত যৌন লালসার শিকার।

দুই দেবদাসী দক্ষিণ ভারতের এক মন্দির কক্ষে, ১৯২৭ সালে তোলা ছবি, Image Source: British Pathe

দেবদাসী ইশ্বরের সেবিকা। অতীতে তাদের পরিচয় ছিল কলাবন্তী বা শিল্পকলায় পারদর্শিনী রূপে। মন্দিরের বিভিন্ন কাজ যেমন মন্দির রক্ষণা বেক্ষণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, প্রদীপে তেল ঢালা, পূজা মন্ডপ ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান নৃত্য করা এবং পুজোর সময় প্রতিমাকে বাতাস করা। গরীব ঘরের বা শূদ্র শ্রেণীভুক্ত মা-বাবা কুমারী মেয়েকে রজস্বলা হওয়ার আগেই (১২-১৩ বছর) নিয়ে আসতেন মন্দিরে। প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়। এরপর বিগ্রহের সাথে বিয়ে দেওয়া হয় মেয়েটির। এরপর অন্য কোনো পুরুষ ওই মেয়েটির স্বামী হতে পারে না পরবর্তীতে। কাজের জন্য তাদের মন্দির তহবিল থেকে কিছু অর্থ দেওয়া হত। আর তারা থাকতেন মন্দিরের মূল চাতাল থেকে ৩০ ফুট নীচে ছোট ছোট ঘরে আরো শয়ে শয়ে দেবদাসীর সাথে। কোনোদিন চিকিৎসকের প্রয়োজন হয়না এদের। রাত্রি তৃতীয় প্রহরে মুখ কাপড়ে ঢেকে সমুদ্রে বা নদীতে স্নান সারেন। মৃত্যুর পর কোনো দাহকার্য হায়না। তাঁদের দেহে প্রভুর আদেশেই ভাসিয়ে দেওয়া হয় সমুদ্রে।

দেবদাসীদের নৃত্য দেখতে হাজির হত রাজারাও, Image Source: Google

আগেকার দিনে পুনঃপ্রজননের জন্য তাদের ঘরের এক বা একাধিক মেয়েকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করতেন মা বাবা। এর বদলে পেতেন বেশ ভালো রকম অর্থ। মন্দির সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে রাজা, ধনী ব্যক্তি দেবতার আনন্দ প্রদানের চিন্তা করতে থাকেন। নর্তকীর নিয়োগ করা হয় বিভিন্ন মন্দিরগুলিতে। দেবতার পায়ে থাকবেন, নৃত্য গীত পরিবেশন করবেন এতে খারাপের কি আছে। কিন্তু এই ইশ্বরের সেবা থেকে মূলত মর্ত্যের ঈশ্বর দূত বা রাজা, সম্রাট, ধর্মযাজক এদের সেবার অংশ হয়ে ওঠে। নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মত ব্যবহার শুরু হয় এই দেবদাসীদের। মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ বা প্রধান পুরোহিত সবার প্রথম ভোগ করতেন সেই কুমারী মেয়েকে অবলীলায়। এমনকি অনেক নিঃসন্তান পরিবারে দেবদাসীকে নিয়োগ করা হত। পরিবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের বাধ্য করা হত উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য। যেন যৌণ মিলন তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এসব সন্তানরা পরে ঠাকুর দাদার নামধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হত। আবার মন্দিরে কোনো অতিথি এলে তাঁর ‘সুখের’ সবরকম ব্যবস্থা এই দেবদাসীদের করতে হত। কোনো কোনো মন্দিরে ছিন্ন করা হত দেবদাসীর নারী, যাতে তাঁরা কোনোভাবেই সন্তান ধারণ না করতে পারে। ছোট ছোট মেয়েরা এই পথ থেকে কোনদিনই ফিরে যেতে পারতো না সমাজের মূল ধারায়। ধর্মীয় শিলমহোর দিয়ে বছরের পর বছর এই বেশ্যাবৃত্তিকে উপভোগ করে এসেছেন সমাজের মাথারা। কি করুণ পরিণতি একবার ভাবুন। প্রায় ৬০০০ হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় পর্দার আড়ালে চরম দারিদ্র, জাতিভেদ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কুৎসিত চেহারা দেখায়। নীচু জাতিকে শোষণ করা এর অন্যতম কারণ। আর এই গোটা ঘটনার নামকরণ হত পবিত্র গনিকাবৃত্তি(?) হিসেবে।

১৯৩৯ সালে এক ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার দেবদাসীদের ছবি তুলেছিলেন, Image Source: Google

বাৎস্যায়নের কামসূত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কলহনের রাজতরংগিণী আরো অনেক গ্রন্থে দেবদাসীর সম্বন্ধে উল্লেখ আছে। পদ্ম পুরাণ ও মেঘদূত বধ কাব্যে দেবদাসী নৃত্য সম্বন্ধে বলা আছে। সোমনাথ মন্দির, অসমের বিভিন্ন মন্দির এই নৃত্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এমনকি ভারতের স্বাধীনতার পরেও গুজরাট, ওড়িশা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্রের ইয়ালাম্মা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে ২ লাখ ৫০ হাজার মেয়েরকে নিযুক্ত করা হয়। এখনও কম করে আশি হাজার দেবদাসী রয়েছেন দক্ষিণ ভারতে। সনাতন প্রথা হিসেবে প্রচলিত এই প্রথা শুধুমাত্র নারীজাতির চরম দুর্দশার কথাই না, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মানসিকতার প্রমাণ দেয়। সম্প্রতি ভারতীয় সরকারের কিছু কঠোর আইন অনুযায়ী এই প্রথা বিলুপ্ত করার চেষ্টা হলেও , কোণায় কোণায় এখনও বেঁচে আছে সমাজের এই কলঙ্ক।

দেবদাসী ঈশ্বরের নামে দাসত্ব ছিল যাদের ভাগ্য