খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে ১২০০ সাল। ব্রোঞ্জ যুগ। প্রস্তর যুগের সমাপ্তিলগ্নে কপারের সাথে টিন মিশিয়ে মানুষ তৈরী করতে শুরু করে ব্রোঞ্জ। আর সেই থেকে আস্তে আস্তে পাথরের হাতিয়ার ও সরঞ্জামাদির পরিবর্তে জনপ্রিয়তা পায় সংকর ধাতু ব্রোঞ্জের হাতিয়ার ও সরঞ্জামাদি।

পৃথিবীর বহু সভ্যতা ও সাম্রাজ্য এই ব্রোঞ্জকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো। মিশরের আদি সাম্রাজ্যীয় যুগ (তুতেনখামুন এবং দ্বিতীয় রামেসিসের শাসনামল); মেসোপটেমীয় সভ্যতার আক্কাদীয় ও অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্য; পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় লেভান্টের হিট্টাইট, ক্যানানাইট, ইসরায়েলাইট ও আর্মেনীয় সভ্যতা; গ্রীক মাইসেনীয় সভ্যতা ও ক্রীট দ্বীপের মিনোয়ান সভ্যতা; চীনের শ্যাং ও ঝাউ সাম্রাজ্য এবং সিন্ধু নদের হরপ্পা সভ্যতা প্রভৃতি শক্তিশালী সভ্যতা কিংবা সাম্রাজ্যগুলো বিকশিত হয়েছিলো ব্রোঞ্জ যুগে। তবে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের পর হঠাৎ করেই অধিকাংশ সভ্যতার অস্তিত্ব বিলীন হতে শুরু করে। এ যেনো ব্রোঞ্জ পর্যায়ের এক আকস্মিক পতন! শক্তিশালী সভ্যতাগুলোর এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কারণ কি? কি ঘটেছিলো ব্রোঞ্জ যুগের অন্তিম ক্ষণে?

মিশরীয় শহর লুক্সরের বিপরীতে নাইল নদীর পশ্চিম তীরে থিবান পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট হলো মেডিনেট হাবু। ১৯ শতাব্দীতে সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতক অর্থাৎ ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকের একটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে, যেখানে সমুদ্র থেকে আসা এক ভয়ংকর সেনাবাহিনীর কথা বর্ণিত হয়েছে, যাদের সামনে কোনো ভূমি টিকতে পারে নি। তারা মিশরেই সর্বপ্রথম আক্রমণ করেছিলো এবং ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছিলো। সময়টা যেহেতু মিলে যায়, তাই অনেকেই মনে করেন, সমুদ্র থেকে আসা এই বিশেষ যোদ্ধাদের প্রভাবেই ব্রোঞ্জ যুগ পতনের দিকে ধাবিত হয়।

ব্রোঞ্জ যুগের আকস্মিক পতন

দ্য ফল অফ ট্রয়

সমুদ্র থেকে আসা এই জলদস্যুদের পরিচয় নিয়ে নানান ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। অধিকাংশ মতবাদই সাক্ষ্য দেয়, এই জলদস্যুরা ছিলো গ্রীক। কারণ গ্রীকদের হাতে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিলো ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকের সময়েই। সে সময় গ্রীকরা হিংস্র দানবের মতো বহু শক্তিকে দমন করেছিলো বলে জানা যায়। এ ছাড়াও হোমারের ‘ওডিসি’ এবং ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যেও প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রীক জলদস্যুদের ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। তবে এককভাবে শুধু এদের দায়ী করলেও ভুল হবে। কেননা ব্রোঞ্জ পর্যায়ের অন্তিম সময়ে গ্রীকরা নিজেরাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো, যার জলজ্যান্ত প্রমাণ মাইসেনিয়া ও ক্রীটের নিপাতন।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, মধ্য ইউরোপীয় উপজাতিদের একটি দল এই দস্যুতার সঙ্গে জড়িত ছিলো। কারণ ব্রোঞ্জ যুগের শেষ পর্যায়ে মধ্য ইউরোপে একটি উল্লেখযোগ্য অভ্যুত্থান লক্ষ করা যায়। আসলে এই দস্যুদের প্রকৃত পরিচয় মেলা কঠিন। কারণ প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, কেনোই বা এই সময়েই দস্যুবৃত্তির প্রকোপ এতোটা বৃদ্ধি পেলো। সমুদ্রের এই দস্যুদের পরিচয় কি?

শেষ ব্রোঞ্জ যুগের মিশরীয় শিলালিপিগুলোতে সমুদ্রের দস্যু হিসেবে যাদের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, তাদের একেক জনের মাথায় একেক ধরনের টুপি দেখতে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে জাতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। অনেকে তো সঙ্গে বলদ টানা গাড়ির মতো বাহন নিয়েও এসেছিলো। নিশ্চয়ই যুদ্ধ করবার উদ্দেশ্যে কেউ এই ধরনের গাড়ি সাথে নিয়ে আসবে না। তবে এরা কারা? ধারণা করা হয়, এরা আসলে উদ্বাস্তু। বিশেষ কোনো কারণে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ভূমিহীন, খাদ্যহীন হয়ে জীবনের তাগিদে বাধ্য হয়ে দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছিলো। কি এমন ঘটেছিলো তাদের জীবনে? কিভাবে উদ্বাস্তু হলো ভিন্ন জাতের এতোগুলো মানুষ?

গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে ভূমধ্যসাগরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয় এবং ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। তীব্র খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় প্রতিটি অঞ্চলে। অনাহারী মানুষেরা খাদ্যের সন্ধানে শক্তিশালী অঞ্চলগুলোর ওপর আক্রমণ করে বসে এবং আক্রমণাধীন অঞ্চলগুলোতে তারা ‘দ্য সী পিপল’ বা সমুদ্র থেকে আসা জলদস্যু হিসেবে পরিচিতি পায়। সুতরাং এই দস্যুরা ব্রোঞ্জ যুগের পতনের একক কারণ হতে পারে না, কেননা তারা নিজেরাই ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার।

ব্রোঞ্জ যুগের আকস্মিক পতন

দ্য সী পিপল’ বা সমুদ্র থেকে আসা জলদস্যু

খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালের দিকে গ্রীসের ক্রীট দ্বীপের মিনোয়ান সভ্যতার ধ্বংস তো অবশ্যই প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। বর্তমানে ‘সান্তোরিনি’ নামে পরিচিত আগ্নেয়গিরির দ্বীপ থেরার ধ্বংসাত্মক অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট বিস্ফোরণে দ্বীপটি একটি বিশাল অন্ধকার গর্তে পরিণত হয়েছিলো এবং এই বিস্ফোরণের প্রভাবে সংঘটিত ভয়ংকর ভূমিকম্প অসংখ্য সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো, যার মধ্যে ছিলো মিনোয়ান সভ্যতাও। ভবনগুলোর দেয়ালে বড় বড় ফাটল, হেলে পড়া দেয়াল, ভেঙে পড়া স্তম্ভ, পড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের নিচে চূর্ণ দেহ ইত্যাদি ব্রোঞ্জ যুগের শেষ দিকের সময়ের মারাত্মক ভূমিকম্প সংঘটনেরই সাক্ষ্য দেয়।

এ ছাড়াও ব্রোঞ্জ যুগের পতন ও লৌহ যুগের উত্থানের সময়টি বিস্ময়করভাবেই মিলে যায়। আগে যুদ্ধগুলো হতো চ্যারিয়ট বা যুদ্ধরথকেন্দ্রিক এবং ব্রোঞ্জ যুগের শেষ সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তলোয়ার ব্যবহারের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে ইতিহাসবিদ রবার্ট ড্রুসের মতো অনেকেই বলেছেন, ব্রোঞ্জ যুগের শেষে সামরিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য লোহা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, অস্ত্রের গুণগত মানের পরিবর্তনই এখানে মুখ্য বিষয়, কেননা চ্যারিয়ট ও তীর-ধনুকের বদলে সেই সময়টাতে ব্রোঞ্জের তরবারি ও জ্যাভেলিনের ব্যবহার ভীষণভাবে বেড়ে যায়।

এতো কিছুর পরেও লোহার ব্যবহারের ব্যাপকতাকে একদম হেলায় ফেলে দেয়া যাবে না। কারণ ব্রোঞ্জের তুলনায় লোহা কঠিন ও অধিকতর শক্তিশালী। দুইয়ের মাঝে তুলনা চলে না। লৌহভিত্তিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদির সামনে ব্রোঞ্জভিত্তিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি নিতান্তই খেলনাতুল্য। সুতরাং লৌহ যুগের সূচনালগ্নে ব্রোঞ্জের ব্যবহারের ব্যাপকতা হ্রাস পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন রিলিফে চিত্রিত তথাকথিত জলদস্যুদেরকেও মজবুত তলোয়ার, জ্যাভেলিন, মজবুত ঢাল ও ভারী বর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা গিয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য সুসজ্জিত এই পদাতিক বাহিনীর পক্ষে চলে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ব্রোঞ্জ যুগের পুরনো সভ্যতাগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়।

ব্রোঞ্জ যুগের আকস্মিক পতন

মেডিনেট-হাবু মন্দির

ব্রোঞ্জ যুগের শেষ পর্যায়ে পারস্পরিক অনাস্থা ও অন্তঃর্কলহও বিভিন্ন সভ্যতার ধ্বংসকে প্রভাবিত করেছিলো। রাজা কিংবা শাসককে দেবতার মর্যাদা প্রদানকারী প্রজারা যখন উপলব্ধি করলো, দুর্ভিক্ষের চরম পরিস্থিতিতে তাদের দুরবস্থাকে অপসারণের সামর্থ্য রাজার নেই, বরং রাজারা নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন অনাহারী মানুষগুলো বিদ্রোহী হলো এবং প্রজাদের অনাস্থার বশবর্তী হয়ে শাসকেরা নিজেদের শক্তি হারাতে শুরু করলো।

আসলে যখন আন্তর্জাতিক কোনো বিপত্তি দেখা দেয়, তখন সামগ্রিকভাবে পুরো সিস্টেমটিই বিঘ্নিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রেও যদি চিন্তা করা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কিন্তু সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। বিশ্ব বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পৃথিবীব্যাপী এক আশঙ্কাজনক দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। ঠিক এমনটিই ঘটেছিলো ব্রোঞ্জ পর্যায়ের সমাপ্তিলগ্নে। কোনো একটি স্থান যখন দুর্যোগ, খরা, অনাবৃষ্টি ও ভূমিকম্প দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলো; তখন তার সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে জড়িত অন্যান্য অঞ্চলগুলোও কাঁচামালের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং সামগ্রিকভাবে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে গেলো। আর এই দুর্ভিক্ষের কারণে জন্ম নিলো এক দল উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই আবার উত্থান হয় তুলনামূলক শক্তিশালী আরও একটি নতুন যুগের, যা স্তিমিত করে দেয় পুরনো সময়ের চিরাচরিত অভ্যাসকে। অতএব ব্রোঞ্জ যুগের ধ্বংসের পেছনে নির্দিষ্ট কোনো একটি কারণ নয়, বরং পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তারকারী অনেকগুলো ঘটনাই এর জন্য দায়ী।

 

রেফারেন্সঃ